বিদ্যুৎ ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং ঘনঘন লোডশেডিংয়ের কারণে রংপুর অঞ্চলে পরিবেশবান্ধব সৌরচালিত সেচ যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি সৌরবিদ্যুতের বহুমুখী ব্যবহার কৃষকদের আগ্রহ বাড়িয়েছে।
Advertisement
তবে শুরুতে সৌর প্যানেল স্থাপনে অনেক টাকা প্রয়োজন হওয়ায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) এবং বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) ওপর ভরসা করছেন কৃষকরা। রংপুর বিভাগে এই দুই প্রতিষ্ঠান ৩২৭টি সৌরচালিত সেচ যন্ত্র কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ফলে সেচের আওতায় এসেছে প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমি। এতে কেবল কৃষকের উৎপাদান খরচই কমছে না, সেচ বাবদ প্রচলিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমায় সরকারেরও সাশ্রয় হচ্ছে।
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার ৫নং বালাপাড়া ইউনিয়নের কৃষক মো. মুক্তার আলী বলেন, তার এলাকার ঢুসমাড়া চর এবং তালুক সাহাবাজ চরের বিস্তীর্ণ এলাকায় কয়েক বছর আগেও সেচের অভাবে শত শত জমি অনাবাদি পড়ে থাকতো। স্বচ্ছল ব্যক্তিরা নিজ খরচে শ্যালোমেশিন দিয়ে আবাদের চেষ্টা করতেন। এজন্য পরিশ্রমের পাশাপাশি উৎপাদন খরচও বৃদ্ধি পেতো। কিন্তু গত ৩ বছর ধরে চরের অনেক জমিতে এখন নিয়মিত আবাদ হচ্ছে।
মুক্তার আলী আরও বলেন, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) রংপুর থেকে ট্রলিতে করে ভ্রাম্যমাণ সেচযন্ত্রের মাধ্যমে সেচ নিশ্চিত করছে। ফলে তার ১০ একর জমিতে এখন নিয়মিত আলু, ভুট্টা, গম, চীনা বাদাম, কালিজিরা, মিষ্টিকুমড়া, পেঁয়াজ, মরিচ, রসুনসহ মশলা জাতীয় বিভিন্ন পণ্যের আবাদ করছেন তিনিসহ অন্য কৃষকরা। চরে এখন বিএডিসির দুটি পাতকুয়া, দুটি নৌকায় স্থাপিত সৌর বিদ্যুৎ চালিত ভ্রাম্যমাণ এলএলপিসহ মোট ৬টি সেচ যন্ত্র সচল আছে।
Advertisement
মুক্তার বলেন, সোলার বিদ্যুতের মাধ্যমে সেচ দেওয়ায় প্রতি দোন (২৫ শতক) জমিতে প্রতি বছর খরচ হচ্ছে প্রায় ৫০০ টাকা। অথচ শ্যালোমেশিনের মাধ্যমে সেচ দিলে শুধু জ্বালানি তেল প্রয়োজন হবে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার। তাই অনেকে এখন সৌরবিদ্যুৎ চালিত সেচের জন্য ধর্ণা দিচ্ছেন।
এদিকে সৌর চালিত যন্ত্র দিয়ে সেচের পাশাপাশি অনেক জায়গায় পরীক্ষামূলকভাবে এর বহুমুখী ব্যবহারও শুরু হয়েছে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, পলাশবাড়ি এবং রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার কাগজীপাড়া ও পীরগঞ্জ উপজেলার বড়বদনা গ্রামে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) কর্তৃক স্থাপিত সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে সেচ কার্যক্রমের পাশাপাশি চালানো হচ্ছে বেশ কয়েকটি মেশিন। এতে ভুট্টা মাড়াই, চাল থেকে আটা, ধান থেকে চাল, ছাতু, মশলাসহ গরুর খড় কাটা হচ্ছে নিয়মিত।
মিঠাপুকুর উপজেলার কাগজীপাড়ার বাসিন্দা ফজলুল হক বলেন, এখানে একবিঘা জমির ভুট্টা মাড়াই করতে নেওয়া হচ্ছে ৩শ টাকা। যা বাইরে নেওয়া হয় ৭শ টাকা। প্রতিমণ ধান ভাঙতে নেওয়া হচ্ছে ১৫ টাকা থেকে ১৮ টাকা। অন্য জায়গায় নেওয়া হয় ৩০ টাকা।
রংপুর বিএমডিএ এবং বিএডিসি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ থেকে রংপুর বিভাগের আট জেলায় এই দুই প্রতিষ্ঠান ৩২৭টি সৌরচালিত সেচ যন্ত্র কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ফলে সেচের আওতায় এসেছে ৪ হাজার ৯৩৯ হেক্টর জমি।
Advertisement
বিএমডিএর সৌরচালিত সেচ যন্ত্রের সংখ্যা ১৫৮টি। এরমধ্যে এলএলপি সেচযন্ত্রের সংখ্যা হচ্ছে ৭৫টি এবং পাতকুয়া হচ্ছে ৮৩টি।
অপরদিকে রংপুর বিভাগের (গাইবান্ধা ব্যতীত) সাত জেলায় বিএডিসির সৌর বিদ্যুৎ চালিত সেচযন্ত্র আছে ১৬৯টি। এরমধ্যে রংপুরে ৪০টি, নীলফামারীতে ১০টি, লালমনিরহাটে ৫৭টি, কুড়িগ্রামে ২৫টি, দিনাজপুরে ১১টি, ঠাকুরগাঁওয়ে ১৪টি এবং পঞ্চগড়ে ১২টি।
বিএমডিএর রংপুর সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এবং প্রকল্প পরিচালক মো. হাবিবুর রহমান খান বলেন, ভূ-উপরোস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে বৃহত্তর রংপুর জেলায় সেচ সম্প্রসারণ প্রকল্পের (আইআরপি) আওতায় ৫ বছর মেয়াদের সৌর বিদ্যুত চালিত এলএলপি পাম্প এবং পাতকুয়া স্থাপন শুরু হয়েছে। এতে কৃষকের সেচ খরচ প্রায় অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। এছাড়া সেচের পানিতে কোনো আয়রণ না থাকায় আবাদ ভালো হচ্ছে।
তিনি বলেন, ৫টি এলাকায় সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে সেচের পাশাপাশি পরীক্ষামূলকভাবে ধান ও ভুট্টাসহ বিভিন্ন শস্য ভাঙার জন্য মেশিন চালানো হচ্ছে। যা ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। পরিবেশবান্ধব সৌর বিদ্যুতের ব্যবহারের ফলে কৃষকের উৎপাদন খরচ যেমন কমছে তেমনি সরকারও লাভবান হচ্ছে।
হাবিবুর রহমান খান বলেন, কৃষকের ব্যাপক চাহিদা থাকায় নতুন করে চরসহ রংপুর অঞ্চলে প্রায় ৫শ সৌর বিদ্যুৎ চালিত এলএলপি পাম্প স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি পাস হলে আরও অনেক কৃষক উপকৃত হবেন। বিএডিসি রংপুর সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ক্ষুদ্র সেচ) এসএম শহীদুল আলম বলেন, সৌরবিদ্যুৎ চালিত সেচে কৃষকরা ব্যাপকভাবে উপকৃত হচ্ছেন ঠিকই কিন্তু এটি স্থাপনে প্রথমে যে ব্যয় হয় তা সব কৃষকের পক্ষে বহন করা সম্ভব হয় না। এজন্য বিএডিসি প্রকৃত কৃষকদের উপকার করার জন্য কাজ করছে। কিন্তু বর্তমান চলমান প্রকল্পে আর নতুন কোনো সেচ যন্ত্র স্থাপনের সুযোগ নেই। তাই রংপুর অঞ্চলে ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন ও সেচ দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে সাড়ে ৮শ সৌর বিদ্যুৎ যন্ত্র স্থাপন এবং দিনাজপুর জেলা ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ২৮০টি সেচ যন্ত্র স্থাপনের দুটি প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। প্রস্তাব দুটি অনুমোদন পেলে প্রান্তিক পর্যায়ে অনেক কৃষক লাভবান হবেন।
এফএ/এমএস