গতকাল ৩ মে বিশ্ব মুক্ত সাংবাদিকতা দিবস চলে গেল। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা আয়োজনে দিনটি পালন করছে বিভিন্ন সংগঠন। এ দিবসটি এলে বা কোনো উপলক্ষ পেলে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা কতটা চাপের মুখে তা নিয়ে আলোচনা হয়। সম্পাদক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা তুলে ধরেন দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সব চাপের কথা। এসবের মধ্যে আলোচনায় উঠে আসে আইনী ও রাজনৈতিক চাপ, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থেকে আসা চাপের প্রসঙ্গ এবং অতি অবশ্যই অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কথা।
Advertisement
কিন্তু পেশায় দীর্ঘদিন সক্রিয় এই সম্পাদকরা বলতে চান না যে, সাংবাদিকতা এদেশে বিপন্ন। তবে একটা বড় অংশই বলতে চেষ্টা করেন যে, সাংবাদিকতা আছে এবং থাকবে লড়াই করেই। তবে অনেক কিছুর মধ্যে মানুষ কী গণমাধ্যমের ওপর আস্থা রাখছে কিনা সেটি বড়ভাবে আলোচিত হয় না। তবে একটা স্বীকারোক্তি আছে যে পত্রিকা বা টিভিতে প্রচারিত সংবাদ কোনটি পাঠক বিশ্বাসযোগ্য বলে ধরে নেবে, সেই জায়গায় কিন্তু আমাদের ঘাটতি রয়ে গেছে। সেটিও একটি বড় চাপ।
পেশাদার সম্পাদক দৃশ্যমান শক্তিকে মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত থাকেন। মামলা হোক, জেলে যেতে রাজি তারা। তবে অদৃশ্য শক্তির কারণে সাংবাদিকদের জীবন হুমকির মুখে। সে জায়গা থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমাজকে সহনশীল করতে হবে।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে অদৃশ্য জায়গা থেকে সাংবাদিকতাকে বিপন্ন করে তোলা হচ্ছে। বলতেই হবে যে, দিন বদলেছে। আগে সাংবাদিকের প্রতিবেদন বা সম্পাদকীয় দিয়ে সরকারের সাফল্য বা ব্যর্থতা পরিমাপ করতো জনগণ। সরকারের নীতি সংশ্লষ্টরাও এসব প্রতিবেদন ও মতামতকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতেন। এখন আর সেটা নেই। এখন সাংবাদিকের অবমাননাই সংবাদ সারাদেশে।
Advertisement
অসংখ্য আইন আছে। এর মধ্যে ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সবচেয়ে ভুগিয়েছে সাংবাদিকতাকে। মাত্র কিছুদিন আগে এর নাম বদলে হয়েছে সাইবার নিরাপত্তা আইন যেটি আসলে আগেরটারই নতুন নাম। প্রেস কাউন্সিলসহ সরকারের সব প্রতিষ্ঠানই আইন করতে চায় সাংবাদিকতাকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। এর অর্থ হলো, কেউ সাংবাদিকতা বিকাশ চায় না, সব শক্তিই যার যার জায়গা থেকে নিয়ন্ত্রণ চায়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অসংখ্য সাংবাদিকের গ্রেফতার ও হয়রানির কারণে, আরও বিভিন্ন আইনের প্রয়োগে উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল সাংবাদিকের নিরাপত্তা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে। সামান্য কারণে অথবা অকারণে সাংবাদিকদের গ্রেফতার, পুলিশি জেরা, ভীতি প্রদর্শন, সরকারি বিজ্ঞাপনকে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার করায় একটা নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ এমনিতেই বিরাজ করছে গণমাধ্যম জগতে। অন্যান্য প্রক্রিয়াও বাদ নেই। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে রাজনৈতিক ও ধর্মগোষ্ঠীর পালিত মাস্তানদের পাশাপাশি আমরা দেখেছি জেলা প্রশাসক, ইউএনওরাও কীভাবে সাংবাদিকদের নির্যাতন করতে পারেন, গালাগাল দিতে পারেন।
সংখ্যা অবশ্যই একটি বিবেচ্য বিষয়। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে বিবেচনা করলে মনে হবে চমৎকারভাবে বিকশিত এক জগৎ। কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত অসংখ্য পত্রিকা, অনলাইন, বেতার। টেলিভিশনের সংখ্যাও প্রায় ৪০টি। মনে হবে যেন খুবই সক্রিয় একটা মিডিয়া দুনিয়ায় আছি আমরা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।
সময় বদলেছে, কিন্তু বাংলাদেশে সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য বিধেয়ই যেন বদলে গেছে। এমনকি স্বৈরাচারের আমলেও যে সাহস আর প্রতিজ্ঞা দেখা গেছে, সেটি এখন আর নেই। একটা সময় সাংবাদিকতার দর্শন ছিল, জনগণকে ঠিক তথ্য সেবা দেয়া, শিক্ষিত করে তোলা। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে যেন সহায়ক ভূমিকা পালন করে, সেই ধরনের তথ্য মতামত পরিবেশন করা। এখন সেটি কাগজে কলমে থাকলেও পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে গণমাধ্যমে প্রবেশ করা ব্যবসায়ীর পুঁজির সেবা করা। তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করা। কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কিছু কোটারি, কিছু দল, মত এগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার প্রতিযোগিতা সাংবাদিকতার পরিসরটা দখল করেছে। স্বার্থের দ্বন্দ্ব বলে যে একটা বিষয় আছে সেটা শাসন ব্যবস্থায যেমন আমরা দেখিনা, তেমনি নেই সংবাদ জগতেও।
Advertisement
সরকার, প্রশাসন, তথা শাসন ব্যবস্থার কার্যকলাপ সম্পর্কে জানবার অধিকার গণতন্ত্রে নাগরিকের এক বড় অধিকার। সাংবাদিকের কাজ কোনোভাবে প্রতিহত হলে মানুষের সেই অধিকার খর্ব হতে বাধ্য। আমরা মাঝে মাঝেই দেখতে পাই এই অফিসে, সেই অফিসে বা অমুক কর্তা সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা দিচ্ছেন। তারা ভুলে যান যে, সেই অফিসগুলোর মালিক জনগণ এবং সাংবাদিক জনগণের পক্ষে সেখানে গিয়ে তাকে প্রশ্ন করবার অধিকার রাখেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে, বা সাংবাদিকতাকে চাপে রেখে, নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতি ও প্রশাসন চালানোর প্রচেষ্টা শুধু সাংবাদিকতাকে নয়, গণতন্ত্রকেই বিপন্ন করে।
তাহলে কী আমরা ধরে নিব যে, সাংবাদিকতার দিন গিয়েছে? একটা কথা বলা ভাল যে, দ্বন্দ্ব যেমন প্রগতির পথ খুলে দেয়, প্রতিবন্ধকতাও বিকাশের পথ প্রশস্ত করে। আর সে জন্য রাজনীতি, ধর্ম, কর্পোরেট বা অন্য যেকোনো স্থান থেকেই বাধা আসুক না কেন, উদ্যোগটা নিতে হবে সাংবাদিকদেরই। দলীয় সাংবাদিকতা, মালিকের সাংবাদিকতা, গোষ্ঠীর সাংবাদিকতার চাপ মোকাবেলা করে ভাল সাংবাদিকতার পথে যেতে দলীয় আর গোষ্ঠীগত বিভাজনের পথ ছেড়ে নিজেকেই স্বাধীনতার পথে চলতে হবে। আর এ জন্য সাংবাদিক ও সম্পাদকদের সংগঠনগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
গণমাধ্যমে বড় পুঁজির প্রবেশ ঘটেছে, অনেক সাংবাদিক ও সম্পাদক ব্যবস্থাপকদের বেতন ও সুবিধা বড় আকার নিয়েছে। কিন্তু এই পুঁজির খুব অল্পই কর্পোরেট সংস্কৃতি থেকে আসা। বড় অংশটাই এসেছে অনার্জিত অর্থ থেকে। তাই সাংবাদিকদের বেতনভাতা, সুযোগ-সুবিধা, চাকরির নিরাপত্তা খুবই দুর্বল অবস্থায় রয়ে গেছে এবং দিন দিন তা প্রকট হচ্ছে। এমন বাস্তবতায় ভাল সাংবাদিক পেশা ছাড়ছেন, বাকিরা উদ্যম হারিয়ে এখন শুধু চাকরি করছেন। উন্মুক্ত ডিজিটাল তথ্য মহাসড়কে মানুষ যে কনটেন্ট চায় তা দিতে না পারলে তো মানুষ সংবাদ মাধ্যম ছেড়ে যাবেই।
দেশে গণমাধ্যমের এই যে নিম্নগামী জনপ্রিয়তা, তার ফল ভয়াবহ। যে সব মাধ্যম মোটামুটি নির্ভয়ে সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশন করত, তাদেরও নিয়ত সতর্ক থাকতে হয়। অর্থনৈতিক ভিতও টলে যাচ্ছে প্রায় সবার। সাথে এসেছে আর একটি গভীর সমস্যা - সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতা। নির্ভীক ও তথ্যসমৃদ্ধ সংবাদ পড়া বা দেখা ছাড়া নাগরিকদের হাতে মূল্যবান কিছু কী থাকে?
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস