জাতীয়

চট্টগ্রামে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে রাতের তাপমাত্রা

তিন দশকে চট্টগ্রাম শহরের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও বঙ্গোপসাগরে উষ্ণতা বৃদ্ধিকে দুষছেন গবেষকরা নগরের ৪৫ শতাংশ এলাকায় তৈরি হচ্ছে একাধিক ‘আরবান হিট আইল্যান্ড’

চট্টগ্রাম নগরের দক্ষিণ বাকলিয়া ওয়ার্ড থেকে বোয়ালখালী উপজেলার দূরত্ব মাত্র ১০ কিলোমিটার। কিন্তু এই দুই এলাকার তাপমাত্রার পার্থক্য প্রায় ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ বোয়ালখালীতে যখন স্বাভাবিক তাপমাত্রা বিরাজ করছে, দক্ষিণ বাকলিয়ার বাসিন্দারা তখন গরমে অতিষ্ঠ।

Advertisement

পাহাড়, নদী-লেক আর সাগরঘেরা এক সময়ের সবুজ শহর চট্টগ্রামের তাপমাত্রা দিনদিন বেড়েই চলেছে। গত তিন দশকে চট্টগ্রাম শহরের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা বেড়েছে এক দশমিক এক ডিগ্রি সেলসিয়াস। বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে চট্টগ্রাম উপকূলে বাড়ছে তাপপ্রবাহের হার। পাশাপাশি উষ্ণ বায়ুপ্রবাহের কারণে চট্টগ্রামে বাড়ছে রাতের তাপমাত্রা।

চট্টগ্রাম নগরীর ৪৫ শতাংশ এলাকাকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘বিল্ড-আপ’ এরিয়া হিসেবে। যেসব এলাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে একাধিক ‘আরবান হিট আইল্যান্ড’। এসব এলাকায় স্বাভাবিকের চেয়ে ৬ থেকে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপ অনুভূত হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান এই তাপমাত্রার কারণে বেড়েছে হিট স্ট্রোক এবং ত্বকের ক্যানসারের মতো রোগ। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশু, গর্ভবতী নারী ও বৃদ্ধরা।

রাতের চট্টগ্রাম শহর/ ছবি- সংগৃহীত

Advertisement

দুই পৃথক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্লানিং বিভাগ ও অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আশরাফ দেওয়ান এসব গবেষণা পরিচালনা করেন।

গবেষকরা মনে করেন, অপরিকল্পিত অবকাঠামো ও ভবন নির্মাণের কারণে চট্টগ্রামে ‘আরবান হিট আইল্যান্ড’ তৈরি হচ্ছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বদলে যাচ্ছে চিরাচরিত ঋতুবিন্যাস। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম শিগগির পরিণত হবে চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়া এলাকায়।

গবেষকরা মনে করেন, অপরিকল্পিত অবকাঠামো ও ভবন নির্মাণের কারণে চট্টগ্রামে ‘আরবান হিট আইল্যান্ড’ তৈরি হচ্ছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বদলে যাচ্ছে চিরাচরিত ঋতুবিন্যাস। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম শিগগির পরিণত হবে চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়া এলাকায়।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ গবেষক তাদের এক গবেষণায় চট্টগ্রাম শহরের ওয়ার্ডভিত্তিক তাপপ্রবাহের মাত্রা নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। ওই গবেষণায় রিমোট সেন্সিং ডেটা ব্যবহার করে ১৭টি শারীরিক ও আর্থ-সামাজিক দিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

Advertisement

আরও পড়ুন

মে মাসেও দিনের তাপমাত্রা বেশি, হতে পারে ঘূর্ণিঝড় তীব্র গরমের পর অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের শঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ায় যশোরে মরুর উত্তাপ, দেশের সর্বোচ্চ ৪৩.৮ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড

এতে বলা হয়েছে, অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে বহুতল ভবনগুলো ঘিরে হিট ওয়েভ বেশি কার্যকর। ফলে নগরে দিনে-রাতে প্রায় সমান তাপ অনুভূত হচ্ছে। চট্টগ্রাম নগরের ৭টি ওয়ার্ড তাপপ্রবাহের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া তিনটি ওয়ার্ড চিহ্নিত করা হয়েছে উষ্ণতার জন্য ‘হটস্পট’ হিসেবে। চট্টগ্রাম নগরের হটস্পট হলো ১৭ নম্বর পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ড, ১৯ নম্বর দক্ষিণ বাকলিয়া ওয়ার্ড ও ২০ নম্বর দেওয়ানবাজার ওয়ার্ড।

রাতের চট্টগ্রাম শহর/ ছবি- সংগৃহীত

এছাড়াও ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলো হলো- পশ্চিম ষোলশহর, দক্ষিণ কাট্টলী, সরাইপাড়া, লালখান বাজার, পশ্চিম বাকলিয়া, দক্ষিণ বাকলিয়া ও পশ্চিম মাদারবাড়ী ওয়ার্ড।

চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক দেবাশীষ রায় রাজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আরবান হিট আইল্যান্ড হলো কোনো শহরের সেই এলাকা, যেখানে মানবসৃষ্ট কারণে আশপাশের এলাকার তুলনায় উষ্ণতা বেশি। গ্লাস কোডেড বিল্ডিং, ভবনের ছাদ, পিচঢালাই সড়ক কিংবা ঢালাই করা এলাকা উন্মুক্ত মাটির তুলনায় বেশি তাপ ধরে রাখে। যেসব এলাকায় গাছপালা ও জলাশয় কম এবং যন্ত্রচালিত যানবাহন বেশি- সেসব এলাকায় হিট আইল্যান্ড তৈরি হয়।’

এছাড়া মানুষের বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থাও গরমের তীব্রতার সঙ্গে জড়িত বলে উল্লেখ করেন দেবাশীষ রায় রাজ।

চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা (ওয়ার্ড ভিত্তিক

বঙ্গোপসাগরে উষ্ণতা, চট্টগ্রামে বাড়ছে রাতের তাপমাত্রা প্রায় তিন দশক ধরে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ও উপকূলীয় এলাকায় তাপপ্রবাহের মাত্রা বাড়ছে। এসব কারণে চট্টগ্রামে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে রাতের তাপমাত্রা। এ সময়ে ঢাকার তুলনায় চট্টগ্রামে রাতের তাপমাত্রা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। ঢাকায় যেখানে বেড়েছে শূন্য দশমিক ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, চট্টগ্রামে সেখানে বেড়েছে শূন্য দশমিক ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

সম্প্রতি বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্ক আয়োজিত এক ওয়েবিনারে উপস্থাপিত এক প্রবন্ধে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেন অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আশরাফ দেওয়ান।

আরবান হিট আইল্যান্ড হলো কোনো শহরের সেই এলাকা, যেখানে মানবসৃষ্ট কারণে আশপাশের এলাকার তুলনায় উষ্ণতা বেশি। গ্লাস কোডেড বিল্ডিং, ভবনের ছাদ, পিচঢালাই সড়ক কিংবা ঢালাই করা এলাকা উন্মুক্ত মাটির তুলনায় বেশি তাপ ধরে রাখে। যেসব এলাকায় গাছপালা ও জলাশয় কম এবং যন্ত্রচালিত যানবাহন বেশি- সেসব এলাকায় হিট আইল্যান্ড তৈরি হয়।

গবেষণায় গত ২০ বছরের (২০০০-২০২০) ডেটা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দিনের বেলায় গ্রামের সঙ্গে ঢাকার তাপমাত্রার গড় পার্থক্য ২ দশমিক ৭৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে এ সময় চট্টগ্রামের পার্থক্য এক দশমিক ৯২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু রাতে ঢাকায় তাপমাত্রার পার্থক্য এক দশমিক ৫৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও চট্টগ্রামে তা এক দশমিক ৯০ ডিগ্রি। অর্থাৎ চট্টগ্রামে দিন এবং রাতের তাপমাত্রায় তেমন কোনো পার্থক্য নেই।

চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে তাপমাত্রা প্রভাবে (a) সুরক্ষাহীনতা (b) সংবেদনশীলতা (c) অভিযোজিত ক্ষমতা এবং (d) চসিকে তাপ দুর্বলতা সূচকের স্থানিক পরিবর্তন

এছাড়া ১৯৯৩ থেকে ২০২২ সালের আবহাওয়ার দৈনিক উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বছরে ১৫ দিনের বেশি দাবদাহ ছিল এমন জেলাগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম অন্যতম।

আরও পড়ুন

দক্ষিণপূর্ব এশিয়াজুড়ে তীব্র তাপপ্রবাহ দাবদাহে ঢাকায় উৎপাদনশীল খাতে বছরে ক্ষতি ২৭০০ কোটি ডলার দাবদাহ আমাদের দীর্ঘদিনের পরিবেশ দূষণের ফল

চট্টগ্রাম ছাড়াও তাপপ্রবাহ বাড়ছে এমন উপকূলীয় এলাকাগুলো হলো- কক্সবাজার, নোয়াখালীর হাতিয়া, ভোলা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, খুলনা ও সাতক্ষীরা।

চট্টগ্রামে রাতের তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়ে অধ্যাপক আশরাফ দেওয়ান জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত কয়েক দশক ধরে বঙ্গোপসাগরে তাপমাত্রা বাড়ছে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম শহরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। সাগর থেকে ভূ-ভাগে প্রবেশ করছে উষ্ণ বায়ু।’

চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে হটস্পট ও উচ্চ তাপমাত্রার গুচ্ছ এলাকাসমূহ/ ছবি- গবেষণা প্রতিবেদন

তিনি আরও বলেন, ‘একইভাবে রাতের বেলায় শহরে জনসংখ্যার উপস্থিতি, কলকারখানার কার্যক্রম ও অতিরিক্ত মনুষ্য কর্মকাণ্ডের ফলে চট্টগ্রামে রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে।’

বেশি গরম বাকলিয়া-মাদারবাড়ীতে চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম শহরে সবচেয়ে বেশি গরম অনুভূত হয় বাকলিয়া ও মাদারবাড়ী এলাকায়। গবেষণার সময়ে এ দুই এলাকায় তাপমাত্রা ছিল ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। গ্রামের তুলনায় চট্টগ্রাম শহরের এই অংশের তাপমাত্রার পার্থক্য ৬ থেকে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

এছাড়া নগরের আগ্রাবাদ, কোতোয়ালি, চট্টগ্রাম বন্দর, কাট্টলি, লালখান বাজার ও পাঁচলাইশ এলাকায় গ্রামের তুলনায় ৪ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেশি।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রায় ৭ দশমিক ৬১ শতাংশ অঞ্চল উচ্চ তাপপ্রবাহের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। এছাড়া উচ্চ এবং মাঝারি শ্রেণির ঝুঁকিতে রয়েছে যথাক্রমে ২৬ দশমিক ৪০ ও ২৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ এলাকা। দিনে চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে গ্রামের সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রার পার্থক্য হয় সেপ্টেম্বর মাসে। এছাড়া জানুয়ারি মাসে রাতে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রার পার্থক্য দেখা যায়।

গবেষণা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রায় ৭ দশমিক ৬১ শতাংশ অঞ্চল উচ্চ তাপপ্রবাহের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। এছাড়া উচ্চ এবং মাঝারি শ্রেণির ঝুঁকিতে রয়েছে যথাক্রমে ২৬ দশমিক ৪০ ও ২৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ এলাকা।

গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে গ্রামের সবচেয়ে বেশি (৩ দশমিক ১৪ ডিগ্রি) তাপমাত্রার পার্থক্য হয় সেপ্টেম্বর মাসে। এছাড়া জানুয়ারি মাসে রাতে সবচেয়ে বেশি (২ দশমিক ৪০ ডিগ্রি) তাপমাত্রার পার্থক্য দেখা যায়।

এ বিষয়ে অধ্যাপক আশরাফ দেওয়ান বলেন, ‘চট্টগ্রামে তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি দায় মানুষের। উপকূলবর্তী এই শহরের সবুজ সব পাহাড় ছিল রক্ষাকবচ, গত দুই দশকে যা নির্মমভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে বৃষ্টি যেমন কমেছে, তেমনই জলাধার ভরাটের মাধ্যমে সারফেস ওয়াটারের ক্ষেত্রগুলোও ধ্বংস করা হয়েছে।’

এএজেড/কেএসআর/এমএস