চলমান তীব্র তাপপ্রবাহে জনজীবনের পাশাপাশি বিপর্যস্ত প্রাণীকুল। গরমে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি। পাশাপাশি ওজন কমছে কোরবানির জন্য তৈরি হওয়া পশুর। উৎপাদন কমছে দুধের। কোরবানি ঈদের আগে নতুন এ সংকটে চিন্তার ভাঁজ খামারিদের কপালে।
Advertisement
চলতি মাসে দেশে এক কোটি ৩০ লাখ গবাদিপশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত হচ্ছে বলে জানিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। এ অবস্থায় তীব্র তাপপ্রবাহে সারা দেশে প্রায় দুই হাজার গবাদিপশু মারা গেছে। কোরবানিযোগ্য গরুগুলো ওজন হারাচ্ছে গড়ে ৩০ থেকে ৭০ কেজি। এছাড়া ২০ থেকে ২৫ শতাংশ হারে কমেছে দুধের উৎপাদন।
তীব্র গরমে গরু বাঁচাতে খামারিদের খরচও বেড়েছে শতকরা ৩০ শতাংশ। খামারে অতিরিক্ত শ্রমিক ও গরমজনিত প্রতিক্রিয়া রোধে বেড়েছে ব্যয়। যে কারণে কোরবানিতে লোকসানের আশঙ্কা করছেন অনেকে। আবার এমন দুঃসহ পরিস্থিতির কারণে কোরবানির সময় বাজারে গরুর সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ।
তৌহিদ পারভেজ বিপ্লব বগুড়া কাহালু উপজেলায় দরগাহাট এলাকায় ১৪০টি গরু লালনপালন করছেন তার খামারে। এর মধ্যে ১২০টি কোরবানিযোগ্য। সোমবার (২৯ এপ্রিল) জাগো নিউজের কথা হয় তার সঙ্গে। এখন পর্যন্ত তার খামারে কোনো গরু মারা যায়নি। তবে ওইদিন কাহালু উপজেলায় মারা যায় ৯টি গরু। বিপ্লবের পরিচিত গাইবান্ধার একটি খামারে একই দিনে ৭টি গরু মারা যাওয়ার খবরও দেন তিনি।
Advertisement
বিপ্লব বলেন, ‘নিজের গরু নিয়ে আতঙ্কে আছি। খামারের প্রতিটি বড় গরুকে দুবারের জায়গায় সাতবার গোসল করাচ্ছি। প্রতিদিন ভিটামিন ‘সি’ জাতীয় নানা খাদ্য ও নিয়মিত স্যালাইন দিচ্ছি। প্রচুর খরচ করে ভালো রাখার চেষ্টা চলছে। তারপরেও গরু গরমে বিরক্ত হচ্ছে। স্বাভাবিক খাবার খাচ্ছে না। যেখানে এখন ওজন বাড়ার কথা সেখানে কমছে।’
আরও পড়ুনপ্রতিদিন মরছে ১ লাখ মুরগি, ক্ষতি ২০ কোটি টাকাবড় হচ্ছে ভুট্টার বাজার, কমছে আমদানিনির্ভরতাতীব্র তাপপ্রবাহে ধানের জমিতে পর্যাপ্ত পানি ধরে রাখতে হবেদাম বেঁধে দিয়েই দায় শেষ, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘ভাতঘুমে’জানতে চাইলে বিপ্লব বলেন, ‘আমার প্রতিটি গরুতে প্রতিদিন গড়ে ৭শ টাকা খরচ হয়, সেখানে এখন গরমের কারণে এক হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। কোরবানির আগে এভাবে খরচ বাড়লে কীভাবে সম্ভব। লোকসানের আশঙ্কা করছি।’
নিজের গরু নিয়ে আতঙ্কে আছি। খামারের প্রতিটি বড় গরুকে দুবারের জায়গায় সাতবার গোসল করাচ্ছি। প্রতিদিন ভিটামিন ‘সি’ জাতীয় নানান খাদ্য ও নিয়মিত স্যালাইন দিচ্ছি। প্রচুর খরচ করে ভালো রাখার চেষ্টা চলছে। তারপরেও স্বাভাবিক খাবার খাচ্ছে না। যেখানে এখন ওজন বাড়ার কথা সেখানে কমছে।
দেশের কোরবানির গরুর একটি বড় জোগান আসে পাবনা জেলা থেকে। সেখানে বেড়া উপজেলার চর সাঁড়াশিয়া, হাটুরিয়া, নাকালিয়া গ্রামে বেশকিছু খামারির সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। তারা জানান, গত ১৫ দিনে এসব এলাকায় প্রায় ছয় থেকে সাতশ গরু-ছাগল অজানা রোগে আক্রান্ত হয়েছে। গরুর শরীরে প্রথমে জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট ও কাঁপুনি দেখা দেওয়ার পর খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়ে এক পর্যায়ে দুর্বল হয়ে মারা যাচ্ছে। অনেক খামারি গরু-ছাগল আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কিত হয়ে স্থানীয় হাটবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন।
Advertisement
চর সাঁড়াশিয়ার খামারি জব্বার মিয়া বলেন, ‘জ্বর হয়ে গরু চোখের সামনে মরে গেছে। কী রোগ বা কী হলো বুঝতে পারলাম না। উপজেলা কর্মকর্তারা এসে কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু বাঁচানো যায়নি।’
আরও কয়েকজন খামারি জানান, মাংসের গরুর পাশাপাশি যারা দুধের গরু পালছেন তাদের দুধের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অনেক খামারির গাভির হঠাৎ গর্ভপাত হয়ে যাচ্ছে।
দেশের এমন ৫৫ হাজারের বেশি খামারি বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সদস্য। বিডিএফএ সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এবছর কোরবানির জন্য আমাদের ভালো প্রস্তুতি ছিল। আশা ছিল গত বছরের চেয়ে কম দামে এবার কোরবানির গরু বিক্রি করা যাবে। কিন্তু এ গরমে আমরা বিপর্যয়ে পড়েছি।’
এখন যেখানে বড় গরুর প্রতিদিন এক-দেড় কেজি ওজন বাড়ার কথা সেখানে কমছে। খরচও প্রচুর বাড়ছে। শ্রমিকরা ঘাস কাটতে মাঠেও যেতে পারছে না, গেলে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। সবকিছু মিলে সবাই খুব সমস্যায় আছি
তিনি বলেন, ‘খামারিরা যে উন্নত জাতের গরুগুলো লালনপালন করছে, এগুলো শীতের দেশের। এ উচ্চ তাপমাত্রা এসব গরু সহ্য করতে পারছে না। কোনোভাবে সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। যে কারণে খামারিরা এমন কষ্ট ও লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে।’
ইমরান হোসেন বলেন, ‘গরমে এসব গরু সুস্থ রাখতে আমাদের অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। এখন যেখানে বড় গরুর প্রতিদিন এক-দেড় কেজি ওজন বাড়ার কথা সেখানে কমছে। খরচও প্রচুর বাড়ছে। শ্রমিকরা ঘাস কাটতে মাঠেও যেতে পারছে না, গেলে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। সবকিছু মিলে সবাই খুব সমস্যায় আছি।’
এমন পরিস্থিতিতে আসন্ন কোরবানির ঈদে গরুর দাম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এবার ঈদে আমাদের গত বছরের চেয়ে ৫ শতাংশ কম দামে পশু বিক্রির টার্গেট ছিল। কিন্তু এখন সেটা ফুলফিল হবে না। কারণ সবার খরচ বেড়ে গেছে, সেটা দামে প্রভাব ফেলবে। তবে গরু পর্যাপ্ত থাকবে। সেটার কোনো সমস্যা হবে না বলে আশা করছি।’
এসব বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (সম্প্রসারণ) ডা. মো. শাহিনুর আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘গরমে পশুর সুরক্ষার জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে। নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খুলে সারাদেশের মাঠ পর্যায়ের অফিসগুলোকে সতর্ক করে দিয়েছি। গরমের শুরুতে এলাকাভিত্তিক প্রাণিসম্পদের আবহাওয়া সতর্কতা ও পরামর্শ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে সব কর্মকর্তা কাজ করছে।’
ঈদুল আজহার জন্য দেশে কোরবানিযোগ্য এক কোটি ৩০ লাখ গবাদিপশু মজুত রয়েছে, যা গতবারের চেয়ে পাঁচ লাখ বেশি। গত বছর এক কোটি ২৫ লাখ গবাদিপশু কোরবানির বাজারে ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অবিক্রীত ছিল ১৯ লাখ।
এনএইচ/এএসএ/জেআইএম