‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার না হয়েও সহযোগীদের নিয়ে আশ্রমে আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তিদের চিকিৎসা দিতেন। আশ্রমের খাবারের মান বজায় না রেখে অসহায় ব্যক্তিদের ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিয়েছেন। তার আশ্রমে কেউ মারা গেলে নিজেই চিকিৎসক সেজে মৃত্যুসনদ ইস্যু করতেন। গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি প্রায় ৫০ জনের মৃত্যুসনদ তৈরি করে আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের দিয়েছেন।
Advertisement
‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ আশ্রমের মৃত ব্যক্তিদের জাল মৃত্যুসনদ দেওয়ার অভিযোগে করা মামলায় এমনই উল্লেখ করেছেন মামলার বাদী মিরপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ কামাল পাশা।
প্রতারণার অভিযোগে বৃহস্পতিবার (২ মে) মিরপুর মডেল থানায় এ মামলা করা হয়। মামলায় কিশোর বালা নামে আরও একজনকে আসামি করা হয়। তিনি মিল্টনের সহযোগী। এর আগে বুধবার (১ মে) রাতে রাজধানীর মিরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে মিল্টন সমাদ্দারকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।
মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে মানবপাচার, অবৈধভাবে মরদেহ দাফন, টর্চার সেল, আয়ের উৎসসহ বেশকিছু অভিযোগ রয়েছে। সবচেয়ে বড় অভিযোগ, ৯০০ মরদেহের ৮৩৫টির ডকুমেন্ট দেখাতে পারেননি মিল্টন। এসব অভিযোগে বুধ ও বৃহস্পতিবার মিল্টনের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়েছে।
Advertisement
এর মধ্যে জাল মৃত্যুসনদ দেওয়ার মামলায় আজই মিল্টনকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে পুলিশ। এসময় তাকে আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। এরপর মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাকে সাতদিনের রিমান্ডের আবেদন করেন এসআই কামাল পাশা। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ বিষয় শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
শুনানি শেষে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন তার তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
মিল্টন সমাদ্দারের আশ্রয়কেন্দ্র ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’
আসামি মিল্টন সমাদ্দার দীর্ঘদিন ধরে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে ৫০টি মৃত্যুসনদ দিয়েছেন। তিনি চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার নামে প্রতিষ্ঠান খুলে সেবার নামে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি, শিশু এবং প্রতিবন্ধীদের মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিয়েছেন। মৃত সংক্রান্ত সঠিক তথ্য উদঘাটনে ও সেবার নামে আসামির অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না তা তদন্তে রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ।
Advertisement
আদালতে মিল্টন বলেন, ‘অসহায়দের অসহায় ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করার বিষয়ে ২০১৬ সালে সমাজকল্যাণে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করি। সমাজকল্যাণ থেকে প্রথমে আবেদন গ্রহণ করেনি। আমার এখানে ১৩৫ জন মারা গেছেন। তাদের ডেথ সার্টিফিকেট আছে। কবরস্থানের জন্য হাইকোর্টসহ অনেকের কাছে গিয়েছি। কেউ জায়গা দেয়নি, কী করবো। কেউ মরদেহ দাফনের দায়িত্ব নেয়নি। এখনো ২৫৬ জন অসহায় ব্যক্তি আমার আশ্রমে আছেন। বিভিন্ন মানুষের সহায়তায় চলে তাদের জীবন।’
অর্থ উপার্জনের জন্য প্রতারণামূলকভাবে ক্রিয়েটিভ কনটেন্ট তৈরি করতেন মিল্টনমামলার এজাহারে বলা হয়, মানবতার ফেরিওয়ালার অত্যাচার ও মারামারির সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য মামলার বাদী সঙ্গীয় ফোর্সসহ মিরপুরে ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারে’ হাজির হলে আসামি মিল্টন সমাদ্দার পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। এসময় তাকে আটক করা হয়।
পরে জিজ্ঞাসাবাদে মিল্টন সমাদ্দার জানান, তিনি নিবন্ধিত চিকিৎসক নন এবং তার প্রতিষ্ঠানে নিবন্ধিত কোনো চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। নিজে চিকিৎসক সেজে অপর আসামি কিশোর বালার সঙ্গে যোগসাজশে বিভিন্ন চিকিৎসা দিতেন। ক্রিয়েটিভ কনটেন্ট তৈরি করে ফেসবুক, হোয়াটসআপ ও ইমোর মাধ্যমে বিপুল অর্থ উপার্জন করতেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিল্টন সমাদ্দারের এক কোটি ২০ লাখ ফলোয়ার আছে। এসব ফলোয়ার তার ইনকামের কৌশল।
অভিযানে মিল্টনের টেবিলে তার প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কাগজপত্র ও ডেথ সার্টিফিকেট, দুটি স্ট্যাম্প সিল পাওয়া যার। যায় একটিতে ইংরেজিতে এমডি মহিদ খান (Md Mohid Khan), অন্যটিতে বাংলায় মিল্টন সমাদ্দারের নাম লেখা।
আরও পড়ুনমিল্টনকে রিমান্ডে নিয়ে সব অপকর্ম বের করবো: হারুনমিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে পুলিশি ব্যবস্থা চায় মানবাধিকার কমিশনজিজ্ঞাসাবাদে মিল্টন জানান, নিজে চিকিৎসক সেজে আশ্রমের অসুস্থ রোগীদের নিজেই মৃত্যু ঘোষণা করতেন এবং মৃত ব্যক্তিদের স্বজনদের মৃত্যুসনদ দিতেন। এসব কাজে তিনি ভুয়া সই ও সিল ব্যবহার করতেন।
মৃত্যুর সঠিক কারণ উদঘাটন হয়নিমামলার এজাহারে আরও বলা হয়, প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, আসামি মিল্টন সমাদ্দার দীর্ঘদিন ধরে মানবতার সেবা ও চিকিৎসার নামে বিভিন্ন বয়স্ক এবং শিশুকে নিয়ে শারীরিক, মানসিক আঘাত করে, কখনো কখনো তাদের সুচিকিৎসার নাম করে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে বিক্রি করেন মর্মে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় ফলাওভাবে প্রচার হয়েছে। আসামি একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না হয়েও সেবার নামে অজ্ঞাতনামা, ওয়ারিশবিহীন ব্যক্তিদের নিয়ে চিকিৎসা না দিয়ে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিয়েছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ৫০ জনের নামে মৃত্যুসনদ দিয়েছেন। যাদের মৃত্যুর সঠিক কারণ উদঘাটন হয়নি।
মিল্টন সমাদ্দারের আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বের হচ্ছেন এক র্যাব সদস্য
আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তিদের ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিতেন মিল্টনপুলিশ রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারে’ চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান খুলে মানবতার ফেরিওয়ালা পরিচয় দিয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি, শিশু এবং প্রতিবন্ধীদের নিয়ে চিকিৎসাসেবার দেওয়ার নামে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিতেন। যার কারণে মৃত ব্যক্তিদের সঠিক তথ্য উদঘাটন করা যাচ্ছে না। চিকিৎসাসেবার নামে কোনো কোনো ভিকটিমের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করেছেন কি না সেই তথ্য সংগ্রহ নেই।
বৃদ্ধকে আশ্রমে খুঁজতে গেলে মারধর করে মিল্টন সমাদ্দারমো. মতিউর রহমান মল্লিক (৪২) নামে এক ব্যক্তি মারধরের অভিযোগে মিরপুর মডেল থানায় মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে মামলা করেন। তার অভিযোগে বলা হয়, তিনি ২০২১ সালের ৩ মার্চ রাতে তার বান্ধবী আসমা আক্তার আয়শার (মৃত) মাধ্যমে জানতে পারেন মিরপুর-১ দক্ষিণ বিছিলের রাস্তায় অন্ধ এক বৃদ্ধ লোক পড়ে আছেন। পরে তিনি দারুস সালাম থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে বৃদ্ধের সুচিকিৎসা ও দেখভালের জন্য মিল্টন সমাদ্দারের আশ্রমে নিয়ে যান। এরপর বেশ কয়েকবার মিল্টন সমাদ্দারের আশ্রমে গেলে ওই বৃদ্ধকে আর পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিল্টন সমাদ্দারসহ বেশ কয়েকজন লোক বাদীকে মারধর করেন এবং প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন মিডিয়া মিল্টন সমাদ্দারকে নিয়ে নানা ইস্যুতে সোচ্চার হলে মিরপুর মডেল থানায় তিনি মামলা করেন।
আরও পড়ুনমিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে অজস্র অভিযোগ: হারুনআদালতে মিল্টন সমাদ্দার, সাত দিনের রিমান্ডে নিতে চায় ডিবিদশ হাজার টাকা দিয়ে একটি শিশুকে মিল্টনের আশ্রমে ভর্তি করা হয়, খবর নিতে গেলে হুমকিমানবপাচারের অভিযাগে বুধবার (১ মে) রাতে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে হাজারীবাগ থানায় প্রথম মামলাটি করেন ধানমন্ডির বাসিন্দা এম রাকিব (৩৫)।
মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ২০২০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তিনি শেরে বাংলানগর থানাধীন ধানমন্ডি বয়েজ স্কুলের সামনে দুই বছরের এক শিশুকে পড়ে থাকতে দেখেন। এরপর তিনি থানায় ফোন করেন। কিন্তু থানা পুলিশ কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তিনি চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারে ফোন করলে মিল্টন সমাদ্দার ওই শিশুকে নিয়ে যান। তখন বাদী নিজেও তাদের সঙ্গে যান। মিল্টন সমাদ্দার তাকে (বাদী) অজ্ঞাতনামা শিশুর অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করেন। পরে মিল্টন সমাদ্দারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে শিশুটিকে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারে ভর্তি করা হয়। এরপর মিল্টন সমাদ্দার জানান, আদালতের মাধ্যমে শিশুটিকে দত্তক নেওয়া যাবে।
এভাবে কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর হঠাৎ একদিন ফোন করে মিল্টন সমাদ্দার আমাকে গালিগালাজ করেন এবং বলেন আমি যেন তার প্রতিষ্ঠানে আর না যাই, শিশুটির খোঁজ-খবর না নিই। এরপর আরও বেশ কয়েকজন ফোন করে আমাকে হুমকি দেন ও ভয়ভীতি দেখান। প্রাণভয়ে আমি আর সেখানে যাইনি। সম্প্রতি একটি খবর চোখে আসার পর গত ২৪ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিশুটিনে পাওয়া যায়নি। শিশুটি কোথায় আছে, সে ব্যাপারেও সদুত্তর মেলেনি। বাদীর অভিযোগ, শিশুটিকে পাচার করা হয়েছে।
জেএ/এমএএইচ/জেআইএম