দেশজুড়ে

নকশি হাতপাখায় তিন গ্রামের মানুষের জীবন বদল

সারাদেশে তীব্র দাবদাহে বিপর্যস্ত জনজীবন। এর মধ্যে হচ্ছে বার বার লোডশেডিং। এমন সময় সাধারণ মানুষ স্বস্তি পেতে হাত বাড়াচ্ছে হাতপাখার দিকে। হাতপাখার শীতল বাতাস ক্লান্ত শরীরে এনে দেয় প্রশান্তি। বাঙালির জীবনে হাতপাখা তৈরি ও ব্যবহার হাজার বছরের। এখনো গ্রাম থেকে শুরু করে শহরের প্রতিটি বাড়িতেই দেখা মেলে নানা কারুকাজ আর রঙ-বেরঙের হাতপাখার ব্যবহার।

Advertisement

ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার বলদী, মুখী ও দীঘা গ্রামকে এখন অনেকেই চেনেন হাতপাখার গ্রাম নামে। হাতপাখা তৈরি করে বদলে গেছে ওইসব গ্রামের মানুষের জীবন। নকশি হাতপাখা তৈরি ও বিক্রি করে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনে এসেছে স্বচ্ছলতা।

জানা যায়, এই গ্রামগুলোতে নকশি হাতপাখা তৈরির কাজ শুরু হয় প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ বছর আগে জামু নামে এক নারীর মাধ্যমে। এখন সেখানে হাতপাখা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন কয়েক হাজার পরিবার। এই গ্রামগুলোতে প্রতি সপ্তাহে লাখ খানেক হাতপাখা তৈরি হয়। নানা নকশায় শোভিত এসব হাতপাখাকে বলা হয় নকশি হাতপাখা। নকশি হাতপাখা তৈরিতে লাগে বাঁশের চাক, কাপড়, সুই সুতা, ঝালট ও হাতল।

প্রতিটি হাতপাখা তৈরিতে ৫ জন কাজ করেন। প্রথম জন বাঁশের চাক তৈরি করেন, দ্বিতীয় জন ফুল তোলা বা প্রিন্ট করেন, তৃতীয় জন মুড়ি লাগান, চতুর্থ জন ঝালট লাগান এবং পঞ্চম জন হাতল লাগান। এখানকার পাখা কাপড় ও বাঁশ দিয়ে তৈরি হয়। পরিবেশ বান্ধব ও দামে সস্তা হওয়ায় বাজারে এর চাহিদাও অনেক বেশি।

Advertisement

বাঁশ কেটে পাখার চাক ও হাতল বানিয়ে দেন পুরুষরা। এরপর অন্য কাজ করেন নারীরা। সংসার সামলে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০টি পাখা বুনন করতে পারেন একেকজন নারী। বুনন শেষে তারা প্রতিটি হাতপাখা ৩০ থেকে ৩৫ টাকায় পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন। পাইকাররা তাদের কাছ থেকে কিনে আবার ঝালট ও হাতল লাগিয়ে বাজারে প্রতিটি পাখা বিক্রি করেন ৫০ থেকে ৭০ টাকায়।

উপজেলার মশাখালী ইউনিয়নের বলদি গ্রাম, মুখী গ্রাম ও রাওনা ইউনিয়নের দীঘা গ্রামের ঘরে ঘরে তৈরি এই হাতপাখা শিল্পের সঙ্গে জড়িত কয়েক হাজার নারী কেবল পরিবারের স্বচ্ছলতাই আনছেন না, অনেকে হয়েছেন স্বাবলম্বী। অনেক পরিবারের স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া মেয়েরা বাড়তি আয়ের উৎস তৈরি করছে এই হাতপাখায়।

গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ বাড়ির উঠানে নারীরা বসে সুইয়ের ফোঁড়ে বাহারি সুতায় হাতপাখার জমিনে ফুটিয়ে তুলছেন নকশা খচিত ফুল, পাখি, লাভ, কদম ফুল, তিনতারা, ডালিম, মানুষের নামের ইংরেজি অক্ষর ও প্রাকৃতিক দৃশ্য। নারী-পুরুষ মিলে হাতপাখার কাজ করে আর্থিক উন্নয়ন হচ্ছে গ্রামের বাসিন্দাদের। নকশি হাতপাখার কাজ করেই কেউ কিনেছেন জমিজমা, কেউ করেছেন পাকা বাড়ি কিংবা ছেলেকে পাঠিয়েছেন বিদেশে।

দেশের নানা প্রান্ত থেকে পাইকার এসে এই তিন গ্রাম থেকে হাতপাখা কিনে নিয়ে যান। পরে ফেরি করে হাতপাখা বিক্রি করেন দেশের নানা জায়গায়। আবার এই হাতপাখা যাচ্ছে পাশের দেশ ভারতেও। বিশেষ করে ট্রেন, বাস ও লঞ্চে গরমের সময় হাতপাখার কদর অনেক বেশি। দামও তুলনামূলক অনেক সস্তা।

Advertisement

রাওনা ইউনিয়নের দীঘা গ্রামের গৃহবধূ কুসুম আক্তার বলেন, আমি প্রায় ৩০ বছর ধরে হাতপাখা তৈরি করি। হাতপাখা বিক্রির টাকা সংসারের কাজ লাগাই। ছেলে মেয়ের হাতখরচ দিই। এর ফলে স্বামীর কাছে হাত পাততে হয় না। আমাদেরকে যদি সরকার একটু সহযোগিতা করতো এবং সহজ শর্তে ঋণ দিতো তাহলে আমাদের আরও ভালো হতো।

দিঘা গ্রামের স্কুল শিক্ষার্থী মিম বলেন, আমি লেখাপড়ার পাশাপাশি অবসর সময়ে দাদু ও মায়ের কাছ থেকে শিখে হাতপাখা তৈরি করি। এতে আমার লেখাপড়ার খরচ নিজেই মেটাতে পারছি।

একই এলাকার রীনা বেগম বলেন, সংসারের কাজকর্ম শেষে যে সময়টুকু পাই তা থেকে হাতপাখা বানাই। দৈনিক ১০ থেকে ১২টি হাতপাখা বানাতে পারি। এতে যে টাকা আয় হয় সেটা দিয়ে নিজের বিভিন্ন খরচ ও সংসারের বিভিন্ন কাজে লাগে। স্বামীর কাছে হাত পাততে হয় না। উল্টো আমরা প্রয়োজনে টাকা দেই।

হাতপাখার বিক্রেতা আজিজুল হক বলেন, আমি ১৫ থেকে ২০ জন লোক দিয়ে হাতপাখা তৈরি করাই। পরে পাইকারি ও খুচরা হাতপাখা বিক্রি করি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পাইকারদের কাছে পাখা বিক্রি করে থাকি। আমাদের এলাকার হাতপাখা দেশের চাহিদা মিটিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও রপ্তানি করা হচ্ছে।

হাতপাখা বিক্রেতা শমসের আলী আকন্দ বলেন, আমি ২৬ থেকে ২৭ বছর ধরে এই হাতপাখার ব্যবসা করি। দেশের বিভিন্ন স্থানে হাতপাখা নিয়ে যাই। হাতপাখার ব্যবসা করে আমি জায়গা-জমিসহ অনেক কিছু করেছি।

গফরগাঁও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুবাইয়া ইয়াসমিন বলেন, ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়ার মতো অনেক প্রতিষ্ঠান এখন গ্রামে আছে। সেখানে আবেদন করলে ক্ষুদ্র ঋণ পাবে। তাছাড়া তাদের জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু করার সুযোগ নেই।

এফএ/এএসএম