দেশজুড়ে

গরমেও থেমে নেই শ্রমজীবী মানুষ

সারাদেশের মতো বগুড়াতেও তীব্র গরমে শ্রমজীবী মানুষের কষ্টের মাত্রা বেড়েছে কয়েকগুণ। জীবন-জীবিকার তাগিদে কড়া রোদ উপেক্ষা করেই দৈনন্দিন কাজে বের হতে হচ্ছে তাদের। এ অবস্থায় পালিত হয়েছে শ্রমিক দিবস। দিবসটি উপলক্ষে বন্ধ ছিল সরকারি-বেসরকারি কলকারখানা।

Advertisement

বুধবার (১ মে) বগুড়ার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অফিস বলেছে, কয়েকদিন ধরে দিনের তাপমাত্রা ৩৮-৪১ ডিগ্রির মধ্যে বিরাজ করছে। এমনকি বৃষ্টির সম্ভবনাও খুবই কম।

চলমান এ তাপপ্রবাহে নাকাল হচ্ছেন শ্রমিকরা, খেটে খাওয়া দিনমজুর ও নিম্নআয়ের মানুষ। অসহ্য গরমে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সড়কে মানুষের উপস্থিতিও থাকছে কম। অনেকে পূর্ণ সময়ের বদলে ঘণ্টা চুক্তিতে কাজ করছেন।

সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। কারণ ধানের জমিতে অতিরিক্ত গরম থাকায় শ্রমিকরা কাজে যেতে চাচ্ছেন না। গত ২৪ এপ্রিল বগুড়ার শেরপুরের সুঘাটে ফসলি জমিতে কাজ করার সময় আব্দুস সালমান নামের এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে।

Advertisement

সদরের পল্লী মঙ্গল এলাকায় ধান কাটার কাজ করছিলেন শ্রমিক আসাফুদৌল্লা। তিনি বলেন, ‘৩৫ বছরের জীবনে কখনো এতো গরম দেখিনি। কাজের সময় গায়ে মনে হচ্ছে আগুনের উল্কা এসে পড়ছে।’

তিনি বলেন, ‘ধান কাটার জন্য দিনে ৫০০-৬০০ টাকা পাই। আয়তো আগের মতোই আছে। তবে সময়ের সঙ্গে সংসারের ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ। এখন গরম যতই বেশি হোক, ঘরে বসে থাকার উপায় নেই। পরিবার চালানোর জন্য প্রতিদিনই কাজ করতেই হবে।’

কাঠফাটা রোদে নামাজগড়ে কাজ পাওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন দিনমজুর শফিকুল ইসলাম। সঙ্গে ছিল টুকরি-কোদাল। তিনি জানান, এ জায়গায় শত শত দিনমজুর কাজের সন্ধানে ভোর থেকেই অপেক্ষা করেন। কিন্তু গত ৭-৮ দিন ধরে অনেকেই আসছেন না।

একটি আবাসন ও নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সোহেল আলী বলেন, আগে সড়কের পাশে দিনমজুর পাওয়া যেতো। তীব্র গরমে এখন তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে গ্রামের বাড়ি চলে গেছে।

Advertisement

চারমাথা এলাকায় নওগাঁ-বগুড়া আঞ্চলিক সড়কের বাসচালক সৈকত মণ্ডল বলেন, ‘গরমের কারণে মানুষ বাসা থেকে কম বের হচ্ছে। যে কারণে বেশিরভাগ বাসেই যাত্রী সংখ্যা হাতেগোনা। শুধু সকালের দিকে কিছু যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে।’

শহরের নির্মাণাধীন ফতেহ আলী ব্রিজে কাজ করছিলেন আব্দুল মালেক। তার বাড়ি সিরাজগঞ্জের চান্দাইকোনা এলাকায়। প্রায় ২২ বছরের কর্মজীবনের সবসময় কাজ করেছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অধীনে। সেতুর পিলারের রড বাঁধাইয়ের কাজ করেন। মাসে ১৮-১৯ হাজার টাকা আয় হয় তার।

এই শ্রমিকের ভাষ্য, ‘নির্মাণশ্রমিকদের রোদ-তাপ দেখে কাজ হয় না। জানের ভয় থাকলেও চলবে না। শুধু কষ্ট। সীমিত আয়ে সংসার চালানো দায় হয়েছে। ব্যয়ের সঙ্গে আয় চার আনাও বাড়েনি। এখন শেষ বয়সে এসে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’

শুধু মালেক নন, এ সেতুর নির্মাণের সঙ্গে জড়িত সব শ্রমিকদের সারাদিন কাজ করতে হয় রোদে পুড়ে। তাদের কাছে কাজ নেই তো আয়ও নেই। জীবন তাদের বাঁধা পড়ে গেছে কাজে।

বগুড়া শহরের উপশহরে ব্যক্তি মালিকানাধীন এক ভবনের কাজে নিয়োজিত অর্ণব আকন্দ। বেশ কিছুদিন হলো তাদের কাজের গতি কমে গেছে। কারণ শ্রমিক সংকট। অতিরিক্ত গরমে অনেকেই কাজ করার সাহস পাচ্ছে না।

তিনি বলেন, ‘রোদের এতো তাপ! শ্রমিকরা বাইরে কাজ করতেই পারছেন না। ঘরের ভেতরে হলে কাজ করছেন। তবে বাসাবাড়ির নির্মাণকাজে সুবিধা হলো চাইলে একটু ধীরে করা যায়। সেক্ষেত্রে দিন বেশি লাগে। তাতে অবশ্য আয়ের পরিমাণ কমে আসে। কিন্তু কোম্পানির কাজে চাইলে দেরি করা যায় না। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে হয়।’

এদিকে দুর্ঘটনায় হরহামেশাই বিপদে পড়ছেন নির্মাণশ্রমিকরা। বগুড়া জেলা গৃহনির্মাণ শ্রমিক পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় তাদের সদস্য সংখ্যা ৫৫ হাজার ২১ জন। প্রতিবছর অন্তত ২০ জন করে আহত হন। সংগঠনটির কাছে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পরিসংখ্যান না থাকলেও গত তিন বছরে ২৮ জন শ্রমিকের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়।

গত ২৩ এপ্রিল শহরের আটাপাড়ায় একটি ভবন নির্মাণের সময় বিদ্যুতায়িত হয়ে শফিকুল ইসলাম নামের এক রাজমিস্ত্রি মারা গেছেন। এ শ্রমিকের বাড়ি সদরের গোপালবাড়ি এলাকায়।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্মাণশ্রমিকরা বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যান বলে জানান বগুড়া জেলা গৃহ নির্মাণ শ্রমিক পরিষদের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক শাহজাহান আলী। তিনি বলেন, সদস্য কেউ মারা গেলে পরিবারের পক্ষ থেকে সংগঠনের পক্ষ থেকে কিছু অনুদান দেওয়া হয়। এর বাইরে আর তেমন কিছু পায় না শ্রমিকের পরিবার। মূলত আমাদের নীতিমালাগুলোর বাস্তবায়ন না থাকায় শ্রম অধিকার বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

বেসরকারি সংস্থা সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটির (এসআরএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সারাদেশে ৭১২টি দুর্ঘটনায় মোট ৮৩৯ জন শ্রমিক মারা গেছেন। এরমধ্যে নির্মাণখাতে নিহতের সংখ্যা ১৭৩।

সংস্থাটির পরিসংখ্যান বলছে, আগের বছর ২০২২ সালে কর্মক্ষেত্রে ৫৪৭টি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ৭১২ শ্রমিকের। আর ২০২১ সালে নিহতের সংখ্যা ছিল ৫৩৮।

২০০৮ সালে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টসহ (ব্লাস্ট) আরও কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা নির্মাণশ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা বাস্তবায়ন করতে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করে। তাতে উচ্চ আদালত এক বছরের মধ্যে বিধিমালা প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ গঠনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকারি কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। যে কারণে ২০১৩ সালে আদালত অবমাননার আবেদনও হয়েছিল সরকারি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।

অন্যদিকে, বুধবার বগুড়ায় নানা আয়োজনের মধ্যে দিয়ে মহান মে দিবস পালিত হয়েছে। সকাল ১০টায় জেলা প্রশাসক কার্যালয় চত্বরের বটতলা থেকে র্যালি বের হয়। শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে জেলা পরিষদ মিলনায়তনে আলোচনা মহান মে দিবসের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলামের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন বগুড়া-৬ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান রিপু। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ডা. মকবুল হোসেন।

দিবসটি উপলক্ষে দিনব্যাপী জেলা শ্রমিক লীগ, গৃহনির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন, মোটর শ্রমিক ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংগঠন র্যালি ও আলোচনা সভার আয়োজন করে।

এসআর/জিকেএস