বিশ্বব্যাপী শ্রমিক অধিকারের দিন হিসেবে মে দিবস পালন করা হয়। দিবসকেন্দ্রিক আনুষ্ঠানিকতায় যতটা জোরেশোরে শ্রমিক অধিকারের কথা উচ্চারিত হয়, বাস্তবের সঙ্গে তার বিস্তর ব্যবধান। বাস্তবতা হচ্ছে, শ্রমিকদের বঞ্চনার ইতিহাস নতুন নয়। দেশে দেশে, কালে কালে নানাভাবে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষ। রাতদিন পরিশ্রম করেও তারা ঠিকমতো মজুরি পায় না। তার ওপর বেতন বকেয়া থাকা, কথায় কথায় শ্রমিক ছাঁটাই, লকআউট- এসব কারণেও শ্রমিকদের দুর্দশার সীমা থাকে না।
Advertisement
সভ্যতার চাকা এগিয়েছে শ্রমদানকারী শক্তির শ্রম, ঘাম আর রক্তের ওপর দিয়ে। এ প্রেক্ষাপটে একজন শ্রমিক অবশ্যই মূল্যায়িত হবে তার অবস্থান থেকেই। কিন্তু শ্রমিকের ইতিহাস বঞ্চনার ইতিহাস। শ্রমের মূল্য দিতে বরাবরই কার্পণ্য করে মালিক। অথচ শ্রমিকের ঘামে-শ্রমেই ঘুরে কলকারখানার চাকা, ওঠে ইমারত, বাড়ে উৎপাদন। বাংলাদেশে শ্রমিক অধিকারের ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হলেও এখনো রয়ে গেছে নানা অপ্রাপ্তি ও বঞ্চনা।
কলকারখানাগুলোতে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত নয়। যখন তখন চাকরিচ্যুতি, ন্যায্য মজুরি না পাওয়া, নারী-পুরুষ লিঙ্গভেদে মজুরির বৈষম্য, সঠিক কর্মপরিবেশ না থাকা, শ্রমিকনিরাপত্তার অভাবসহ রয়ে গেছে অনেক অসুবিধা। প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ শ্রমশক্তি দেশের শ্রমবাজারে যুক্ত হয়, তাদের মধ্যে সরকারি পর্যায়ে দুই থেকে আড়াই লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। বেসরকারি পর্যায়ে তিন থেকে চার লাখ। বাকিরা প্রায় বেকারই থেকে যায়। এ অবস্থায় সস্তায় শ্রমকেনার একটি প্রবণতা দেখা যায় মালিকদের মধ্যে। এতে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য পাওনাদি থেকে বঞ্চিত হয়।
কর্মস্থলের পরিবেশ নিয়েও রয়েছে অভিযোগ। অনেক ফ্যাক্টরির কাজের পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত নয়। ঝুঁকিমুক্ত নয়। ফলে কাজ করতে গিয়ে অনেককে জীবনও দিতে হয়। সঠিক অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা না থাকায় অনেক শ্রমিকের জীবন গেছে। তামাকজাত কারখানা, চামড়া, লবণ, জাহাজভাঙাসহ এজাতীয় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে স্বাস্থ্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগতে হয় শ্রমিকদের। কিন্তু তারা কোনো চিকিৎসা সুবিধা পায় না, মৃত্যু হলে ক্ষতিপূরণও পাওয়া যায় না। সার্বিকভাবে বাংলাদেশে শ্রমিকদের জীবন তাদের জন্য কল্যাণকর নয়— এটা বলা যায়। অনেক ক্ষেত্রে বেতন-ভাতা আদায়ের জন্য রাস্তায় নামতে হয় তাদের। কিন্তু সেখানেও নানা ঝক্কি। পুলিশের লাঠিপেটা, মালিকের চোখরাঙানি। চাকরিচ্যুতির ভয়। এ যেন অমোঘ নিয়তি।
Advertisement
বাংলাদেশে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে শিশুশ্রমিকরা। শিশুশ্রম আইনগতভাবে স্বীকৃত নয়। কিন্তু বিশ্বের কোনো দেশই শিশুশ্রমের বাইরে নয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এ সমস্যা আরো প্রকট। বাংলাদেশের শিশুদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই শিশুশ্রমে নিয়োজিত। মূলত দরিদ্র পরিবারে অর্থনৈতিক সহায়তার জন্যই এদের শ্রমে নিযুক্ত হতে হয়। আর এরা শুধু দিনান্ত পরিশ্রমই করে না, বরং তাদের এমন সব কাজ করতে হয়, যা তাদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
শিশুশ্রম অপেক্ষাকৃত সস্তা এবং সহজলভ্য হওয়ায় বাংলাদেশের শিশুশ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অপরাধমূলক ও অনৈতিক কাজের সঙ্গে তাদের যুক্ত করা হচ্ছে জোর করে। বলা হয়ে থাকে, আজকের শিশুই আগামী দিনের সম্পদ। অধিকারবঞ্চিত এসব শিশুকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে না পারলে দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন কি আদৌ সম্ভব? অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে গার্মেন্ট সেক্টর শিশুশ্রমমুক্ত করা গেছে। তাহলে অন্যান্য সেক্টর শিশুশ্রমমুক্ত করতে বাধা কোথায়? একদিকে স্কুলগামী শিশুদের এক বিরাট অংশ শিশুশ্রমে বাধ্য হচ্ছে, অন্যদিকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা। এই বৈপরীত্যের মানে কী?
বাংলাদেশে নারী শ্রমিকরাও বৈষম্যের শিকার। নারী পুরুষ সমতার বিশ্ব গড়ে ওঠার কথা থাকলেও শুধু নারী হওয়ার কারণে একই শ্রমের ক্ষেত্রে পুরুষ শ্রমিক ও নারী শ্রমিকের মজুরি পার্থক্য রয়ে গেছে। ধরা যাক, একজন পুরুষ শ্রমিক সারা দিন ইট ভাঙার কাজ করে তিন শ টাকা পান, এ ক্ষেত্রে নারী শ্রমিক পাবেন ২৫০ টাকা। এর কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই। তবু চলছে এটাই। আসলে নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে নারীর সমঅধিকার, সম্পদ ও ভূমিতে সমঅধিকার, কর্মসংস্থান, বাজার ও ব্যবসায় নারীর সমান সুযোগ ও অংশীদারত্ব এখনো নিশ্চিত হয়নি। বৈষম্য রয়েই যাচ্ছে।
বাংলাদেশে রপ্তানি খাতের সর্বোচ্চ স্থানে অবস্থানকারী গার্মেন্টশিল্প খাতের শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। অথচ বাংলাদেশের গার্মেন্ট কারখানাগুলোর অবকাঠামো, কর্মপরিবেশ, শ্রমিক নিরাপত্তা ও অধিকারের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে। কিন্তু গার্মেন্ট মালিকরা এসব বাস্তবায়ন না করায় একের পর এক ঘটছে দুর্ঘটনা। ঝুঁকিপূর্ণ কর্মপরিবেশ, অবহেলাজনিত কারণে সংঘটিত দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি না হওয়া, ক্ষতিপূরণ এবং আইনি দুর্বলতা ইত্যাদি কারণে প্রতিবছর নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কিন্তু তাদের পরিবার ক্ষতিপূরণও পাচ্ছে না। অথচ মারাত্মক প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার জন্য ১৯৫৫ সালের আইনে নিহত শ্রমিকের সারা জীবনের আয়ের সমপরিমাণ অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়ার বিধান রয়েছে।
Advertisement
শ্রমিকের অধিকার সংরক্ষণের জন্যই প্রতিবছর পালন করা হয় মে দিবস। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসেবে দিনটি ১৮৯০ সালের ১ মে থেকে পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় মে দিবস পালিত হয়ে আসছে। সভা-সেমিনারে উচ্চারিত হয়েছে অগ্নিউদ্গারী ভাষণ। কিন্তু আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এখনো পর্বতপ্রমাণ বেকার সমস্যা। শ্রমিকরা অধিকার থেকে বঞ্চিত। নানা রকম বৈষম্যেরও শিকার। সেখানে মে দিবস পালন কেবলই আনুষ্ঠানিকতালব্ধ আয়োজন হয়তো বা। মে দিবস নিয়ে যতটা তর্চন গর্জন হয় ততটা বর্ষণ হয় না। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধতাড়িত সমাজব্যবস্থা এই অন্ধকারে পথ দেখাতে পারে।
বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস জনশক্তি রপ্তানি। বিদেশের মাটিতে ঘাম-শ্রম ঝরিয়ে লাখ লাখ প্রবাসী এ দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখছে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, এসব শ্রমিকের অনেকেই বিদেশের মাটিতে গিয়ে নানা রকম প্রতারণার শিকার হন। যে বেতন দেওয়ার কথা, সেটি দেওয়া হয় না। যে কাজ করার কথা, তার চেয়ে নিম্নমানের কাজ দেওয়া হয়। এ ছাড়া থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও মানসম্মত হয় না। এসব কারণে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশিদের যেমন মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়, তেমনি তারা কাঙ্ক্ষিত অর্থ উপার্জন করতে না পারায় রেমিট্যান্স প্রবাহের ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এতে শুধু শ্রমিকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের অর্থনীতিও। দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যদি তাঁদের ওপর অর্পিত কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করতেন, তাহলে এ সমস্যার উদ্ভব হতো না।
লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশ গিয়ে তারা সামান্য আয় করলে নিজে চলবে কী আর দেশেই বা পাঠাবে কী। এ অবস্থায় শ্রমিকরা যাতে প্রতিশ্রæত বেতন পায়, সেটি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার কথা। অভিযোগের তীরটা সংশ্লিষ্ট দেশে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসের প্রতিও। বাংলাদেশি শ্রমিক অধ্যুষিত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বাংলাদেশ দূতাবাসের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে শ্রমিকদের সমস্যাদি দেখা। কিন্তু সমস্যা দেখা তো দূরের কথা, শ্রমিকরা তাদের সমস্যা জানাতে গিয়ে দূতাবাস কর্মকর্তাদের দেখাটা পর্যন্ত পায় না। এসব বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট দেশে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাস, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সবার সমন্বিতভাবে কাজ করা উচিত।
বস্তুত দিন দিন শ্রমিক অধিকারের বিষয়টি নতুনমাত্রা পাচ্ছে। এজন্য মে দিবসও আসছে নতুন ধ্যান-ধারণা নিয়ে। একসময় কেবল সংগঠিত শিল্প-শ্রমিকদের কাছেই এ দিবসের আবেদন ছিল। তারা সমাজ বিপ¬বের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এ দিনে নতুন করে শপথ গ্রহণ করত। শোষণমুক্ত সমাজ গঠনে নতুন ও জোরদার লড়াইয়ের ডাক দিত। কিন্তু এখন এর পরিসর আরো ব্যাপক ভাবে বিস্তৃত হয়েছে। শুধু কলকারখানার শ্রমিক নয়, কায়িকশ্রমে যুক্ত সবার কাছেই মে দিবস অনুপ্রেরণার দিন। এমন কি কৃষি খাতে নিযুক্ত মজুরদের কাছেও পৌঁছে গেছে এ দিবসের মর্মবাণী- কাজের সময় ৮ ঘণ্টা হতে হবে।
১৮৮৬ সালের এই দিনে শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমের উপযুক্ত মূল্য ও দৈনিক আট ঘণ্টা শ্রমসময় নির্ধারণের দাবিতে শ্রমিকরা যখন আন্দোলন করছিল তখন তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়েছিল। রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল হে মার্কেট। তাতে শ্রমিকদের আন্দোলন থেমে যায়নি, বরং তা আরো শক্তিশালী হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আট ঘণ্টা শ্রমসময়ের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল কর্তৃপক্ষ। ১৮৮৯ সালে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে দিনটিকে মে দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই থেকে সারা দুনিয়ার শ্রমিক সমাজ আজকের দিনটিকে পরম শ্রদ্ধাভরে পালন করে আসছে।
শ্রমিকের অধিকার সংরক্ষণের জন্যই প্রতিবছর পালন করা হয় মে দিবস। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসেবে দিনটি ১৮৯০ সালের ১ মে থেকে পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় মে দিবস পালিত হয়ে আসছে। সভা-সেমিনারে উচ্চারিত হয়েছে অগ্নিউদ্গারী ভাষণ। কিন্তু আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এখনো পর্বতপ্রমাণ বেকার সমস্যা। শ্রমিকরা অধিকার থেকে বঞ্চিত। নানা রকম বৈষম্যেরও শিকার। সেখানে মে দিবস পালন কেবলই আনুষ্ঠানিকতালব্ধ আয়োজন হয়তো বা। মে দিবস নিয়ে যতটা তর্চন গর্জন হয় ততটা বর্ষণ হয় না। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধতাড়িত সমাজব্যবস্থা এই অন্ধকারে পথ দেখাতে পারে। এই আত্মোপলব্ধি কাজ করুক সবার মধ্যে। এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : সাংবাদিক, গবেষক, কলামিস্ট।drharun.press@gmail.com
এইচআর/জেআইএম