আজ থেকে তিন বছর আগে, ২০২১ সালের ১ মে সন্ধ্যায়, আমাদের সকলের প্রিয় ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার চিরতরে বিদায় নিয়েছিলেন। কয়েক মাস ধরে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকার ফুলার রোডের বাসায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে দেশের চিকিৎসাঙ্গনে এক অপূরণীয় শূন্যতা সৃষ্টি হয়।
Advertisement
অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার ছিলেন একজন দক্ষ শিক্ষক, গবেষক এবং মানবিক চিকিৎসক। তিনি তার জীবনের অধিকাংশ সময় শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান ও চিকিৎসাসেবার উন্নতিতে উৎসর্গ করেছিলেন। একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং তার ছাত্রছাত্রীরাও তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করত।
ডা. সাহিদা আখতার বিশেষ করে শিশুদের চিকিৎসায় অসামান্য অবদান রেখেছেন। নবজাতক শিশুদের জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন এবং তাদের জীবন বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার মানবিক মনোভাব ও সহানুভূতির জন্য তিনি শিশুদের মাঝে "শিশুদের বন্ধু" হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার ছিলেন একজন সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও সহানুভূতিশীল ব্যক্তিত্ব। রোগীদের প্রতি তার আন্তরিকতা ও সহানুভূতি তাকে সকলের কাছে সমাদৃত করে তুলেছিল। দরিদ্র ও অসহায় মানুষের চিকিৎসায় তিনি সর্বদা সাহায্য করতেন এবং তাদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসাও প্রদান করতেন।
Advertisement
ডা. সাহিদা আখতার ১৯৬১ সালে ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারীতে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবনের প্রতিটি পর্যায়েই তিনি তার অসাধারণ মেধা ও কৃতিত্বের মাধ্যমে সকলকে মুগ্ধ করেছিলেন। ১৯৮৪ সালে তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। উল্লেখ্য, তিনি ছিলেন এ কলেজের পঞ্চম ব্যাচের একজন ছাত্রী।
এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জনের পর ডা. সাহিদা আখতার বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস ও সার্জনস থেকে এফসিপিএস ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়াও, তিনি পেশাগত উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার ছিলেন একজন খ্যাতিমান শিশু বিশেষজ্ঞ যিনি তার জীবনের অধিকাংশ সময় শিশুদের সুস্থতা ও কল্যাণের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক্স বিভাগের অধ্যাপক এবং বারডেম জেনারেল হাসপাতালের নবজাতক ইউনিটের প্রধান হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন তিনি। অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত তিনি একজন নিবেদিতপ্রাণ শিশু বিশেষজ্ঞ হিসেবে সেখানে কর্মরত ছিলেন।
অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার ছিলেন একজন মানবিক এবং বিনয়ী ব্যক্তিত্ব। রোগী, শিক্ষার্থী, সহকর্মী- সকলের কাছেই তিনি ছিলেন সম্মানিত ও প্রিয়। তিনি ছিলেন একজন অনুপ্রেরণাদায়ক শিক্ষক যিনি তার ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করেছেন এবং তাদেরকে ভালো চিকিৎসক হতে সাহায্য করেছেন।
Advertisement
শুধু ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ ও বারডেম হাসপাতালেই নয়, ডা. সাহিদা আখতার দেশের বিভিন্ন খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল (অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন, ইন সার্ভিস ট্রেইনি); ঢাকা শিশু হাসপাতাল; আইপিজিএমআর (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়); ডা. কাশেমস ক্লিনিক ও হাসপাতাল, কুষ্টিয়া; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (লেডি ডাক্তার), ইত্যাদি।
অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার ছিলেন বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত শিশু বিশেষজ্ঞ, যিনি তার জীবনের প্রায় তিন দশক নবজাতক শিশুদের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। তিনি ছিলেন দেশের নবজাতক স্ক্রিনিং টেস্ট প্রোগ্রামের একজন পথিকৃৎ, যা শিশুদের জন্মের পরপরই নির্দিষ্ট কিছু বংশগত রোগের জন্য পরীক্ষা করে।
নিউবর্ন স্ক্রিনিং টেস্ট হল জেনোমিক মেডিসিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা, যা শিশুদের জন্মের পরপরই কিছু গুরুতর বংশগত রোগ শনাক্ত করতে সাহায্য করে। এই রোগগুলির মধ্যে রয়েছে ফেনাইলকেটোনিউরিয়া (PKU), হাইপোথাইরয়েডিজম এবং অ্যাড্রেনাল কনার্টিকাল হাইপারপ্লাসিয়া (CAH)। যদি এই রোগগুলি শিশুদের জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা হয় এবং চিকিৎসা করা হয়, তবে তাদের সুস্থ ও দীর্ঘ জীবনযাপন করা সম্ভব।
ডা. সাহিদা আখতার বাংলাদেশে নবজাতক স্ক্রিনিং টেস্ট প্রোগ্রাম প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি এই প্রোগ্রামের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে এবং এর ব্যাপক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে কাজ করেছিলেন। তার অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে, বাংলাদেশে নবজাতক স্ক্রিনিং টেস্ট একটি জাতীয় পর্যায়ের প্রোগ্রামে পরিণত হয়েছে যা প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ শিশুর জীবন রক্ষা করছে।
ডা. সাহিদা আখতার শিশুদের শ্বাসযন্ত্রের তীব্র সংক্রমণ, হাঁপানি, বুকের দুধ খাওয়ানোর অনুশীলন, নবজাতকের প্রয়োজনীয় যত্ন, জন্মের সময় নবজীবন সঞ্চার, উন্নত কার্ডিয়াক লাইফ সাপোর্ট, এইচবিবি (শিশুদের শ্বাস নিতে সহায়তা করা), ইসিডি (প্রাথমিক শৈশব বিকাশ), পিএনডিএ (পেরিনিটাল ডেথ অডিট) ইত্যাদি বিষয়ে নিবিড় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। এই জ্ঞান ও দক্ষতা তার চিকিৎসা অনুশীলনে প্রভাব ফেলেছিল এবং তাকে শিশুদের জন্য একজন নির্ভরযোগ্য ও দক্ষ চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
শিশুদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণের উন্নতিতে অবদান রাখার জন্য ডা. সাহিদা আখতার শুধু চিকিৎসায় সীমাবদ্ধ থাকেননি। উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলোতে তার গবেষণা কাজও উল্লেখযোগ্য ছিল। তার গবেষণা ফলাফল শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণা ব্যতীতও তিনি ছিলেন একজন সচেতন সমাজ গবেষক। দেশে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন এবং মৌলিক গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছেন। তার রচিত মৌলিক গবেষণা ও সেমিনারে/ওয়ার্কশপে উপস্থাপিত ও প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা ৫০-এর বেশি।
ডা. সাহিদা আখতার নিরলস পরিশ্রম করেছেন নবজাতক শিশুদের রোগাক্লান্ত মুখে হাসি ফোটাতে। তিনি কেবল চিকিৎসায়ই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং নিয়মিত চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডেও সদাসক্রিয় ছিলেন। শিশুদের ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মাতৃদুগ্ধপানে মায়েদের উদ্বুদ্ধকরণ সচেতনতামূলক কর্মসূচিতে তাঁর বিশেষ অবদান ছিল।
শিশুস্বাস্থ্যের নানা বিষয় ছাড়াও একিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন, এন্ডোক্রাইনোলজি এবং জিনোমিক্সও ছিল ডা. সাহিদা আখতারের আগ্রহের জায়গা। নিওনেটোলজি, প্রারম্ভিক শৈশব বিকাশ, জেনেটিকস, জিনোমিক মেডিসিন, মা ও শিশু মৃত্যু এবং অসুস্থতা, শিশু স্বাস্থ্য, পুষ্টি, প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা, স্বাস্থ্যের সামাজিক মাত্রা, পানীয় জলে আর্সেনিক প্রশমন-সনোফিল্টার ইত্যাদি বিষয়েও তিনি কাজ করেছেন।
ডা. সাহিদা আখতার ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবক। তিনি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজের মাধ্যমে এ দেশের গরিব-দুঃখী অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তার নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষমতাও ছিল অসাধারণ। তিনি বাংলাদেশ পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন (দায়িত্ব গ্রহণের আগেই মৃত্যুবরণ করেন)। এ অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচিত সহসভাপতি হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি ছিলেন বাংলাদেশ নিওনেটাল ফোরামের নির্বাচিত সহসভাপতি, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ পেরিনেটাল সোসাইটির নির্বাহী পরিষদের নির্বাচিত সদস্য, বাংলাদেশ অ্যাজমা অ্যাসোসিয়েশনের আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসের জীবন সদস্য, ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের জীবন সদস্য, ইয়ং ডায়াবেটিক ওয়েলফেয়ার সোসাইটির জীবন সদস্য। এসব সংগঠনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এ দেশের শিশু চিকিৎসা শাস্ত্রকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
ডা. সাহিদা আখতারের ব্যক্তিগত জীবন ছিল সমৃদ্ধ ও পরিপূর্ণ। তিনি বিখ্যাত গবেষক ও অর্থনীতি শাস্ত্রের অধ্যাপক আবুল বারকাতের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। তিনি শুধু একজন স্ত্রীই ছিলেন না, বরং একজন সঙ্গী, বন্ধু এবং সহকর্মীও ছিলেন। তাদের তিন কন্যা সন্তান রয়েছে।
অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার ছিলেন একজন মানবিক এবং বিনয়ী ব্যক্তিত্ব। রোগী, শিক্ষার্থী, সহকর্মী- সকলের কাছেই তিনি ছিলেন সম্মানিত ও প্রিয়। তিনি ছিলেন একজন অনুপ্রেরণাদায়ক শিক্ষক যিনি তার ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করেছেন এবং তাদেরকে ভালো চিকিৎসক হতে সাহায্য করেছেন।
তার মৃত্যুর পরে অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতারের স্বামী গণমানুষের অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত’র সম্পাদনায় ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে তার আত্মজীবনী “অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার একজন শিশুচিকিৎসকের যাপিত জীবন”। যে কেউ এ জীবনীগ্রন্থ পড়ে তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন ও অনুপ্রাণিত হবেন।
অধ্যাপক ডা. সাহিদা আখতার চলে গেলেও তার অবদান ও স্মৃতি আমাদের অন্তরে চির অমলিন হয়ে থাকবে। একজন দক্ষ শিশু বিশেষজ্ঞ, নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক এবং মানবিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি আমাদের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।
তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তার প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। তার আত্মার শান্তির জন্য আমাদের সকলের প্রার্থনা।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।
এইচআর/জেআইএম