দেশি-বিদেশি ফলের জন্য বিখ্যাত পুরান ঢাকার বাদামতলী ও ওয়াইজঘাট আড়ত। রাজধানীসহ সারাদেশের মানুষের ফলের চাহিদার প্রায় সবটুকুই জোগান দেন এখানকার আড়তদাররা। এজন্য ফল লোড-আনলোডে দিনরাত ব্যস্ত সময় পার করতে হয় এখানকার শ্রমিকদের।
Advertisement
সূর্য ওঠার আগেই শুরু হয় তাদের মহাকর্মযজ্ঞ। ফলের গাড়ি এলেই শুরু হয় ছোটাছুটি। শ্রমিকরা প্রতিটি ঝুড়িতে এক মণেরও বেশি ফল বহন করেন। অনেক শ্রমিক যখন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে ক্লান্তি নিয়ে গভীর রাতে ঘুমাতে যাবেন, ঠিক তখনই লোড-আনলোডের জন্য আসে আড়তদারের ডাক। যুগ যুগ ধরে এভাবেই কাজ করছেন দেশের বৃহত্তম এ পাইকারি ফলের আড়তের শ্রমিকরা। তবে, দিনরাত কাজ করেও শ্রম অনুযায়ী পারিশ্রমিক পান না বলে অভিযোগ তাদের।
সোমবার (২৯ এপ্রিল) বুড়িগঙ্গার কোলঘেঁষে গড়ে ওঠা বাদামতলী ও ওয়াইজঘাটের শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় এসব তথ্য।
কাভার্ডভ্যান থেকে তরমুজ নামাচ্ছেন শ্রমিকরা
Advertisement
এখানকার শ্রমিকরা বলেন, বাদামতলী-ওয়াইজঘাটে ফল লোড-আনলোডের কাজের সঙ্গে প্রায় দুই হাজারের বেশি শ্রমিক জড়িত। সবাই দিনরাত কাজ করেন। মজুরি কম হওয়ায় দিনরাত এক করে কাজ করলেও নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের।
সরেজমিনে দেখা যায়, ফলবোঝাই গাড়ি এলেই শুরু হয় হৈ-হুল্লোড়। ঝুড়ি নিয়ে দলবেঁধে হাজির হন শ্রমিকরা। অনেকেই ঘুম ঘুম চোখে পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে হাজির হন কাজে।
আরও পড়ুনশ্রমিক অধিকার লঙ্ঘনের শাস্তি বাড়ছে: আইনমন্ত্রীপ্রাতিষ্ঠানিক কল-কারখানায় কোনো শিশুশ্রম নেই: প্রতিমন্ত্রীকম মজুরিতে শ্রমিক সমাজের এখন বেঁচে থাকাই কষ্টের: রিজভীশ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফলের মৌসুম ও চাহিদা অনুযায়ী নির্ধারণ হয় মজুরি। বর্তমানে একটি তরমুজ মাথায় তুললেই পান দুই টাকা। তবে, এক মণের বেশি ওজনের একটি ফলের ক্যারেট আনা-নেওয়া করলে পান ১০ থেকে ১৫ টাকা।
ক্যারেটে করে ফল নিয়ে যাচ্ছেন শ্রমিকরা
Advertisement
১০ বছর ধরে ওয়াইজঘাটে ফল লোড-আনলোডের কাজ করেন সুমন মিয়া। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা আড়তের মানুষ আড়তেই থাকি। গাড়ি এলে ফল নামাই, আবার ওঠাই। কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। যখন গাড়ি আসে তখন কাজ। রাত-দিন বলে কোনো কথা নেই। বন্দর থেকে ট্রাকগুলো আসতে আসতে ভোর হয়, কখনো আবার রাত ৩টা/৪টাও বাজে। কতদিন এমন হয়েছে সারাদিন পরিশ্রম করে ১০টা বাজে ভাত খেয়ে ঘুমিয়েছি, হঠাৎ ১২টা বাজে ফলের ট্রাক চলে এসেছে। মাঝে মধ্যে কোমরের ব্যথায় ঘুমাতে পারিও না।
তিনি বলেন, ‘ঘাম ঝরানো পরিশ্রম করেও দিন এনে দিন খাওয়ার মতো অবস্থা। হঠাৎ করে অসুস্থ হলে বা জরুরি প্রয়োজনের টাকা থাকে না। কিস্তি তুলতে হয়। পাঁচ সদস্যের পরিবার আমার ওপর নির্ভরশীল। এখানে যে শ্রম দিতে হয় সেই তুলনায় পারিশ্রমিক পাওয়া যায় না। দিনরাত খেটেও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়।
বাদামতলীতে ১৫ বছরে ধরে ফলের আড়তে কাজ করছেন আলম চৌধুরী। বর্তমানে কাজ করছেন জিতু এন্টারপ্রাইজের আড়তে। তিনি বলেন, ওয়াইজঘাটে সাধারণ দেশি ফল এলেও বাদামতলীতে সব বিদেশি ফলের আড়ত। শ্রম অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাই না। যে খাঁটুনি দিতে হয় তার অর্ধেক সময় দিয়ে অন্য পেশায় আরও ভালো থাকা যায়। দৈনিক ১২ ঘণ্টা থেকে ১৫-১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করি। কাজ অনুযায়ী কোনোদিন ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা। আবার কখনো কখনো ১৫শ টাকাও আয় হয়। বেশিরভাগ গাড়ি রাতে আনলোড হয়। তাই ঘুম চোখেই কাজ করতে হয়।
আরও পড়ুন৩০০ টাকার তরমুজ এখন ৫০লােকসানের মুখে ফরিদপুরের বাঙ্গি চাষিরাতীব্র খরায় ঝরছে গুটি, শঙ্কায় লিচু চাষিরাএকই সুরে কথা বলেন বাদামতলীর শ্রমিক মাজেদ। তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালে এখানে কাজ শুরু করি। এখনো রাত হলে মাথাব্যথা হয়। রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়েই কাজ করি। যে আয়-রোজগার তা দিয়ে পরিবার চালানো কষ্ট হয়ে উঠেছে। আড়তে ঘুমাতে পারি না। থাকি ভাসমান হোটেলে। এভাবে টিকে আছি।’
ক্যারেটে করে ফল নিয়ে যাচ্ছেন শ্রমিকরা
জমজম ফ্রুট এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার আবুল কালাম বলেন, ‘এখানে শ্রমিকদের কষ্ট বেশি হলেও কারও টাকা বকেয়া থাকে না। গরমে এখন কষ্ট বেশি। সেজন্য রাতেই অনেক মাল খালাস করা হয়। সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের আমদানিও কম। এখন কেউ প্রয়োজন ছাড়া ফল কেনেন না। সবমিলিয়ে বর্তমানে ব্যবসার অবস্থা ভালো নয়। বর্তমানে আমাদেরও কাজ কম।’
জানা যায়, দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ বিদেশি ফল চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা হয়। বাকি ৩০ শতাংশ আমদানি হয় সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বুড়িমারী ও হিলির স্থলবন্দর দিয়ে। এসব জায়গা থেকেই মূলত ট্রাকে ফল আনা হয় বাদামতলীতে। এছাড়া সারাদেশ থেকে দেশি ফল আসে এ আড়তে।
আরএএস/এমএএইচ/জেআইএম