ঈদুল ফিতরের পর যখন পুনরায় রাজধানীতে কর্মব্যস্ততা শুরু হয় তখন থেকেই বইছে তীব্র তাপপ্রবাহ। সকাল থেকেই চোখ রাঙাচ্ছে সূর্য। দিনের মতো তাপমাত্রা থাকছে রাতেও। গরমে অসহনীয় দুর্ভোগে পড়েছেন শ্রমিকরা। প্রচণ্ড তাপে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন তারা। কাজে যেতে পারছেন না অনেকেই। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ায় চাহিদাও কমেছে তাদের। তার ওপর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। শ্রমিকদের অভিযোগ, এমন অবস্থায় ‘অর্ধাহার-অনাহারে’ দিন কাটছে তাদের।
Advertisement
সোমবার (২৯ এপ্রিল) সকালে মিরপুরের পূরবীতে শ্রম বিক্রির হাটে কথা হয় শ্রমিকদের সঙ্গে। সেখানে এসব কথা জানান তারা।
শ্রমিকরা জানান, উন্নত যন্ত্র ব্যবহারের ফলে নির্মাণ ও টানা শ্রমিকের চাহিদা কমেছে। আবার গরমেও কাজ যেমন কমেছে তেমনি অসুস্থ হয়ে অনেক শ্রমিক যেতে পারছেন না কাজে। তবে কাজ বন্ধ থাকলেও বাজার খরচ প্রতিদিন বাড়ছে। সবমিলিয়ে দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে পড়েছেন তারা।
সূর্যের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে পূরবীর মেট্রো স্টেশনের সামনে ভিড় করেন শ্রমিকরা। তাদের কেউ মাটিকাটা, কেউ টানা, কেউ সাহায্যকারী, কেউ ঠেলা শ্রমিক। শ্রম বিক্রির হাটে এক শ্রেণির মানুষ আসেন বিক্রি হতে, এক শ্রেণির মানুষ আসেন এসব শ্রমিক বা কামলাদের শ্রম কিনতে। কাজ করতে সকাল ৮টার মধ্যে দূর-দূরান্তে চলে যেতে হয় তাদের। সন্ধ্যা ৬টা অবধি চলে কাজ। পণ্যের মতোই ওঠানামা করে শ্রমের মূল্য। অভিজ্ঞ শ্রমিকদের দাম কিছুটা বেশি। আবার বয়স্ক শ্রমিকদের চেয়ে যুবক শ্রমিকদের দাম প্রায় ৫০-১০০ টাকা বেশি।
Advertisement
তীব্র গরমের কারণে চারদিন ধরে কাজে যেতে পারননি টানা শ্রমিক আবুল মিয়া। পল্লবীর আলুবদিতে দুই মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে থাকেন তিনি। ট্রাক থেকে বালু, ইট, রড ভবনে ওঠানোর কাজ কখনো একা, কখনো কন্ট্রাক্টে (চুক্তিতে) করেন তিনি।
আবুল মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘কয় তলায় মাল উঠবে, কতজন ওঠাবে তার ওপর ভিত্তি করে মজুরি নির্ধারণ হয়। ধরুন এক ট্রাক ইট নামানো বা ইটগুলো তিন তলায় উঠবে, সেক্ষেত্রে তিনজন তিন হাজার টাকা কন্ট্রাক্ট নেই। এভাবে দিনে কোনোদিন এক হাজার বা এক হাজার ২০০ টাকা মজুরি পাওয়া যায়। কাজ না পেলে ওইদিন ধারদেনা করে চলতে হয়। নইলে একবেলা না খেয়ে থাকতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘গরমে কাজ করতে গেলে প্রাণ বেরিয়ে যায়। কিন্তু বসে থাকলে তো ঘরে চাল, ডাল নেওয়া যায় না। অসুস্থ হয়ে চারদিন কাজ করতে পারিনি। ধার-কর্য করে চলা লাগছে, বাসায় দুটি ছোট মেয়ে আছে। বাসায় গেলে জিজ্ঞেস করে আব্বা কী আনছো।’
টানা শ্রমিকের কাজ কমেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আগে এক ট্রাক মাল নামাতো সাত-আটজন। এখন সেটা করে দু-তিনজন। এছাড়া ক্রেন ও লিফটের মাধ্যমে মালামাল ওঠানো-নামানোর কাজ হয়। মাসে সাত-আটদিন কোনো কাজ পাওয়া যায় না।’
Advertisement
‘আমরা তো শিক্ষিত না, অন্য কোনো কাজ জানি না। অন্যকিছু করতে পারি না। ১৫ বছর ধরে মাল টানার কাজ করছি। শরীরে শক্তি আছে, করে যাচ্ছি। শরীরে না কুলাইলে বাড়ি চলে যাবো। বাড়ি আমার কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম। আগের রাষ্ট্রপতি আমার এলাকার।’ যোগ করেন আবুল মিয়া।
এই শ্রমজীবী বলেন, ‘আগে মালিক কামলারে ঘরে বসায়া ভাত খাওয়াইতো। চা-নাশতা করাইতো। এখন মালিকরা শ্রমিকদের চেনেই না। শ্রমিকরা জানে না তার মালিক কে। এখন ‘পার্টিই’ (মধ্যস্থতাকারী) সব দেখভাল করে। ৫০-১০০ টাকা বেশি চাইলে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। চা নাশতার টাকা নিজের মজুরি থেকেই দিতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘এখন মানুষের পয়সা হইছে। যন্ত্রণা হইছে আরও বেশি। আগে শ্রমিকের সঙ্গে মিল-মহব্বত ছিল মালিকের। এখন এটা আর নেই।’
রাজমিস্ত্রির হেলপার (সহকারী) শফিক ইসলামের গল্পটা আবার অন্য রকমের। ডিগ্রি পাস শফিক ৬-৭ মাস আগে কাজ করতেন গাজীপুরের একটি ফ্যাক্টরিতে। পারিবারিক ঝামেলায় চাকরিটি হারান তিনি। এখন ৬০০-৭০০ টাকা মজুরিতে হেলপারের কাজ করছেন তিনি।
শফিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডেভেলপাররা বেশি হেলপার নিতে চায় না। সপ্তাহে দু-একদিন কোনো কাজ পাই না। অন্য কোনো কাজ পাই না, তাই এইটা করছি।’
আরও পড়ুন‘শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার টাকা করতে হবে’শ্রমিকদের মধ্যে বিভাজন করতে পারলেই মালিকপক্ষ সফলতিনি বলেন, ‘আমি থাকি মিরপুর-১ নম্বর চাইনিজের পেছনে। গত ছয়-সাত মাসে আমি টিসিবির গাড়ি দু-একবার দেখেছি। কিন্তু সেখান থেকে কেনার সুযোগ হয়নি। লাইনে দাঁড়িয়ে নিতে গেলে ওই দিনের কাজ মিস হবে।’
শফিক আরও বলেন, ‘আমি ঢাকায় একা থাকি। জিনিসপত্রের এত বেশি দাম যে মাসে দু-একদিন মাছ, মুরগি জোটে। আলুভর্তা আর ডাল নিত্যসঙ্গী। কোনো মাসে ১৫ হাজার, কোনো মাসে ১৬ হাজার টাকা মজুরি পাই। বাড়িতে ৩-৪ হাজার টাকার বেশি পাঠানো যায় না। ঘরভাড়া, নিজের খরচ মেটানো কঠিন হয়ে পড়েছে।’
শ্রমিকদের অভিযোগ, ‘জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়েছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে রোগ-শোক। তবে আয় বাড়েনি। অর্থ-বিত্ত বেড়েছে মানুষের। বিবেকহীন ও মনুষ্যত্বহীন মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে।’
মাটিটানা শ্রমিক কল্পনা আখতার বলেন, ‘মজুরি দিয়ে মাস চালানো যায় না। ব্যক্তিগত ধার আর সমিতির ঋণে আটকে গেছি। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ায় বাড়িভাড়া বেড়েছে। অসুখ-বিসুখে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার টাকা থাকে না। ফার্মেসি থেকে এনে কিংবা জ্বরের ওষুধ খেয়ে সব রোগ সারাই।’
বেশিরভাগ শ্রমিকই জানিয়েছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তাদের ভোগাচ্ছে। নিম্ন আয়ের লোকজনকে একটুখানি স্বস্তি দিতে বাজারে আছে টিসিবি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সুলভমূল্যে বিক্রয় কার্যক্রম। তবে শ্রমিকদের দাবি, এসব জায়গা থেকে পণ্য কেনার সুযোগ কম তাদের।’
আরও পড়ুনশ্রমজীবী মানুষকে পানি-খাবার স্যালাইন দিলেন ঢাবি শিক্ষার্থীরাশ্রমিকদের বঞ্চিত করে উন্নয়ন সম্ভব নয়: স্পিকারকোভিড ও ইউরোপের যুদ্ধে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার কারণে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশীয়ার দেশগুলোতেও ব্যাপক মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। তবে বেশিরভাগ দেশে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে পৌঁছালেও বাংলাদেশে এটি কমার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশে। জানুয়ারিতে এটি ছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির এ উচ্চহার চলছে। ফলে দ্রব্যমূল্য হু হু করে বেড়েছে। মাছ, সবজি ও মাংস মধ্য ও নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরে। এমন অবস্থায় বাজার নিয়ন্ত্রণ ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য রেশনিং এবং সুলভমূল্যে পণ্য দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এসএম/ইএ/জেআইএম