একুশে বইমেলা

বাংলা সাহিত্যে শিল্পপ্রবণতা: লেখকের দায়বদ্ধতা

আমিনুল হক

Advertisement

‘সাহিত্যে এখন বিষয়ভিত্তিক লেখার উৎসব চলছে। সম্পাদকরাই বিষয় নির্ধারণ করে দিচ্ছেন, লেখকরা কামলার মত খেটে যাচ্ছেন। বিষয়টা স্পষ্ট হয় ইদানীং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। যেমন- কয়েকদিন ধরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। এ মৌসুমে কম-বেশি বৃষ্টি হবেই। তাই বৃষ্টিতে ভিজে বৃষ্টি নিয়ে কিছু লেখা তো গতানুগতিক। বরং বৃষ্টিতে ভিজে শীত বা প্রচণ্ড গরম নিয়ে লিখতে পারাটা ব্যতিক্রম কিছু। ফেসবুকে সবাই বৃষ্টি নিয়ে লিখে যাচ্ছেন।’ বর্তমান সাহিত্যবাজারের ছবি এভাবেই তুলে এনেছেন লেখক-শিল্পী সালাহ উদ্দিন মাহমুদ তার ‘বাংলা সাহিত্যে শিল্পপ্রবণতা’ বইটিতে। ছোট-বড় পনেরোটি প্রবন্ধ বা প্রবন্ধধর্মী রচনার সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে বইটির নধর দেহ। ক্ষুদ্র কলেবরে আমরা বইটির বিবরণ দিতে চেষ্টা করবো।

‘শিল্পের কাছে দায়বদ্ধতা’ প্রবন্ধে লেখক বোঝাতে চেয়েছেন যে, সম্পাদকরাই কেন লেখার বিষয়বস্তু নির্ধারণ করে দেবেন। যিনি লিখতে পারেন তিনি বিষয়ও ঠিক করতে পারবেন। তবে ক্ষেত্রবিশেষে এর ব্যতিক্রম হতে পারে। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, আগে লেখক পরে সম্পাদক। লেখাই যদি না থাকে তাহলে সম্পাদক সম্পাদনা করবেন কীসের ওপর। সম্পাদকরা মামুলি বিষয় নির্ধারণ করে দেন, যা একেবারে নবীন লেখকেরও মাথায় উড়ে আসে—বৃষ্টি, বিয়ে, বিভিন্ন দিবস আর কত কী! ফলে সাহিত্যশিল্পীদের মাথায় নবভাবনা উদয় হচ্ছে না—সাহিত্যের-ডিনামাইট আবিষ্কারের বদলে দিয়াশলাই হচ্ছে বলেও মনে হয় না। একদিকে সম্পাদকের মনতুষ্টি অন্যদিকে পাঠকের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া ছাড়া আর বেশি কিছু নয়। শিল্পোত্তীর্ণ সাহিত্যের জন্য শিল্পের কাছে দায়বদ্ধতা প্রয়োজন; এ-কথাটা লেখক একটু জোর দিয়েই বলেছেন। আমিও মনে করি তা-ই। শিল্প যদি শিল্পের মতো না-ই হয়, তাহলে তা ফলপ্রসূ হবে কীরূপে?

ফেসবুকের স্ট্যাটাসভিত্তিক সেলেব্রিটিকে তিনি সাহিত্য বলতে নারাজ। এটাকে কথোপকথন বলা যেতে পারে। সত্যিই তো! শরৎচন্দ্র, নজরুলের যুগে ফেসবুক, অনলাইন মাধ্যম ছিল না—তারা কি অমর হননি! এই ফেসবুক অনলাইনের যেমন ইতিবাচক দিক রয়েছে; তেমনই উল্টোটাও। ফেসবুকের ব্যক্তিরা সাহিত্য-সমালোচক নন, এমনকি ভালো পাঠকও নন। তাহলে মন্তব্যটাও কেমন হবে তা অনায়াসেই অনুধাবন করা যায়। লেখকের সঙ্গে আমারও অভিমত এই যে, সাহিত্য জিনিসটা তার মূলধারা থেকে সরে আসছে; যা খুবই উদ্বেগজনক। ‘বই কিনে খুশি করা পাঠকের চেয়ে কট্টর সমালোচকও অনেক ভালো।’ লাইনটি আমার মনে রেখাপাত করেছে।

Advertisement

কবিতা, গল্প, উপন্যাস দেদারসে লেখা হলেও প্রবন্ধ আশানুরূপ রচিত হচ্ছে না। ‘একুশ শতকের প্রবন্ধচর্চা কোন পথে?’ শীর্ষক রচনার শুরুতেই লেখক বলেছেন—‘ইদানীং, ভালো প্রবন্ধ চোখে পড়ছে না। এখন কেউ আসলে ভালো প্রবন্ধ লিখছেন না। লিখছেন কেবল কবি-লেখকের স্তুতিবাক্য। কোনো দিকনির্দেশনা নেই। সম্পর্কের চর্চা শরু হয়েছে যেন সাহিত্যকে ঘিরে। ফলে নতুন যারা সাহিত্যচর্চা করতে আসছেন, তারাও সম্পর্কচর্চায় জড়িয়ে পড়ছেন। একজন কবি চাইলে শক্তিশালী প্রাবন্ধিক হয়ে উঠতে পারেন। যা আমরা আগেও দেখেছি। তবে এখনকার কবিদের যেন অনীহা প্রবন্ধ লেখায়। কবির সংখ্যা বাড়লেও প্রাবন্ধিকের সংখ্যা বাড়েনি। একই ভাবে বেড়েছে ঔপন্যাসিক ও গল্পকারও। ফলে কথাশিল্পীর বড়ই অভাব। গবেষণাকর্মের কথা না হয় বাদই দিলাম।’

কথাশিল্পীর বড়ই অভাবের স্থলে প্রাবন্ধিকের বড়ই অভাব বলাই সংগত হতো। যেহেতু কথাসাহিত্য বলতে আমরা গল্প ও উপন্যাসকে বুঝে থাকি। যা হোক, হাসনাত আবদুল হাই সাক্ষাৎকারে একই কথা বলেছেন—‘আমাদের নতুন প্রজন্মের কথাসাহিত্যিকেরা, কবিরা প্রচুর লিখছেন। অনুবাদকের সংখ্যা অনেক বেড়েছে—এটা নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। কিন্তু মননশীল সাহিত্য, গবেষণাভিত্তিক লেখা খুব কম হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। গল্প-উপন্যাসও প্রচুর লেখা হচ্ছে। কিন্তু খুব কম লেখাতেই আমি নতুন আঙ্গিক দেখতে পাচ্ছি, নতুন বিষয় দেখতে পাচ্ছি। ভাষা নির্মাণও করছে না। আঙ্গিক ও ভাষা নির্মাণের দিক থেকে আমরা পিছিয়ে আছি। তবে কবিতায় আমরা এগিয়ে গিয়েছি।’ (প্রথম আলো, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪)

আরও পড়ুননোবেল সাহিত্য পুরস্কারের শতবর্ষ: বিশদ আলোকপাতবীরের মুখে বীরত্বগাথা: দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে

সত্যিকার অর্থে, প্রবন্ধ লিখতে গেলে প্রচুর বই পড়া লাগে। বিভিন্ন বই থেকে রস সংগ্রহ করে স্বীয় জ্ঞান, চিন্তা ও মননে সংযোগ ঘটাতে হয়। যা হোক কাজী মোতাহার হোসেন রচিত বই ‘সঞ্চয়ন’ আর মোতাহের হোসেন চৌধুরী রচিত ‘সংস্কৃতি-কথা’। উভয় লেখকের নাম এবং বইয়ের নামে সাযুজ্য লক্ষণীয়। তা বর্তমান প্রাবন্ধিকেরও অবিদিত নয়; কিন্তু অসাবধানতাবশত তিনি কাজী মোতাহার হোসেনের ‘সংস্কৃতি-কথা’র দৃষ্টান্ত দিয়েছেন।

লেখা যদি শিল্প না হয় তবে সাহিত্যিকের লেখা না বলে সাধারণ মানুষের লেখা বলাই সমীচীন। লেখার মান ভালো হোক, শিল্পসমৃদ্ধ হোক, সাহিত্য পদবাচ্য হোক—এই ইচ্ছাশক্তিটাও নেই নামধারী-লেখকদের মনে; তার বদলে তারা চায় লেখাটা প্রকাশ হোক, প্রচার হোক এবং লেখক হিসেবে নিজের নাম মানুষের কানে ধ্বনিত হোক। ‘লেখাকে আগে শিল্প হতে হবে’ শীষর্ক রচনায় সালাহ উদ্দিন মাহমুদ বোঝাতে চেয়েছেন যে, মনের মধ্যে যখন যা আসে তা-ই লেখা দরকার; কেননা পরবর্তী সময়ে তা মাথায় না-ও থাকতে পারে। পরে সেই লেখাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে সুবিন্যস্ত করে শিল্পরূপ ধারণ করাতে হয়। যিনি শিল্পের কাজ করেন তিনিই শিল্পী। সেদিক থেকে কৃষকও শস্যশিল্পী। তিনিও শস্য বাছাই, ঝাড়াই-মাড়াই করে সোনার ফসল হাতে পান। সব শিল্পেরই একটা নির্দিষ্ট ছক থাকে। লেখালেখির ক্ষেত্রেও ছক রয়েছে। লেখকের ধারণা, বর্তমানে মানহীন লেখা ছড়িয়ে পড়ার নেপথ্যে কিছু কারণ রয়েছে। যেমন- লেখা প্রকাশের অবাধ সুযোগ, সম্পাদনা ছাড়া প্রকাশ, চাটুকারিতা, স্বার্থযুক্ত প্রকাশনা সংস্থা, মানসম্মত কাগজে লেখা না ছাপানো প্রভৃতি। লেখকের ভাষ্য—‘ফলে আজ যে কেউ যখন-তখন লেখক হয়ে যাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের লাইক, কমেন্ট, শেয়ার যাকে-তাকে লেখক তকমা দিয়ে দিচ্ছে। যা ভব্যিষতের জন্য অশনি সংকেত।’

Advertisement

দীনেশচন্দ্র সেন ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ বইটির সমালোচনামূলক প্রবন্ধের শুরুতেই বলেছেন—‘ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাবে বাংলা ভাষার শ্রী উল্টিয়া গিয়াছে। যেমন আজকাল দুধে ভেজাল, ঘিয়ে ভেজাল, মধুতে ভেজাল, মেঠাইয়ে ভেজাল, তেমনই এখন সাহিত্যে ভেজালের ছড়াছড়ি, এমন যে তিলোত্তমা, তাতেও নাকি বেবেকার ভেজাল আছে।’ দীনেশবাবুর কথার রেশ ধরে আমরাও বলতে পারি, এখন লেখকের মধ্যে ভেজালের ছড়াছড়ি। সচেতন পাঠকই ঠিক করে নেবেন সত্যিকারের লেখক কারা।

বাংলাদেশের ঋতু—শীত, বর্ষা, শরৎ কীভাবে বাংলা সাহিত্যে স্থান দখল করেছে, সে-সম্পর্কে লেখক আলোচনা করেছেন। তা ছাড়া বইটিতে কতিপয় কবি-লেখকের শিল্পকর্মের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন স্বীয় ভাব-ভাষা-ভঙ্গিতে। আসলে পুরাতন বিষয় আওড়ানোর চেয়ে নতুনের আবেদন বেশি—মূল্যও বেশি। নতুন-পুরাতন বিষয় মিলিয়েই সালাহ উদ্দিন মাহমুদের এই বই ‘বাংলা সাহিত্যে শিল্পপ্রবণতা’। নতুন লেখকরা কোন পথে হাঁটলে তাদের পথচলা সার্থক হবে, তেমন একটা ধারণা পেতে পারেন বইটি পাঠের মাধ্যমে।

বইয়ের নাম: বাংলা সাহিত্যে শিল্পপ্রবণতালেখকের নাম: সালাহ উদ্দিন মাহমুদপ্রকাশনী: কিংবদন্তী পাবলিকেশনপ্রচ্ছদ: চারু পিন্টুমূল্য: ৩০০ টাকা।

আলোচক: কবি ও কথাশিল্পী।

এসইউ/জেআইএম