আসন্ন উপজেলা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে বিএনপি ও জামায়াত। সুবিধামতো সময়ে আন্দোলন জমিয়ে তোলাসহ বেশ কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় রেখে এ সিদ্ধান্ত। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর এবার দল দুটি উপজেলা নির্বাচন বর্জনের ক্ষেত্রেও একই অবস্থান নিলো।
Advertisement
উভয় দলের একাধিক সূত্র বলছে, সময়-সুযোগ বুঝে ফের একসঙ্গে আন্দোলনে নামতে চায় রাজপথের বৃহৎ এ দুই বিরোধী শক্তি। কার্যত বড় ধরনের আন্দোলন ছাড়া যে দাবি আদায় সম্ভব নয় বিএনপি-জামায়াত নেতাদের কাছে সে উপলব্ধিও এখন পরিষ্কার। এরই মধ্যে দল দুটির নেতাদের মধ্যে যোগাযোগও অনেকটাই বেড়েছে।
বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা বলছেন, তারা দেশের মানুষের প্রত্যাশাকে প্রাধান্য দিতে চান। দেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফেরাতে চান। আর এই আন্দোলনে যারাই রাজপথে থাকবে তাদের সঙ্গেই তারা ঐক্য করবে।
জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে অনেকটাই ‘একলা চলো’ নীতিতে চলতে শুরু করে বিএনপি। ওই নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি ও বেশ কয়েকটি দল মিলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছিল। এরপর দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দীর্ঘদিনের দাবি থেকে হঠাৎ সরে এসে দলগুলো শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছে রাজনৈতিকভাবে কৌশলগত হারের পরই বিএনপি ‘একলা চলো’ নীতি অবলম্বন করে।
Advertisement
দল হিসেবে জামায়াত নিজস্ব চিন্তায় উপজেলা নির্বাচন থেকে সরে এসেছে। আসলে বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি বা বিশেষ পরিকল্পনা কোনো বিষয় নয়। দেশে গণতন্ত্র ফেরাতে যারাই রাজপথে থাকবে তাদের সঙ্গেই ঐক্য হবে, এটিই স্বাভাবিক।- জামায়াত নেতা মতিউর রহমান আকন্দ
এরপর আসে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনের বেশ আগেই বিএনপির ২০ দলীয় জোটে ভাঙন ধরে। পরে ডান-বাম মিলিয়ে বেশ কয়েকটি দল নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। জামায়াত শুরুর দিকে সেই আন্দোলন কর্মসূচি যুগপৎভাবে পালন করলেও পরবর্তীসময়ে কর্মসূচি গ্রহণে বিএনপির পরামর্শ না নেওয়াসহ নিজেদের মতো কর্মসূচি দেয়।
আরও পড়ুনবিএনপি-জামায়াত সম্পর্ক কোন পথে?দীর্ঘদিন পর এক টেবিলে বিএনপি-জামায়াতজামায়াতের ইফতারে বিএনপির এক ডজনের বেশি নেতাতবে সরকার পতন আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে আবারও একসঙ্গে মাঠে নামে বিএনপি-জামায়াত। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করে একই কর্মসূচি দেয় উভয় দল। কিন্তু সেই কর্মসূচি বা আন্দোলনে তেমন গতি আসেনি। ফলে সরকার অনেকটাই স্বাভাবিক পরিবেশে ও নির্বিঘ্নে নির্বাচন সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়। যদিও এই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক ও প্রশ্ন তোলে বিরোধীরা।
নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশে নেতাকর্মীরা
Advertisement
জাতীয় নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় এবার উপজেলা নির্বাচন বর্জনেরও ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। কেন্দ্রীয় নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ভোটে অংশ নেওয়ায় এ পর্যন্ত বিএনপির অন্তত ৮০ জন নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। চার ধাপের উপজেলা নির্বাচন নিয়ে বেশ হার্ডলাইনে বিএনপি।
অন্যদিকে জামায়াত সরাসরি ভোটে অংশ নেওয়ার ঘোষণা না দিলেও অঘোষিতভাবে বিভিন্ন উপজেলায় দল মনোনীত প্রার্থী দেয়। তবে, নির্বাচনী পরিবেশ আর সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় শেষ পর্যন্ত নির্বাচন থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। এ অবস্থায় উপজেলা নির্বাচন বর্জন ঘিরে বিএনপি-জামায়াতের হঠাৎ একই অবস্থানে চলে আসা নিয়ে রাজনীতির মাঠে চলছে নানা আলোচনা ও বিশ্লেষণ।
দল দুটির একাধিক সূত্র বলছে, গত সংসদ নির্বাচনের আগে ভারতের আশীর্বাদ পেতে জামায়াতকে সব সময় দূরে সরিয়ে রেখেছিল বিএনপি। এ কারণে জামায়াতকে নিয়ে এক মঞ্চে নির্বাচনী সভা-সমাবেশ করেনি দলটি। নির্বাচনের দুই মাস আগে গত বছরের ২৮ অক্টোবর একই মঞ্চে দুই দল সমাবেশের পরিকল্পনা করলেও শেষ পর্যন্ত সেটি সম্ভব হয়নি। আর তাতে বিএনপির জন্য বিশেষ কোনো লাভও হয়নি।
দুই দলেরই তৃণমূল নেতারা মনে করেন, সারাদেশে একযোগে জামায়াতকে নিয়ে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে উভয়ের জন্যই তা লাভ ছিল। ফলে আগামীতে আর সেই ভুল করতে চায় না তারা। এখন থেকেই একসঙ্গে আন্দোলন আর পথচলার তাগিদ অনুভব করছেন দুই দলের নেতারা।
২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে দীর্ঘদিনের মিত্র ও জোটসঙ্গী জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে বিএনপির। এরপর বিভিন্ন সময়ে এ দুই দলের শীর্ষ নেতারা পারস্পরিক বাকযুদ্ধে জড়ান। এক পর্যায়ে ভাঙন ধরে ২০ দলীয় জোটে। এরপর থেকে দল দুটির নেতাদের আনুষ্ঠানিকভাবে কাছাকাছি হতে দেখা যায়নি।
সবশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে সরকারবিরোধী আন্দোলনেও বিএনপি ও জামায়াতের প্ল্যাটফর্ম ছিল ভিন্ন। পৃথক অবস্থান থেকে যুগপৎ আন্দোলন করেন দুই দলের নেতাকর্মীরা। অবশেষে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর গত রমজানে একমঞ্চে দেখা যায় বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের। গত ২৮ মার্চ রাজধানীর লেডিস ক্লাবে রাজনৈতিক নেতাদের সম্মানে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে বিএনপি। সেখানেই একমঞ্চে ক্যামেরাবন্দি হন জামায়াত নেতারা।
এর দুদিন পরই ৩০ মার্চ রাজধানীর হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে ইফতার মাহফিল আয়োজন করে জামায়াত। সেখানে বিএনপির এক ডজনের বেশি নেতাকে যোগ দিতে দেখা যায়। এ দুটি ইফতার পার্টি ঘিরে বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের মধ্যে নতুন করে রসায়ন তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন অনেকে। ফলে দুই দলের নেতাদের মধ্যে সম্প্রতি যোগাযোগও অনেক বেড়েছে বলে জানা গেছে।
আরও পড়ুনদুঃসময় চলছে, সবাই ঐক্যবদ্ধ হোন: ফখরুলসব নাগরিক সাংবিধানিকভাবে রাজনীতি করার অধিকার রাখেঢাকা মহানগর উত্তর জামায়াতের প্রচার-মিডিয়া সম্পাদক মুহাম্মদ আতাউর রহমান সরকার জাগো নিউজকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে দেশে অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক কোনো নির্বাচন হচ্ছে না। এখনকার তথাকথিত নির্বাচনে অনেক রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে না। কারণ, নিরপেক্ষ নির্বাচন হচ্ছে না। সারাদেশে জামায়াতের সব অফিস বন্ধ। অসংখ্য নেতাকর্মী কারাগারে। বাড়িতে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। এসব কারণেই জামায়াত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যাচ্ছে না। বিএনপিও আন্দোলন করছে, তারা তাদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
‘যারা আন্দোলনে আছে এবং উপজেলা নির্বাচন বর্জন করেছে, সমন্বিতভাবে না হলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে। আন্দোলনকারী সবার সঙ্গেই আমাদের যোগাযোগ রয়েছে, এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।’- বিএনপি নেতা এমরান সালেহ প্রিন্স
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বর্জন করে রাজনৈতিকভাবে কী অর্জন করতে চায় জামায়াত- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা তো নির্বাচনই না। এখানে যাওয়া না যাওয়া একই কথা। বর্জন বা গ্রহণের কোনো ব্যাপার এখানে নেই।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স জাগো নিউজকে বলেন, যারা আন্দোলনে আছে এবং উপজেলা নির্বাচন বর্জন করেছে, সমন্বিতভাবে না হলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে। আন্দোলনকারী সবার সঙ্গেই আমাদের যোগাযোগ রয়েছে, এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
রাজধানীর আরামবাগে সমাবেশ করে জামায়াত
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও প্রচার সম্পাদক অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, দল হিসেবে জামায়াত নিজস্ব চিন্তায় উপজেলা নির্বাচন থেকে সরে এসেছে। আসলে বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি বা বিশেষ পরিকল্পনা কোনো বিষয় নয়। দেশে গণতন্ত্র ফেরাতে যারাই রাজপথে থাকবে তাদের সঙ্গেই ঐক্য হবে, এটিই স্বাভাবিক।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, দেশ ও জাতির মুক্তির লক্ষ্যে সবাই মিলে রাজপথে নামার কোনো বিকল্প নেই। সেজন্য রাজপথে থাকা সবার সঙ্গে বিএনপি ছিল এবং আছে।
কেএইচ/এমকেআর/জিকেএস