মতামত

আমরা চেয়েছিলাম একটি সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়তে

আমাদের জাতীয় পতাকার গর্বিত অংশীদার- শিব নারায়ণ দাস। তিনি বলছিলেন, ‘পতাকাতো এমনিই আসেনি; স্বপ্নতো ছিলই। আমি শুধু এ কাজটি করিনি আরোও অনেক কিছুই করেছি। কতকিছুই না পড়েছি। বড় হয়ে বুঝেছি একটার সঙ্গে আরেকটা সম্পৃক্ত। রাজনীতির জন্যে অনেক কিছুই জানতে হয়।’ ২০১৬ সালের ৩ নভেম্বর বিকেল। অফিস শেষে পৌঁছে যাই মণিপুরের ৫ নম্বর গেইটের বাসায়। যদিও শুরুতে নিজের সম্পর্কে তেমন কিছুই বলতে রাজি ছিলেন না। প্রচার সর্বস্বতার যুগে তিনি হেঁটেছিলেন উল্টোপথে। নির্লিপ্ত, আশ্চর্যরকম নিঃশ্চুপ। তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টিতে তীব্র অভিমান।

Advertisement

আমার সৌভাগ্য তিনি সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হয়েছিলেন। শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটের ‘অন্তরে’ এর অংশীদার হওয়ায় যোগাযোগের একটি পূর্ব সূত্র ছিল। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ‘শিবু দা’ হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিলেন। তিনি বলেছিলেন মা যোগমায়া দাস আর দেশ মাতৃকা- বাংলাদেশের কথা। শৈল্পিক বর্ণমালায় ডায়েরির একটি পাতায় লিখেন মা সম্পর্কে তাঁর অনুভব। সেদিন তাঁর হাতের লেখা এবং কয়েকটি আলোকচিত্র আমার জীবনের এক অনন্য সঞ্চয়।

কথোপকথনের একপর্যায়ে জানতে চেয়েছিলাম তাঁর যুদ্ধদিনের কথা। একাত্তরে তাঁর মা এর অনুপ্রেরণা কিংবা আত্মত্যাগের কথা। আমি শুনতে চেয়েছিলাম গৌরবময় ইতিহাস- মুক্তিযুদ্ধের কথা। তাঁর সংগ্রাম, আন্দোলন কিংবা মুক্তিযুদ্ধের কোনো কথাই তিনি বলতে রাজি ছিলেন না। আমাকে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হয়েছিলেন নিঃসন্দেহে মা যোগমায়া দাস সম্পর্কে কিছু বলবেন সে কারণে। তাঁর সমস্ত সত্তা জুড়ে ছিলেন মা- যোগমায়া দাস। একাত্তরের মার্চ মাসের এক সকালে মা যোগমায়া দাস, ছেলেকে বলেন, ‘‘তুমি আর এ শহরে থেকো না, পুলিশ তোমাকে খুব খুঁজছে। তোমার বাবাকে নিয়ে চিন্তা করছিনা যতটা দুঃশ্চিন্তা করছি তোমাকে নিয়ে।’মেয়েদের নিয়েও দুঃশ্চিন্তা ছিল। মা বললেন, ‘‘তুমি যাও। আমি কিছুটা গুছিয়ে সীমান্ত পার হয়ে ত্রিপুরায় চলে আসবো’’।

সেদিন যদিও তাঁর স্বভাবের বাইরে অনেক কথা বলেন। শুধু মায়ের কথাই না, বাবা- সতীশচন্দ্র দাস এবং কাকার যুদ্ধে শহীদ হওয়ার কথা। নিজের কথা, পরিবারের কথা। আট ভাই - বোন আর মা-বাবা, কাকাদের নিয়ে একান্নবর্তী পরিবার । বলেন শৈশব - কৈশোরের কথা। মুক্তিযোদ্ধা স্ত্রী গীতশ্রীর কথা, একমাত্র সন্তান অর্নব আদিত্য দাসের কথা।

Advertisement

শিব নারায়ণ দাস বলছিলেন, ‘‘দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেও ‘ওয়ান্টেড’ ছিলাম, স্বাধীনতার পরেও ছিলাম ‘ওয়ান্টেড’ । -১৯৬৩ সালে স্বাধীন হওয়ার আগে জেলে ছিলাম, ১৯৭২ সালে স্বাধীন দেশেও জেলে যেতে হয়।’’ কুমিল্লা শহরে মাইকিং করে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। শিব নারায়ন দাসকে পুলিশে ধরিয়ে দিলে ৩০০ টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। পাশ দিয়েই হেঁটে যাওয়ার সময় মাইকের ঘোষণা শুনছিলেন তিনি। চশমা চোখে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পথ চলছিলেন। ছদ্মবেশের কারণে শিব নারায়ণ দাসকে অন্যরা সেদিন চিনতে পারেনি।

শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে তাঁর রাজনৈতিক চেতনা তৈরি হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন জীবন বোধ গঠনে। তিনিই ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক শিক্ষক। স্কুলে পড়ার সময় ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংস্পর্শে আসেন। বিভিন্ন সভায় যেতেন। দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক ভাবনার বিভিন্ন বইপত্র পড়তেন। দেশের প্রতি আত্মনিবেদন ছাড়া কোনো কিছুই ধ্যান ছিল না। বিপ্লবের জন্য মানসিকভাবে তৈরি ছিলেন। কোনো ভয়ভীতি, পিছুটান ছিল না। রাজনীতিতে ‘‘কামিনী-কাঞ্চন বিপ্লব পরিপন্থী’’ উপদেশ স্মরণ রাখতেন। নিজের একাগ্রতা- ধ্যান, জ্ঞান ছিল দেশ আর রাজনীতিতে। আদর্শিক ভাবনায় নিঃস্বার্থভাবে দেশের সেবা করতেন। বৈষয়িক বিষয় তাকে আকর্ষণ করেনি।

পতাকার নকশা নিয়ে স্মৃতিচারণের অনুরোধে তিনি বলেন, ‘এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না। কারণ বলতে গেলে অনেক অপ্রিয় সত্য বলতে হয়। সব অপ্রিয় সত্য বলার সময় এখানো আসেনি। সময় হলে সব একসঙ্গেই বলব।’ শিব নারায়ণ দাস বলেন, ‘যে আদর্শ নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, স্বাধীনতার পর সেই আদর্শ ছিনতাই হয়ে গেছে। আমরা একটি প্রকৃত বিপ্লব বা আমূল পরিবর্তন চেয়েছিলাম যেখানে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য আর ঘুষ-দুনীতি থাকবে না। আমরা চেয়েছিলাম একটি সুখী-সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়তে। কিন্তু তা হয়নি।’

১৯৬২ শিক্ষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সব আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। সব রকমের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, মিছিল, অবরোধে আর আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন তিনি। ১৯৬৩ সালে শিবনারায়ণ দাসের জেল জীবন শুরু হয় । সেসময়ে তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৭২ সালে তাঁকে আবারো স্বাধীন দেশে জেলে যেতে হয়। স্বাধীনতার আগে মুক্তিকামী মানুষের পতাকা ছিল গাঢ় সবুজ জমিনের ভেতর লাল সূর্য। আর সূর্যের মাঝে হলুদ সোনালী রঙে আঁকা বাংলাদেশের মানচিত্র। ১৯৭০ সালের উত্তাল দিনগুলোতে এবং একাত্তরের রণাঙ্গনে এই পতাকা হয়ে দাঁড়ায় স্বাধীন বাংলার প্রতীক। দেশ-বিদেশে প্রচার পায় এ পতাকা। কিন্তু বরাবরই লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে গেছেন ঐতিহাসিক পতাকাটির নকশাকার শিব নারায়ণ দাস।

Advertisement

স্বাধীন বাংলার পতাকা প্রসঙ্গে বলছিলেন, ‘‘২ মার্চ স্বাধীন বাংলার পতাকার জন্য একটি বিশেষ দিন হলেও এর জন্ম আরো আগেই। ১৯৭০ সালের ৭ জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার পল্টন ময়দানে ছাত্রদের এক সামরিক কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অংশ নেওয়ার কথা ছিল। ছাত্রদের নিয়ে জয়বাংলা বাহিনী গঠন করা হয়। সিদ্ধান্ত হয় একটি পতাকা তৈরির। এক দিন আগে (৬ জুন ‘৭১) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (এখন সার্জেন্ট জহুরুল হক ছাত্রাবাস) ১১৬ নম্বর কক্ষে ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমদ ও মার্শাল মনিরুল ইসলাম পতাকার পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে বসেন। এতে আরো উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা স্বপন কুমার চৌধুরী, জগন্নাথ কলেজের ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু ও ছাত্রনেতা ইউসুফ সালাউদ্দিন। সেসভায় আমিও উপস্থিত ছিলাম। আমি ছিলাম তখন কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্র্র্রীয় ছাত্রনেতা ।

সভায় কাজী আরেফের প্রস্তাবনায় আলোচনা হয়। সবুজ জমিনের ওপর লাল সূর্যের মাঝে হলুদ রঙের বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। কামরুল আলম খান তখন ঢাকা নিউমার্কেটের এক বিহারি দরজির দোকান থেকে বড় এক টুকরো সবুজ কাপড়ের মাঝে লাল একটি বৃত্ত সেলাই করে আনেন। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তিতুমীর হলের ৩১২ নম্বর কক্ষের এনামুল হকের কাছ থেকে অ্যাটলাস নিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকা হয় পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। আমি আঁকাআঁকি করতে পারতাম। স্কুলে পড়ার সময়ে বিভিন্ন পোস্টার ডিজাইন করেছি। আমার উপর দায়িত্ব পড়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা নকশার।

নিউ পাক ফ্যাশন টেইলার্সের মাস্টার খালেক মোহাম্মদী পতাকার নকশা বুঝে কাজ শুরু করেন। তারা ভোরের মধ্যেই কয়েকটি পতাকা তৈরি করে দেন। পরদিন ৬ দফা দিবস উপলক্ষে পল্টন ময়দানে শ্রমিক লীগের সমাবেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে তুলে দেওয়া হয় সেই পতাকা। পরে ওই পতাকা নিয়েই স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয় বাংলাদেশ। মানচিত্রে গাঢ় সবুজ জমিনের ভেতর লাল বৃত্তের সূর্যের মাঝে সোনালি হলুদ রঙের বাংলার মানচিত্র আঁকি। পরে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে পটুয়া কামরুল হাসান বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার নতুন রূপ দেন।’

শিব নারায়ণ দাশের তৈরি করা বাংলাদেশের মানচিত্র সম্বলিত এই পতাকা ধরেই হয়েছিল স্বাধীনতার সংগ্রাম। সরকারি নথিপত্র, পাঠ্যপুস্তক বা গণমাধ্যমেও বরাবর উপেক্ষিত পতাকার নকশাকারের নাম। কোনো রাষ্ট্রীয় পদক বা স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। শিব নারায়ণ দাসের এসব নিয়ে আক্ষেপ নেই। জয় বাংলার পতাকার এই নকশাকার এ নিয়ে গণমাধ্যমে কোনো কিছু বলতেও নারাজ ছিলেন। বিভিন্ন সময়ের সাংবাদিক কিংবা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনুসন্ধানকারীগণ সাক্ষাৎকারের জন্য যোগাযোগ করলে নিভৃতচারী শিব নারায়ণ দাস বিনয়ের সঙ্গে বরাবর প্রত্যাখ্যান করেন ।

সেদিন সাক্ষাৎকারের শেষ পর্যায়ে স্বাধীন বাংলার পতাকার নকশা নিয়ে স্মৃতিচারণের অনুরোধে তিনি বলেন, ‘এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না। কারণ বলতে গেলে অনেক অপ্রিয় সত্য বলতে হয়। সব অপ্রিয় সত্য বলার সময় এখানো আসেনি। সময় হলে সব একসঙ্গেই বলব।’ শিব নারায়ণ দাস বলেন, ‘যে আদর্শ নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, স্বাধীনতার পর সেই আদর্শ ছিনতাই হয়ে গেছে। আমরা একটি প্রকৃত বিপ্লব বা আমূল পরিবর্তন চেয়েছিলাম যেখানে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য আর ঘুষ-দুনীতি থাকবে না। আমরা চেয়েছিলাম একটি সুখী-সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়তে। কিন্তু তা হয়নি।’

জাতীয় পতাকার রুপকার শিব নারায়ণ দাস নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১৯ এপ্রিল সকাল ৯.২৫ মিনিটে বেসরকারি হাসপাতালে অনন্ত যাত্রা করেন। মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল তাঁর আমৃত্যু। আত্মত্যাগী এ মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর পর দেহ দান করেছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণায়। কর্নিয়া দান করছেন সন্ধানীতে। শ্রদ্ধায় স্মরণ করি জাতীয় পতাকার ইতিহাসের অংশীদার নির্মোহ ও দ্রোহী শিব নারায়ণ দাসকে ।

লেখক: গবেষক, পরিবেশবিদ।

এইচআর/এমএস