বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) অন্যতম সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। সংগঠনটি বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামে সামনের কাতারে থেকে মূলদলের ভ্যানগার্ড হিসেবে কাজ করে আসছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকলেও এখনো বিএনপির আস্থার জায়গায় রয়েছে সংগঠনটি।
Advertisement
এজন্য দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পরপরই নতুন করে ঢেলে সাজানো হয়েছে ছাত্রদলের নেতৃত্ব। এরই অংশ হিসেবে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবাল খান ও সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েলের নেতৃত্বাধীন কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। রাকিবুল ইসলাম রাকিবকে সভাপতি ও নাছির উদ্দীন নাছিরকে সাধারণ সম্পাদক করে সাত সদস্যবিশিষ্ট নতুন আংশিক কমিটি করা হয়েছে চলতি বছরের ১ মার্চ।
কমিটি যদি আমাদের জুনিয়র ব্যাচ থেকে হতো তাহলে অবশ্যই আমরা স্বেচ্ছাসেবক দল বা যুবদলে যাওয়ার ব্যাপারে ভাবতাম। কিন্তু কমিটি যেহেতু আমাদের ব্যাচ থেকেই এসেছে এবং আমাদের ব্যাচই নেতৃত্ব দিচ্ছে সেহেতু এবারও আমরা সহ-সভাপতি হিসেবে থাকবো।- বলছেন গত কমিটির নেতারা
তবে কমিটি গঠনের দুই মাস হতে চললেও এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারেনি কেন্দ্রীয় সংসদ। পূর্ণাঙ্গ কমিটি কেন গঠন যাচ্ছে না এ নিয়ে ভিন্ন কথা শোনা যাচ্ছে সংগঠনটির নেতাকর্মীদের মধ্যে। গুঞ্জন আছে বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুলের অযাচিত হস্তক্ষেপ নিয়েও। যে কারণে সভাপতি ও সম্পাদক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না, সংগঠনের নানা পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে এমনটিও। একই সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে সেশনভিত্তিক জটিলতাসহ নানা প্রতিবন্ধকতার কথা জানিয়েছেন সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা।
Advertisement
আরও পড়ুন
ছাত্রদল কখনো বিএনপির কমান্ডে পরিচালিত হয় না জিয়াউর রহমানের সমাধিতে ছাত্রদলের নতুন কমিটির শ্রদ্ধা ঢাবির দুই ছাত্র ছাত্রদলের দায়িত্বেরকিবুল ইসলাম বকুল নিজের বলয় শক্তিশালী করতে তার অনুগতদের সমন্বয়ে আনুমানিক ৬০ সদস্যের একটি কমিটির খসড়া তৈরি করেছিলেন বলে কানাঘুষা আছে খোদ ছাত্রদল নেতাদের ভেতরে। কিন্তু এটি নিয়ে ছাত্রদল সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি। ছাত্রদল সভাপতি রাকিবও নিজ অনুগতদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করতে মরিয়া, বাতাসে ভাসছে এ ধরনের কথাও। ফলে শেষ পর্যন্ত বিষয়টি স্থগিত হয় এবং তা ছাত্রদলের সাংগঠনিক অভিভাবক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান পর্যন্ত গড়ায়। এরপর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের পদক্ষেপ আর বেশিদূর এগোয়নি।
কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিব ও সম্পাদক নাছির
ছাত্রদল নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমান সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৬-০৭ সেশনের শিক্ষার্থী। ছাত্রদলের গত কমিটিতে (শ্রাবণ-জুয়েল) ২০০৬-০৭ এবং ২০০৭-০৮ সেশনের অধিকাংশ নেতা সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৮-০৯ ও ২০০৯-১০ সেশনের অধিকাংশ নেতা যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
Advertisement
২০০৬-০৭ সেশন থেকে সভাপতি হওয়ায় এবারও ওই সেশনের নেতারা স্বাভাবিকভাবেই সহ-সভাপতি হিসেবে থাকবেন। একই সঙ্গে গত কমিটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদকরাও চাইবেন সহ-সভাপতি অথবা ফের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে থাকতে। ফলে নতুন কমিটির শীর্ষ নেতৃত্ব এ পদগুলোতে নতুন কাউকে আনতে পারছেন না।
কথা হয় গত কমিটিতে সহ-সভাপতি পদে থাকা বেশ কয়েকজন ছাত্রদল নেতার সঙ্গে। আবারও সহ-সভাপতি হিসেবে থাকবেন নাকি ছাত্রদলের রাজনীতি ছেড়ে যুবদল বা স্বেচ্ছাসেবক দলের রাজনীতিতে যাবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জাগো নিউজকে বলেন, কমিটি যদি আমাদের জুনিয়র ব্যাচ থেকে হতো তাহলে অবশ্যই আমরা স্বেচ্ছাসেবক দল বা যুবদলে যাওয়ার ব্যাপারে ভাবতাম। কিন্তু কমিটি যেহেতু আমাদের ব্যাচ থেকেই এসেছে এবং আমাদের ব্যাচই নেতৃত্ব দিচ্ছে সেহেতু এবারও আমরা সহ-সভাপতি হিসেবে থাকবো। তারা মনে করেন, ছাত্রদলের রাজনীতি মূলত অনেকটাই সেশনভিত্তিক হয়ে থাকে। ফলে নিজে থেকে সরে না গেলে কাউকে বাদ দেওয়ার খুব বেশি সুযোগ নেই।
রাজনীতি কোনো চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়, বরং তা আদর্শ ধারণ করে স্বাধীন ও মুক্তভাবে এগিয়ে চলা। এক্ষেত্রে কোন সেশন থাকবে আর কোন সেশন থাকবে না এটি সুনির্দিষ্ট নয়। সংশ্লিষ্ট কর্মী সংগঠনের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে তার স্থান ও ক্ষেত্র নির্ধারণ করবে।- ছাত্রদল নেতা সোহেল রানা
নেতাকর্মীরা জানান, জটিলতা আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেন্দ্রীয় সংগঠনে যেতে আগ্রহী নেতাকর্মীদের নিয়েও। এবার ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাত সদস্যের আংশিক কমিটিতে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে ২০১২-১৩ সেশনের শিক্ষার্থী নূর আলম ভুঁইয়া ইমনকে সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে রাখা হয়েছে। ফলে এর আগের তিনটি সেশনের নেতাকর্মীরা আর বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় কাজ করবেন না। সংগঠনের ঐতিহ্যগতভাবেই তারা কেন্দ্রীয় সংগঠনের হয়ে কাজ করবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি শেষ করে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে যাওয়া নেতাকর্মীরা সাধারণত যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক বা সমমর্যাদার পদে দায়িত্ব পেয়ে থাকেন। কিন্তু এবার সেই পদগুলোতে আগের কমিটির সম্পাদকরা থাকায় নতুন করে যাওয়া নেতাকর্মীদের নিয়ে তৈরি হয়েছে এক ধরনের জটিলতা।
এদিকে, একই দিন গত ১ মার্চ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এ বি এম ইজাজুল কবির রুয়েল এবং সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন বিদ্যমান কমিটি বিলুপ্ত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সাত সদস্যের নতুন আংশিক কমিটি অনুমোদন করা হয়। নবগঠিত এ কমিটিতে গণেশ চন্দ্র রায় সাহসকে সভাপতি এবং নাহিদুজ্জামান শিপনকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে৷
ঢাবি শাখার সভাপতি গণেশ ও সম্পাদক শিপন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে যুক্ত হতে আগ্রহী ঢাবি শাখার সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (২০১১-১২) সোহেল রানা জাগো নিউজকে বলেন, রাজনীতি কোনো চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়, বরং তা আদর্শ ধারণ করে স্বাধীন ও মুক্তভাবে এগিয়ে চলা। এক্ষেত্রে কোন সেশন থাকবে আর কোন সেশন থাকবে না এটি সুনির্দিষ্ট নয়। সংশ্লিষ্ট কর্মী সংগঠনের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে তার স্থান ও ক্ষেত্র নির্ধারণ করবে।
আরও পড়ুন
ঢাবি ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ, সম্পাদক নাহিদ ইডেন কলেজ ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক সুমাইয়া ছাত্রদলের ‘লোকদেখানো’ ছাত্র ঐক্য, বিশৃঙ্খল ও ফলশূন্য হওয়ার শঙ্কা‘সেশনের সবার রাজনৈতিক অবদান সমান নয়। রাজপথের সক্রিয়তা বিবেচনায় সংগঠন এবং সংগঠনের অভিভাবক নির্ধারণ করবেন কে কোন পদ পাবেন। এক্ষেত্রে সেশন কোনো নির্ধারক নয় বলে আমি মনে করি’- বলেন তিনি।
কমিটি গঠন সবসময়ই একটি জটিল প্রক্রিয়া। দীর্ঘদিন নেতাকর্মীদের পরিশ্রমের পর কমিটিতে তাদের পদপ্রাপ্তির একটি বিষয় থাকে। এটিই স্বাভাবিক বাস্তবতা। এ জটিলতা নিরসনের জন্য আমরা কিছু কৌশল অবলম্বন করছি।- ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম
কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির জাগো নিউজকে বলেন, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্বে যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আমরা রয়েছি সে আন্দোলন শক্তিশালী করতে যারা অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন তাদেরই কমিটিতে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করছি। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্য যারা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক কাজ করছেন, তারাও মূল্যায়িত হবেন।
সহ-সভাপতি ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের মতো পদগুলোতে নতুন মুখ না আসার সম্ভাবনা কতটুকু- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলো আসলে সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের বিষয়। আমরা এগুলো নিয়ে কাজ করছি। আমাদের সাংগঠনিক অভিভাবক বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। যেহেতু এগুলো সাংগঠনিক বিষয়, তাই সাংগঠনিক নিয়মের মধ্যে থেকেই আমরা এসব বিষয়ের সমাধান করতে পারবো বলে বিশ্বাস করি।
জিয়াউর রহমানের সমাধিতে নতুন কমিটির নেতারা শ্রদ্ধা জানান
পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে সৃষ্ট জটিলতার সমাধান কোন প্রক্রিয়ায় হতে পারে- জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব জাগো নিউজকে বলেন, আমরা পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছি। আশা করি খুব দ্রুতই সেটি দিতে পারবো। কমিটি গঠন সবসময়ই একটি জটিল প্রক্রিয়া। দীর্ঘদিন নেতাকর্মীদের পরিশ্রমের পর কমিটিতে তাদের পদপ্রাপ্তির একটি বিষয় থাকে। এটিই স্বাভাবিক বাস্তবতা। এ জটিলতা নিরসনের জন্য আমরা কিছু কৌশল অবলম্বন করছি।
‘আমরা বিশ্বাস করি, সমস্যাগুলোর সহজ সমাধান দিতে সক্ষম হবো। কমিটি গঠনে সেশনভিত্তিক জটিলতা, গত কমিটিতে সহ-সভাপতি, যুগ্ম সম্পাদক যারা ছিলেন তাদের বিষয়ে সহজ, সঠিক ও যুগোপযোগী সমাধান বের করতে পারবো বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী।’
ছাত্রদল সভাপতির ভাষ্য, আমরা কাজে হাত দিয়েছি, প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। সে প্রক্রিয়ায় এখন পর্যন্ত বড় কোনো জটিলতা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। যেসব ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা মনে হচ্ছে সেগুলো সাংগঠনিকভাবেই আমরা সমাধান করতে সক্ষম হবো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা দীর্ঘদিন লড়াই-সংগ্রাম করে কেন্দ্রীয় সংসদে সাবেক পদে ছিলেন এবং যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কমিটিতে ছিলেন তাদের সবাইকে আমরা সঠিক মূল্যায়ন করবো।
হাসান আলী/এমকেআর/এএসএম