বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. রেহমান সোবহান বলেছেন, ‘আমাদের নিয়মভিত্তিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দরকার, ব্যক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান নয়। অনেকে বিশ্বাস করেন না যে বাংলাদেশে কোনো নিয়ম-কানুন রয়েছে।’
Advertisement
তিনি বলেন, ‘আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই বুঝতে চাই যে আমাদের উচ্চ প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও কেন পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ কম? আমাদের বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠানের অনুপস্থিতির কারণ তদন্ত করা উচিত।’
রোববার (২১ এপ্রিল) ব্র্যাক সেন্টার ইন অডিটোরিয়ামে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) আয়োজিত ‘ইজ দ্য বাংলাদেশ প্যারাডক্স সাসটেইনেবল?’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি। বইটির সম্পাদনা করেন ড. সেলিম রায়হান, ড. ফ্রাসোঁয়া বুরগনিওন এবং ড. উমর সালাম।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান। সম্মানিত অতিথি ছিলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. রেহমান সোবহান এবং যুক্তরাজ্যের আলস্টার ইউনিভার্সিটির উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক ড. এস আর ওসমানি। অনুষ্ঠানে ড. সেলিম রায়হান এবং ড. উমর সালাম বইটির ওপরে আলোচনা করেন। তাদের বক্তব্য শেষে উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং শিক্ষাবিদরা। যাদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক মাহবুবুল মোকাদ্দেম আকাশ, ড. মির্জা এম হাসান, ড. কাজী মারুফুল ইসলাম, ড. মনজুর হোসেন এবং ড. সায়েমা হক বিদিশা।
Advertisement
ড. রেহমান সোবহান বলেন, ‘একটি বিস্তৃত বিশ্লেষণমূলক কাঠামোর মধ্যে অন্য দেশগুলো অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। প্রবৃদ্ধির কথা বিবেচনা করার সময় আমরা কেবল বাংলাদেশের প্যারাডক্সই নয়, ভিয়েতনাম এবং চীনের প্যারাডক্সও লক্ষ্য করি। অত্যন্ত দুর্বল প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও তারা অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশ্লেষণ করা দরকার যেগুলো নিয়মভিত্তিক নয়, লিখিত আইন অনুসারে কাজ করে না। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা হয় যখন একটি নিয়মভিত্তিক ব্যবস্থা থেকে বিদায় নেওয়া হয়। মানুষ তখন কোনো প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বাস করতে অস্বীকার করে।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. মশিউর রহমান ট্যাক্সের বৈধতা এবং কার্যকরভাবে ট্যাক্স সংগ্রহের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্রের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, কর নীতিগুলোও যাচাইয়ের আওতায় আসা উচিত। এসময় তিনি সম্পূরক শুল্ক এবং মূল্য সংযোজন, একই সঙ্গে রাজস্ব বৃদ্ধির আগে আবগারি শুল্কের আরও সুনির্দিষ্ট প্রয়োগের তাগিদ দেন। তিনি টার্নওভার ট্যাক্স সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেন, পরামর্শ দেন যে এর প্রাথমিক কাজ রাজস্ব বৃদ্ধি করার পরিবর্তে ব্যবসায়িক ব্যক্তিদের রক্ষা করা। অনানুষ্ঠানিক আর্থিক লেনদেন সঞ্চয়কে বাধা দেয় এবং অনানুষ্ঠানিক আর্থিক লেনদেনে অর্থনৈতিক উপযোগিতার অভাবও রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এছাড়া ব্যাংকিং খাতে চলে আসা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার জটিলতা নিয়ে আলোচনা করেন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের গবেষণা পরিচালক ড. মঞ্জুর হোসেন জোর দিয়ে বলেন, যদি প্যারাডক্স থাকে, একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকা উচিত- যখন প্যারাডক্সটি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ যদি মধ্যম আয়ের মর্যাদা অর্জন করতে পারে, তাহলে এই প্যারাডক্স টিকে থাকতে পারবে না।
Advertisement
তিনি আরও বলেন, নিও-ক্লাসিক্যাল পরিস্থিতি বিবেচনা করলে রাজনৈতিক শাসন প্রাতিষ্ঠানিক পরিস্থিতির ওপর খুব বেশি প্রভাব ফেলে। রপ্তানি বহুমুখীকরণ, বাণিজ্য উদারীকরণের দিকে মনোনিবেশ করা উচিত।
অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান ওসমানি মেথোডলজির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে বলেন, প্রকল্পটিতে অকার্যকর প্রতিষ্ঠানগুলো চিহ্নিত করার ওপর জোর করা হয়েছে। কিন্তু কার্যকরী প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে তেমন আলোচনা হয়নি। যে প্রতিষ্ঠানগুলো আসলে ভালভাবে কাজ করছে সেগুলো নিয়ে কেন আমরা আলোচনা করি না? বাংলাদেশের প্যারাডক্সের চেয়েও এটি আরও বেশি প্যরাডক্সিক্যাল। আমাদের অবশ্যই একই সঙ্গে কার্যকর এবং অকার্যকর উভয় প্রতিষ্ঠান নিয়ে কাজ করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কাজী মারুফ বলেন, বিচারিক ব্যবস্থার অধ্যায়ে আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি কেন এত লোক তাদের জমি হারায়? আদালত সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তাদের পরিচালনা করার মতো অসংখ্য মামলা রয়েছে। প্রায় ৪ মিলিয়ন মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। আদালতের সমস্যা নিয়ে তিনি বলেন, পর্যাপ্ত বিচারক না থাকা, স্বাধীন না হওয়া, আইন সম্পর্কে জানা মানুষ না থাকা।িএসব পরিস্থিতি ভালো না হলে বিচারিক ব্যবস্থা বাংলাদেশের অগ্রগতি বন্ধ করে দেবে।
বইটিতে ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে কথা বলেছেন সানেমের গবেষণা পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সায়েমা হক বিদিশা। তিনি ব্যাংকিং অদক্ষতা এবং বিচার বিভাগের অদক্ষতা তুলে ধরেন। উল্লেখ করেন যে সরকারী পরিসংখ্যানে অসমতা প্রায়ই কম রিপোর্ট করা হয়। ড. বিদিশা বলেন যে প্রবেশাধিকার এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স আশ্চর্যজনকভাবে ভালো। তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের অভাবকে একটি তাৎপর্যপূর্ণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন, পরামর্শ দেন একটি শক্তিশালী, স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারে। ড. বিদিশা দুর্বল করপোরেট গভর্নেন্সকেও উদ্বেগ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ব্যাংক একীভূতকরণের সমস্যা তুলে ধরে তিনি অভ্যন্তরীণ সংস্কারের গুরুত্বের ওপর জোর দেন।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ড. জাইদি সাত্তার বক্তব্যের শুরুতেই একজন তরুণ হিসেবে তার দেখা সদ্য জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের আশার সঙ্গে ৫০ বছর পার করা বাংলাদেশের বাস্তবতার তুলনা করেন। তিনি বলেন, যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়, তখন আমি একজন তরুণ সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলাম। তখন আমাদের এই দেশ নিয়ে অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমার কিছু আশা ছিল, যার সঙ্গে হেনরি কিসিঞ্জারের হয়তো দ্বিমত হবে। বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ হওয়া কিংবা তৈরি পোশাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ হওয়ার কোনো প্রত্যাশা ছিল না। আজ ৫০ বছর পরে দেখি বিশ্ব ব্যাংকসহ বিভিন্ন দেশ আমাদের অর্থনীতিকে সফল হিসেবে চিহ্নিত করে।
বাংলাদেশি শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রমকে কৃতিত্ব দিয়ে ড. সাত্তার একে প্যারাডক্স হিসেবে চিহ্নিত করা থেকে বিরত থাকেন। তিনি উল্লেখ করেন কীভাবে জনসংখ্যা, যা কি না প্রাথমিকভাবে একটি সমস্যা হিসেবে বিবেচিত, এখন একটি সম্পদ হিসেবে দেখা হয়।
অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ বলেন, বইটির উপসংহারে এসেছে যে প্যারাডক্সকে টিকিয়ে রাখা প্রাতিষ্ঠানিক খাতের উন্নতির ওপর নির্ভর করে। তিনি ব্যাঙ্কিং সেক্টরে সহজে স্বায়ত্তশাসন প্রদানের অপ্রতুলতার ওপর জোর দেন, উল্লেখ করেন, নেতিবাচক শক্তি প্রায়ই ইতিবাচক শক্তিকে ছাপিয়ে দেয়, সংস্কারকে কঠিন করে তোলে।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভার্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি)-র সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মীর্জা এম হাসান বলেন, বিশ্বব্যাপী ব্যাংকিং খাতে যা ঘটছে তা নিয়ে খুব বেশি কিছু গোপন নেই। তিনি উল্লেখ করেন, কিছু সময়ের জন্য স্টেট ক্যাপচার চলছে, যা বেসরকারি খাত নিয়ন্ত্রক নীতিগুলোকে প্রভাবিত করে। তিনি প্রশ্ন তোলেন যে ব্যাংকিং সেক্টরে ক্যাপিটালের যুক্তির আধিপত্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উদার পুঁজিবাদের দিকে যাচ্ছে নাকি রাজনৈতিক ক্রোনিজমের পরিপ্রেক্ষিতে চীনের মতো রাজনৈতিক পুঁজিবাদের দিকে যাচ্ছে? তিনি মন্তব্য করেন, ‘আমরা বাংলাদেশে ডমিন্যান্ট পার্টি স্টেটের একটি খুব দ্রুত আত্মীকরণ দেখতে পাচ্ছি।’
ইএআর/কেএসআর/জিকেএস