এক সপ্তাহ ধরে পাবনায় বইছে প্রচন্ড দাবদাহ। বাতাসে যেন আগুন জ্বলছে। এতে বিপাকে পড়েছেন কৃষক-শ্রমিকসহ খেটে খাওয়া মানুষ। একইসঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে বৃষ্টির দেখা নেই। তীব্র তাপপ্রবাহে পাবনার সব এলাকার খাল-বিল শুকিয়ে গেছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সাধারণ নলকূপে উঠছে না পানি।
Advertisement
এদিকে, প্রচন্ড গরমে শ্রমজীবীরা ক্ষেতে এক বেলার বেশি কাজ করতে পারছেন না। অনেক কৃষক অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। পর্যাপ্ত পানি না পাওয়ায় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে গোটা জেলার কৃষি। চাষিরা খরার হাত থেকে জমির ফসল রক্ষায় সেচ দিতে প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছেন। ক্ষেতের ফসল বাঁচাতে অন্য বারের তুলনায় তিন গুণ বেশি সেচ দিতে হচ্ছে, যার ফলে উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে। আর অনিয়ন্ত্রিত পানি উত্তোলনে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছরই অস্বাভাবিক হারে নিচে নামছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঈশ্বরদী আবহাওয়া অফিস সূত্র জানায়, সপ্তাহজুড়ে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি বা এর আশেপাশে ওঠানামা করছে। শনিবার (২০ এপ্রিল) বেলা ৩টায় জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) ছিল ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া বাতাসের আর্দ্রতা ১৪-১৫ তে ঘোরাফেরা করছে। আর্দ্রতা বেশি থাকায় ভ্যাপসা গরমে জনজীবনে নেমে এসেছে তীব্র অস্বস্তি।
স্থানীয় চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত সপ্তাহে দুই দিন আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখা দিলেও বৃষ্টি হয়নি। প্রকৃতির বিরূপ আচরণে তারা চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। গত বছর দীর্ঘতম খরার কবলে পড়ে তারা ক্ষতির শিকার হয়েছেন। এক বছরের মাথায় আবার খরার কবলে পড়ে তারা মহাসংকটে।
Advertisement
তারা জানান, গভীর নলকূপের মাধ্যমে বোরো জমিতে সেচ দেওয়া গেলেও ঘাস, পাট ও তিলের জমিতে সেচের ব্যবস্থা করা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
কৃষি সংশ্লিষ্টরা জানান, তাপপ্রবাহ অনেক সময় কৃষকদের ভালো ফলন এনে দেয়। তবে এ মূহূর্তের তাপমাত্রার তীব্রতা কৃষকদের জন্য চরম ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষেতের ফসল বাঁচাতে অন্য বারের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি সেচ দিতে হচ্ছে, ফলে উৎপাদন খরচও বেড়ে যাবে। এমন আবহাওয়া দীর্ঘায়িত হলে চলতি মৌসুমের ধানসহ অন্যান্য ফল-ফসলের সামগ্রিক উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে অন্তত ৩০ শতাংশ।
শনিবার কথা হয় বিল গ্যারকা পাড়ের চাষিদের সঙ্গে। তারা জানান, তাদের অগভীর নলকূপ লেয়ার ফেল করছে। অনেক চাষি বিলে শ্যালো ইঞ্জিন লাগিয়ে পানি নেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বিলের অধিকাংশ স্থান শুকিয়ে গেছে। ফলে তারা মারাত্মক সেচ সংকটে পড়েছেন। অনেকে জানান, তার পাট বুনতে পারছেন না। তিল বুনলেও বৃষ্টির অভাবে তা থেকে চারা গজায়নি। সেচ দিতে অতিরিক্ত খরচের মুখে পড়েছেন তারা।
বিলপাড়ের চাষি আবুল হোসেন বলেন- ধান, পাট, ভুট্টা লাগিয়েছি। ২-৩ বার সেচ দিয়েছি। কিন্তু এরপরও কাজ হচ্ছে না। আমার শ্যালো মেশিন লেয়ার ফেল করায় জমি থেকে তুলে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। আমি কোনভাবে খরচ পোষাতে পারছি না।
Advertisement
শফিকুল ইসলাম নামে আরেক চাষি জাগো নিউজকে বলেন, এ পর্যন্ত তিনবার সেচ দিয়েছি । একবার সেচ দিতে ১৫০০- ২০০০ টাকা খরচ হয়। এতে করে আমরা পোষাতে পারছি না। তিনবার সেচ দেওয়ার পর যে ফসল পাবো তাতে উৎপাদন খরচ উঠবে না।
চাষি নজরুল ইসলাম জানান, তীব্র গরমের জন্য তারা শনিবার জমিতে অস্থির হয়ে কাজ ফেলে চলে গেছেন। শ্রমিকরাও সারাদিন কাজ করতে পারছেন না। এতে তাদের সংসারের খরচ চালাতেও সমস্যা হচ্ছে।
বাবু আলী নামের এক কৃষি শ্রমিক জানান, যেরকম তাপমাত্রা তাতে বেলা ১০টা পর্যন্ত কাজ করাই কঠিন। কৃষকের সঙ্গে দিনমজুররাও ক্ষতির মুখে বলে জানান তিনি।
ডাবলু হোসেন নামে আরেক কৃষক জানান, গ্যারকা বিলে ধান লাগিয়ে চাষিরা ক্ষতির মুখে। বিলের শত শত চাষি এবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারণ ক্ষেতের ধানে চিটা হবে বেশি। শাজাহান আলী নামের এক কৃষক বলেন, ২-৩বার সেচ দেওয়ার পরও জমি শুকিয়ে যাচ্ছে। উৎপাদন খরচ বাড়লেও ফসল বেচার সময় নানা কথা ওঠে। সরকার তো তাদের ভর্তুকিও দেয় না। আমরা এ ক্ষতি পোষাবো কিভাবে? এদিকে চলনবিল অধ্যুষিত ভাঙ্গুড়া উপজেলার উত্তর ও পূর্ব অঞ্চলের খানমরিচ, অষ্টমনিষা ও দিলপাশার ইউনিয়নের চাষিরা জানান, তাদের অধিকাংশ ফসলি মাঠ বন্যাপ্রবণ এলাকায় হওয়ায় শুধু সরিষা ও বোরো ধানের চাষ হয়।
অন্যদিকে দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের ভাঙ্গুড়া পৌরসভা ও সদর ইউনিয়ন, পারভাঙ্গুড়া এবং মণ্ডতোষ ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের আওতায় হওয়ায় ধানের পাশাপাশি রবিশস্য ও বিভিন্ন জাতের ঘাসের আবাদ বেশি হয়। মূলত এ অঞ্চলের অধিকাংশ কৃষকের পরিবার গবাদি পশুর আয়ের ওপর নির্ভরশীল। এসব গবাদিপশুর প্রধান খাদ্য হচ্ছে নেপিয়ার, জাম্বু ও গামা জাতীয় ঘাস। তবে এ বছর দীর্ঘদিন বৃষ্টি না থাকায় ঘাসের বৃদ্ধি হচ্ছে না। পাশাপাশি উঁচু জমিগুলোতে পর্যাপ্ত রসের অভাবে ঘাসের শিকড় শুকিয়ে যাচ্ছে। এতে গবাদিপশুর খাবারের জোগান দিতে খামারিদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
পাথরঘাটা গ্রামের চাষিরা জানান, গভীর নলকূপ গুলো থেকে চাহিদার অর্ধেক পরিমাণ পানি উঠছে। এ ছাড়া অগভীর নলকূপগুলোতে শুধু রাতের বেলায় কিছুটা পানি পাওয়া যায়। এতে মাঠের খাল-বিলে গভীর নলকূপের পানি কিছুটা জমা হলেও তা মুহূর্তেই শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে মাঠের ঘাস, পাট ও তিলের জমিতে পানি সেচ দিতে পারছে না কৃষক। এতে মাঠের শতাধিক বিঘা জমিতে ফসলের চারা শুকিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া ঘাসের জমিগুলোতে পানি সেচের অভাবে ঘাসের পাতা হলুদ হয়ে গেছে।
ওই গ্রামের কৃষক নায়েব জাগো নিউজকে আলী বলেন, সেচ দিতে না পেরে তিন বিঘা পাটের জমির চারা শুকিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া দুই বিঘা জমিতে ঘাসের চাষ করেছি। সেখানেও বৃষ্টি না হওয়ায় ঘাসের বৃদ্ধি হচ্ছে না। গভীর নলকূপের পর্যাপ্ত পানি না থাকায় কিনতে চেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, আগে জমিতে তিল চাষ করতাম। কিন্তু এ বছর বৃষ্টি না থাকায় তিল চাষ করতে পারিনি। আমার মত অনেক কৃষক খরার কারণে বিপদে পড়েছে।
উপজেলা সহকারী কৃষি অফিসার সুস্থির কুমার জাগো নিউজকে বলেন, দীর্ঘদিন বৃষ্টি না থাকায় এবং হঠাৎ তাপমাত্রার তীব্রতার কারণে ফসলের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ বছর পাট ও তিল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হতে পারে। তবে এখনো বৃষ্টি হলে অনেকেই পাট ও তিলের বীজ বপন করবেন। এ অবস্থায় কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে জমিতে সেচের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু অনেকেই তা পারছেন না।
পাবনায় দোতলা কৃষির উদ্ভাবক কৃষিবিদ জাফর সাদেক বলেন, ধান চাষের সময় সকাল ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর যদি ওঠে, তাহলে চিটার পরিমাণ বেশি হতে পারে। এ মুহূর্তে অনেকের মাঠের ধানে থোড় এসে পড়েছে, এখন ক্ষেতের মধ্যে কমপক্ষে দুই ইঞ্চি পানির ধারা থাকতে হবে। কিন্তু তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে চাইলেও সেই পানির প্রবাহ ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তাপমাত্রা বেশি থাকার কারণে ধানের ফুল পলিনেশন করতে পারছে না, অনেক ফুল ঝরে যাচ্ছে। একারণে ধারণা করা যায়, ধান চাষে গড়ে ৩০ শতাংশের মতো ক্ষতির মুখে পড়তে পারে কৃষক।
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পাবিপ্রবি) ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম জানান, জেলায় ভূগর্ভস্ত পানির স্তর প্রতি বছরই অস্বাভাবিক হারে নিচে নামছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনাবৃষ্টি সেই সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত পানি উত্তোলনে পানিশূন্যতার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এতে সেচ ও খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সাধারণ নলকূপে পানি মিলছে না। গভীর পাম্প বসিয়ে খাবার পানি তুলতে হচ্ছে। অনেক স্থানে তাতেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। অনাবৃষ্টির ফলে খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর শুকিয়ে গেছে। এতে কৃষির ওপর বিরুপ প্রভাব পড়ছে ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পাবনার উপ-পরিচালক ড. জামাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, খরা বা অনাবৃষ্টি একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এতে কারও কিছু করার নেই। তারপরও তারা চাষিদের ক্ষতি পোষাতে নানা পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। জমিতে সেচ চালু রাখার জন্য বলা হচ্ছে। আর সেচের জন্য বিদ্যুৎ যেন নিরবচ্ছিন্ন থাকে সে ব্যাপারে বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করায় সুফল পাওয়া যাচ্ছে।
আমিন ইসলাম জুয়েল/এনআইবি/জিকেএস