কৃত্রিম প্রজননের জন্য দেশে একসময় বিদেশ থেকে গবাদিপশুর সিমেন বা বীজ আমদানি করা হতো। উৎপাদন সক্ষমতা ছিল কম। গত দুই যুগে এ অবস্থায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিলে বাংলাদেশে এখন সিমেনের উৎপাদন সক্ষমতা চাহিদার চেয়ে বেশি।
Advertisement
সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে প্রায় এক কোটি দশ লাখ গাভি ও বকনার (মাদি বাছুর) মধ্যে প্রজননক্ষম ৮০ লাখ। এদের জন্য প্রতি বছর প্রায় এক কোটি ৬০ লাখ ডোজ সিমেন প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের (ডিএলএস) উৎপাদন সক্ষমতা ৪৫ থেকে ৫০ লাখ ডোজ সিমেন। বেসরকারি ছয়টি প্রতিষ্ঠান ও দুটি এনজিও মিলে সিমেন উৎপাদন সক্ষমতা আরও প্রায় এক কোটি ২০ লাখ ডোজ। পাশাপাশি প্রজননের জন্য আনুমানিক ১০ থেকে ২০ লাখ ডোজ সিমেন প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায়। অর্থাৎ, এখন সিমেনের আর কোনো ঘাটতি নেই।
দেশে প্রথম গবাদিপশুর কৃত্রিম প্রজনন শুরু হয় স্বাধীনতার পরে। ১৯৭৩ সালে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ১২৫টি ফ্রিজিয়ান ও জার্সি জাতের ষাঁড় অনুদান হিসেবে সংগ্রহ করার মধ্য দিয়ে সরকারিভাবে যাত্রা শুরু হয় কৃত্রিম প্রজননের। বেসরকারিভাবে ১৯৮৭ সালে এসে সরকারি ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে সীমিত পরিসরে সিমেন উৎপাদন শুরু করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক। পরবর্তীসময়ে ব্র্যাক ১৯৯৮ সালে বুল স্টেশন চালু করে, যারা দুই বছর পরে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যায়। ওই সময় পর্যন্ত দেশে সিমেনের উৎপাদন পাঁচ থেকে সাত লাখের বেশি ছিল না।
কৃত্রিম প্রজননে বড় সাফল্য এসেছে সবশেষ দুই যুগে। এর মধ্যে ক্রমান্বয়ে বেড়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উৎপাদন। প্রতিষ্ঠানটি সাভার কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন কেন্দ্র ও দুগ্ধ খামার এবং রাজশাহীর কৃত্রিম প্রজনন ল্যাবরেটরিসহ সারা দেশে আরও আটটি প্রজনন কেন্দ্র সিমেন উৎপাদন করছে। এসব কেন্দ্রে প্রত্যায়িত ষাঁড়ের সংখ্যা ১৯৪টি। যার মধ্যে সাভারে রয়েছে ১২৩টি। এখান থেকে এ পর্যন্ত ছয় কোটি ৬২ লাখ ডোজ সিমেন সংগ্রহ করা হয়েছে। গত বছর (২০২৩) উৎপাদন হয়েছে ৩৫ লাখ ৩০ হাজার ডোজ।
Advertisement
পরবর্তীসময়ে সিমেন উৎপাদনে আরও এসেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এসিআই, লাল তীর, আমেরিকান ডেইরি লিমিটেড, ইজাব অ্যালায়েন্স ও ঠাকুরগাঁও ডেইরি লিমিটেড। এছাড়া সজাগ (সমাজ ও জাতি গঠন), পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ) ও সমবায় প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটা সিমেন উৎপাদন করছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বাইরে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি বছর ১০ থেকে ১২ শতাংশ হারে উৎপাদন বাড়ছে।
কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম শুরুর পর থেকে দেশে দুধ উৎপাদনে বড় সফলতা এসেছে। ভালো জাত তৈরি হচ্ছে। তারপরেও আমাদের দুধের ঘাটতি রয়েছে। তবে এভাবে কৃত্রিম প্রজনন হতে থাকলে এক সময় দেশে সে ঘাটতি মেটানো সম্ভব।- প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কৃত্রিম প্রজনন দপ্তরের পরিচালক ডা. আনন্দ কুমার অধিকারী
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ব্র্যাক আর্টিফিশিয়াল ইনসেমিনেশন এন্টারপ্রাইজের এখন বছরে সিমেন উৎপাদন সক্ষমতা ৬০ লাখ ডোজ। বাণিজ্যিক উৎপাদনের দুই যুগ বাদে দেশের সবচেয়ে বড় সিমেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এটি। এখন এক লাখ ২০ হাজার খামারি প্রতিষ্ঠানটির কৃত্রিম প্রজনন সেবা পাচ্ছে। বছরে ২৬ লাখ গাভিকে কৃত্রিম প্রজনন সেবা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
ব্র্যাকের ময়মনসিংহ ও বগুড়ায় নিজস্ব বুল অ্যান্ড ব্রিডিং স্টেশনে সর্বমোট প্রজনন সক্ষম ষাঁড় রয়েছে ১৭৫টি। যার মধ্যে প্রত্যায়িত ষাঁড় ১৪২টি। গত বছর ব্র্যাক তরল সিমেন উৎপাদন করেছে ৪০ লাখ ডোজ। প্রতিষ্ঠানটির চার হাজার কর্মী ৬৪ জেলায় এখন খামারিদের বাড়ি গিয়ে কৃত্রিম প্রজননে সহায়তা করে। আরও পড়ুন
Advertisement
ব্র্যাক আর্টিফিশিয়াল ইনসেমিনেশন এন্টারপ্রাইজের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ফারুকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশে এখন সিমেনের কোনো ঘাটতি নেই। কৃত্রিম প্রজননের সফলতার কারণে দেশে দুধ ও মাংস উৎপাদনে বড় সাফল্য এসেছে। আমরা কৃত্রিম প্রজননে অনেক দেশের চেয়ে এখন এগিয়ে।’
তিনি বলেন, ‘কৃষকের সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার ও উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্র্যাক শুরু থেকে কাজ করছে। সে সময়ে দেশি জাতের গবাদিপশুর দুধ উৎপাদন কম ছিল। তাই দুধ উৎপাদন বাড়াতে কৃত্রিম প্রজনন সেবা খামারিদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্র্যাক প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে তরল সিমেন নিয়ে এ কার্যক্রম শুরু করেছিল, যা এখন সারা দেশে ছড়িয়েছে।’
ফারুকুল ইসলাম বলেন, ‘তরল সিমেনের মাধ্যমে কৃত্রিম প্রজনন সেবার ফলে দেশি গরুর জাত উন্নয়ন প্রক্রিয়া কিছুটা গতি লাভ করলেও এই তরল সিমেনের সংরক্ষণ ও গুণগত মান রক্ষা করা কঠিন ছিল। তাই গুণগত মানের কৃত্রিম প্রজনন সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০০০ সালে ব্র্যাক নিজস্ব বুল স্টেশনে হিমায়িত সিমেন উৎপাদন শুরু করে। এখন ক্রমাগত আমাদের উৎপাদন বাড়ছে।
সিমেন উৎপাদনে পরবর্তী অবস্থানে এসিআই এনিমেল জেনেটিক্স। গাজীপুরের রাজাবাড়িতে ১২০টি ষাঁড় নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বুল স্টেশন। যেখানে আছে শাহিওয়াল, ফ্রিজিয়ান ও রেড চিটাগাং। বিদেশি জাতগুলো আনা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এসব ষাঁড় দিয়ে বছরে প্রতিষ্ঠানটি ৪০ লাখ ডোজ সিমেন উৎপাদন করতে পারে। গত বছর উৎপাদন হয়েছে ৩৪ লাখ ডোজ।
প্রাণিসম্পদ খাতের টেকসই উন্নয়নে কৃত্রিম প্রজননের বিকল্প নেই। কারণ আমাদের পর্যাপ্ত গাভি থাকলেও সেগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা সন্তোষজনক নয়। যে কারণে বিশ্বের অধিক দুধ উৎপাদনকারী দেশগুলোর মতো গাভির সংখ্যা সীমিত রেখে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে, যা কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে সম্ভব।- এলডিডিপি প্রকল্পের চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ড. মো. গোলাম রাব্বানী
এসিআই এনিমেল জেনেটিক্সের বিজনেস ডিরেক্টর মোজাফফর উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকারের সহযোগিতায় এসিআই কৃত্রিম প্রজননের কাজটি করছে একেবারে প্রান্তিক পর্যায় থেকে। সারা দেশে আমাদের ডিস্ট্রিবিউটর পয়েন্ট রয়েছে ১০৫টি। তাদের কাছে সম্পূর্ণ কুলিং চেইন অনুসরণ করে সিমেন পৌঁছানো হয়, যা সারা দেশের নিজস্ব তিন হাজার এআই কর্মীর মাধ্যমে খামারিদের কাছে যায়।’
কৃত্রিম প্রজননে সুফল কেমন
আমাদের দেশে দুধের উৎপাদন বাড়াতে গেলে কৃত্রিম প্রজননের বিকল্প নেই। কারণ দেশি জাতের গরুগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা কম। আবার দেশে গরু রয়েছে পর্যাপ্ত। ফলে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে গরুগুলো অধিক উৎপাদনশীল করতে চায় সরকার।
এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কৃত্রিম প্রজনন দপ্তরের পরিচালক ডা. আনন্দ কুমার অধিকারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের দেশে যত গাভি রয়েছে, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায়ও এত গাভি নেই। তারপরেও আমাদের দুধের উৎপাদন সেসব দেশের তুলনায় অনেক কম। কারণ প্রচলিত জাতগুলো বেশি দুধ দিতে সক্ষম নয়।’
তিনি বলেন, ‘কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম শুরুর পর থেকে দেশে দুধ উৎপাদনে বড় সফলতা এসেছে। ভালো জাত তৈরি হচ্ছে। তারপরেও আমাদের দুধের ঘাটতি রয়েছে। তবে এভাবে কৃত্রিম প্রজনন হতে থাকলে এক সময় দেশে সে ঘাটতি মেটানো সম্ভব।’
সাভার কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা গোলাম আজম বলেন, ‘স্বাধীনতা পরবর্তীসময়ে প্রতিটি গাভি থেকে যেখানে গড়ে সর্বোচ্চ দেড় লিটার দুধ পাওয়া যেত বর্তমানে সেখানে ২০ লিটারের বেশি দুধ দেয় এমন গাভির সংখ্যা তিন লাখের বেশি এবং ১০ লিটার দুধ দেয় এমন গাভির সংখ্যা ১৩ লাখের বেশি। অনুরূপভাবে মাংস উৎপাদনে অতিরিক্ত সংযোজন হচ্ছে ৫শ কোটি টাকা। এছাড়া গাভিগুলো হয়েছে দীর্ঘজীবী।
সহায়তা দিচ্ছে এলডিডিপি প্রকল্প
কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম আরও গতিশীল করতে বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বাস্তবায়নাধীন ‘প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প (এলডিডিপি)’ সহায়তা দিচ্ছে। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে মোট বিনিয়োগ চার হাজার ২৮০ কোটি টাকা, যা প্রাণিসম্পদ সেক্টরে সর্ববৃহৎ বিনিয়োগ। কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রমও এ প্রকল্পের একটি অংশ।
প্রকল্পের আওতায় দেশের ৯ জেলায় (ঠাকুরগাঁও, রংপুর, পাবনার ঈশ্বরদী, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বরিশাল, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও সিলেট) কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের অফিস নির্মাণ ও দুটি অফিস সংস্কার করার প্রক্রিয়া চলমান। প্রতিটি অফিসের নির্মাণব্যয় গড়ে প্রায় সোয়া দুই কোটি টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ঢাকার সাভারের সরকারি খামারে ৪৮টি শতভাগ ফ্রিজিয়ান বকনা দেওয়া হয়েছে। আরও ছয়টিতে দেওয়া হয়েছে (চট্টগ্রামের হাটহাজারি, সিলেট, বরিশাল, ফরিদপুর, বগুড়া ও রাজশাহী ফার্ম) ৩০টি করে লোকাল ক্রস ব্রিড। কৃত্রিম প্রজনন বা জাত উন্নয়নে ৫০ হাজার গাভির ডাটাবেজও তৈরি করা হচ্ছে এ প্রকল্পের মাধ্যমে।
এ বিষয়ে এলডিডিপি প্রকল্পের চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ড. মো. গোলাম রাব্বানী জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রাণিসম্পদ খাতের টেকসই উন্নয়নে কৃত্রিম প্রজননের বিকল্প নেই। কারণ আমাদের পর্যাপ্ত গাভি থাকলেও সেগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা সন্তোষজনক নয়। যে কারণে বিশ্বের অধিক দুধ উৎপাদনকারী দেশগুলোর মতো গাভির সংখ্যা সীমিত রেখে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে, যা কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে সম্ভব।’
এনএইচ/এএসএ/এমএস