সাইখ আল তমাল
Advertisement
করোনার সময় নিজেকে এতটা সংকুচিত করে নিতে হয়েছে যে, সেখান থেকে আর ফিরতে পারছিলাম না। সত্যি বলতে আমার আমিত্বকে যে নতুন দৃষ্টিতে তুলে ধরবো, সে সুযোগ হচ্ছিলো না। নতুন উপলক্ষ চেয়েছি বরাবরই। কলকাতার প্রতি একটা নেশা আমার ছিল। এ নেশা দমিহ সুরার থেকেও বেশি কিছু।
বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপুরুষদের বিচরণ যেখানে, তা আমার মতো বাঙালির কাছে পবিত্র নগরীর চেয়ে কম কিছু নয়। ব্রিটিশরা তো সাধ করে এখানে রাজধানী স্থাপন করেনি। আমাদের ঢাকার রূপ আধুনিকতার নামে যতটা পাল্টে গিয়েছে, কলকাতায় তেমনটা হয়নি।
কল্পনায় আমি কলকাতার ট্রাম দেখি, জীবনানন্দের পায়চারি দেখি। শান্তিনিকেতন আর কলকাতায় বসে কবিগুরুর গীতাঞ্জলি রচনা কল্পনা করি। কল্পনাকে বাস্তবে দেখতে পাওয়া দুঃসাধ্য বটে। বিদ্যাসাগর মহাশয় কিংবা স্বামী বিবেকানন্দ, মহাজনদের চরণধূলি যেখানে পড়েছে; তাতে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার বাসনা বহুদিনের।
Advertisement
কাঁটাতার শুধু দুই বাংলাকেই আলাদা করেনি, বাঙালির হৃদয়টাকে দু’ভাগ করে দিয়েছে। পূর্বপুরুষদের ভিটে-মাটি ছেড়ে যে যায়, তার আহাজারি বসুমতি কীভাবে সয়; আমার ছোট্ট মগজে তা ধরে না। প্রচণ্ড বেদনা আঁকড়ে ধরে নরকের শিকলের মতো। নজরুলের বিদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে।
মানব জনমের বিদগ্ধ বিষাদ সিন্ধু কাকিমার নেত্রনীরে ঝরে। তার দুঃখের কাছে কঠিন হিমালয়ও গলে যায়। অনিকদার বান্ধবী শিল্পীদির সুবাধে কাকিমার সঙ্গে আলাপ।
ডাফ লেনের শতবর্ষী বাড়িটাতে তিনি থাকেন। বাড়ি থেকে বের হলেই বিখ্যাত স্কটিশ চার্চ কলেজ। এখানকার সবকিছুই পুরোনো ধাঁচের। ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। দেওয়ালে কান পাতলে এখনো বোধহয় আলেকজান্ডার ডাফের ধর্মের বাণী শুনতে পাওয়া যাবে। দেওয়ালে কান পেতে শোনা হয়নি।
অনিকদা আমার কথা শিল্পীদিকে আগেই বলে রেখেছিল। প্রথম রাত হাবড়াতে কাটানোর পরদিন দুপুরেই দিদির বাসায় নিমন্ত্রণ। কলকাতার মানুষ সম্পর্কে বাংলাদেশে একটা কৌতুক প্রচলিত আছে। বাস্তবে কৌতুকটা আমার কাছে খাটলো না। মানুষগুলো অতিথিপরায়ণ আর আন্তরিক।
Advertisement
দিদি আমার জন্য পোলাও, চিংড়ি মালাইকারি, পনির, মিষ্টি, চাটনি সব আয়োজন করে রেখেছেন। এখানে আসার পথে দমদম থেকে ট্যাক্সিতে চড়ার সময় অনিকদা আমাকে বাড়িটা সম্পর্কে অনেক গল্প শুনিয়েছে। যখনই বাড়িটার বয়স জানতে পারলাম আগ্রহটা বেড়ে গেল।
শহরের অন্যতম প্রাচীন বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজন হবে ভাবতেই রোমাঞ্চিত হলাম। পথে বেথুন স্কুলে ইতিহাস হাতরে এসেছি। এশিয়ার সবচেয়ে পুরাতন মেয়েদের স্কুলে আমি গিয়েছি এটাই আমার পরম সৌভাগ্য। সাধারণত ছেলেদের ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই। ভারতীয় হলেও নয়।
পথে যেতে যেতে ট্রাম লাইন চোখে পড়লো। কলকাতায় ট্রাম এখন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তবে ট্রাম দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। কলকাতা শহরে ট্রামের দেখা পাওয়া আর হ্যালির ধূমকেতু দেখার মধ্যে তফাত কোনো পর্যটক করতে পারবে না।
বেথুন স্কুল ঘুরতে ঘুরতে ক্ষিধেটা ততক্ষণে চড়েছে আমাদের। পুরোনো বাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই মনে হলো যেন টাইম মেশিনে চড়ে ঠিক ২০০ বছর আগের কোনো এক সময়ে ফিরে গেলাম। পুরোনো জিনিসে আমার আগ্রহ বেশ। শহরের কোনো এক পরিত্যক্ত বাড়িতে শহুরে অশরীরীর সঙ্গে রাত্রিযাপনের খায়েশ।
মধ্যাহ্নভোজন সেরে তারা দুজন অনুষ্ঠান করতে যাবে তা পূর্বপরিকল্পিত। শিল্পীদি শুধু নামে নয়, কাজেও একজন গুণী শিল্পী। কি মিষ্টি রবীন্দ্র, নজরুল আর পঞ্চকবির গান করে সে! তারা অনুষ্ঠান করতে চলে গেল আর আমি কাকিমার সঙ্গে বের হলাম।
আরও পড়ুন
ঈদের ছুটিতে তিন নদীর মোহনায় ভিড় করছেন দর্শনার্থীরা মিরসরাই-গুলিয়াখালী সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের ঢলকাকিমা আমাকে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি যাওয়ার অটোতে তুলে দেবেন। কিন্তু তাকে এতটা পথ নিয়ে আসতে বেশ খারাপই লেগেছে। শুধু শুধু কষ্ট দিলাম মনে হচ্ছে। একা এলেই পারতাম। কিন্তু আমি নতুন তাই একা ছাড়েননি। চালতাবাগান পেট্রোল পাম্পের মোড় থেকে অটোতে উঠিয়ে দিলেন।
তবে নামার পর মনে হলো এতটুকু পথ হেঁটেই পাড়ি দেওয়া যেত। চালকের নির্দেশনা অনুযায়ী বাকি পথ চিনে নিয়েছি। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে এলো বলে। অচেনা পথে হাঁটার অন্যরকম এক আনন্দ। কোনো চেনা দুঃখ নেই, পরিচিত বিরহ নেই, বিড়ম্বনা নেই। শুধু আপন মনে ছুটে চলা। মনে কোনো দুশ্চিন্তা নেই, ভয় নেই।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিংহ ফটক দেখে থমকে দাঁড়ালাম। যেন কতদিনের চেনা। গোধূলি আলোয় এক অদ্ভুত মায়া জাগলো মনে। ক্ষাণিক তাকিয়ে রইলাম। কল্পনার জগৎ থেকে যেন বের হতে পারছি না। ধীর পায়ে আগালাম ভেতরে।
সন্ধ্যা হয়ে এলো তাই দর্শনার্থীদের বেশি ভেতরে যাওয়ার অনুমতি নেই। সাতপাঁচ ভেবে এগিয়ে গেলাম। কবিগুরুর স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি না দেখে ফিরতে পারব না। আত্মা অতৃপ্ত থেকে যাবে। একজন লোক আমার দিকে এগিয়ে এলো। কথা বলে জানতে পারলাম এখনই একটা লাইট শো হবে, টিকিট পঞ্চাশ রুপি। চাইলে দেখতে পারব।
আর এই টিকিট কাটলে ছবি তোলার জন্য আলাদা ফি দিতে হবে না। টিকিট নিয়ে চলে গেলাম সোজা ভেতরে। যতদূর বিনা বাধায় যাওয়া যায়। এরমধ্যে শো শুরু হয়ে গেল। মাঠের কোণায় চেয়ার পাতা। দর্শক আমি আর একজোড়া মানুষ। জোড়া দুজন বেশ রোমান্টিক পর্যায়ে বিচরণ করছে। আমি একাই এসেছি। তিনজনে শো দেখছি। বাংলাতেই ছিল, ইংরেজিতেও নাকি হয়। শো চলে আধা ঘণ্টার মতো।
এরমধ্যে একটি পরিবারও চলে এলো। শো ততক্ষণে শেষের দিকে। দেখেই আন্দাজ করলাম তারা বাংলাদেশ থেকে আগত। খানিকবাদেই বেরিয়ে পড়লাম। হলুদ ট্যাক্সির ট্রাফিক সারি সারি। ষাট কিংবা সত্তরের দশকের অনুভূতি পেলাম। যদিও কলকাতায় প্রথম ট্যাক্সির আগমন ১৯০৯ সালের দিকে।
ফরাসি শেভিজাঁ কোম্পানি শহরে প্রথম এর চল শুরু করে। চৌরঙ্গী রোডে ছিল তাদের অফিস। তৎকালীন দুই সিলিন্ডারওয়ালা গাড়িগুলোতে বসা যেত দু’জন করে যাত্রী। গাড়িগুলোর রং কিন্তু হলুদ ছিল না। টকটকে লালরঙা ছিল। মাইলপ্রতি যেতে যাত্রীদের গুনতে হতো আট আনা করে।
তবে গাড়িকে ট্যাক্সিতে রূপান্তর করার উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৯৬২ সালে। সেবছর থেকেই কলকাতার রাস্তায় চলতে শুরু করে বিখ্যাত হলুদ ট্যাক্সি। শুরুতে হলুদ আর কালো রঙের ট্যাক্সি রাস্তায় নামে। কালো ট্যাক্সি চলতো শুধু শহরে আর হলুদ ট্যাক্সি যেত শহরের বাইরে। কদিনের মধ্যেই ট্যাক্সিগুলো জনপ্রিয়তা পায়। সময়ের সঙ্গে ক্ষয়ে গেছে হলুদ ট্যাক্সির কদর। আধুনিক সব পরিবহন ব্যবস্থা চলছে এখন।
এবার আর অটোতে চড়লাম না। নিয়ত করলাম হাঁটতে হাঁটতে ফিরব। পথে যা দেখার দেখে নেব। মিনিট কুড়ি হাঁটার পর চালতাবাগান পেট্রোল পাম্পের সামনে হাজির হলাম। ডাফ লেন ধরে শিল্পীদির বাড়ির পথে পা বাড়ালাম। কাকতালীয়ভাবে বাড়ির সামনে পৌঁছাতেই তারা দুজনে চলে এলো। শো শেষ হয়েছে ততক্ষণে। ভেতরে ঢুকে তারা গেল ওপরের ঘরে আর আমি নিচে বসলাম কাকিমার সঙ্গে। বেশকিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। স্বভাবতই কিছুটা অন্তর্মুখী। নীরবতা কাকিমাই ভাঙলেন।
এভাবে চুপচাপ দুজন মানুষ তো বসে থাকতে পারে না। তাছাড়া এই ঘরে বসে সময় কাটানোর মতোও কিছুই নেই। কথা না বললে দম বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কাকিমা নিজ থেকে অনেক কিছু জেনে নিলেন আমাকে নিয়ে। করোনার সময়টায় মানুষ কি দুঃখে ছিল বলতে লাগলেন কাকিমা। হাসপাতালগুলোতে মানা হতো কড়া নিরাপত্তা। কাকু তখন করোনায় আক্রান্ত। হাসপাতালেই আশ্রয় হলো। মানুষের মনে তখন আতঙ্ক। মধ্যবিত্তদের মনে করোনায় মরার চেয়ে বেশি আতঙ্ক ছিল না খেয়ে মরার। শহরে লকডাউন মানে মধ্যবিত্ত শ্রেণির পেটের লকডাউন। কাকুকে হাসপাতালে দেখতে যেতেন শিল্পীদি। কিন্তু কাছে যেতে দেওয়া হতো না তাকে। দায়িত্বরতদের থেকে খবর নিয়ে ভারাক্রান্ত মনে ফিরতে হতো। কীভাবে আছেন, কতটুকু ভালো আছেন এই খবর দেওয়ার জন্য বিধাতা কোনো ডাকপিয়ন পাঠাননি। হায় কী নিয়তি! দেহের লকডাউন হলেও আত্মার কোনো লকডাউন নেই। সে তার গন্তব্যেই যাবে। তার বিধাতার কাছে। কোনো মায়াবলেই তাকে আটকানো সম্ভব নয়।
কাকু যখন দেহত্যাগ করলেন; তখনো তাকে কাছ থেকে দেখতে দেওয়া হয়নি। কাকিমার দুঃখ, মুখাগ্নিটুকুও করতে পারেননি তারা। শিল্পীদির মনের এই অতৃপ্তি গড়িয়ে পড়লো কাকিমার গাল বেয়ে। হয়তো কাকুর কথা তার ভীষণ মনে পড়েছে। সাতপাকে বাঁধা পড়ার পর থেকে তিনি ছিলেন হয়তো তার মন্দির। ডাফ লেনের পুরোনো বাড়িটায় তাদের কতই না স্মৃতি। বিদায়বেলা মুখাগ্নি করতে না পারার আফসোস কাকিমা ভুলবেন কী সে! হয়তো এখনো নির্জনে কাকিমার চোখে গঙ্গা বয়। শিল্পীদিও বা দুঃখ ভোলেন কী করে। পিতৃহারার যন্ত্রণা আমি বয়ে বেড়াচ্ছি চৌদ্দ বছর ধরে। এই ব্যবধান কালে কালে বয়েই যাবে। তিনি আর ফিরবেন না।
ততক্ষণেও তারা ওপর তলা থেকে নামেনি। একটু বেশিই সময় নিচ্ছেন। কিছুটা বিরক্তবোধ যে করিনি সে কথা আমি বলব না। তারা এলে ক্যাপ্রিতে রওনা হলাম। কলকাতার সবচেয়ে পুরোনো চাইনিজের দোকান। এদিকটায় শূকর খাওয়ার প্রচলন আছে। তো এ জিনিস ভুলেও পেটে পড়ুক, তা চাই না।
অনিকদা আমার কথা মাথায় রেখেই ক্যাপ্রিতে রাতের খাবার ঠিক করলেন। এখানে খাওয়ার সুবিধা হলো ওই প্রাণিটির মাংস না চাইলে ওরা দেবে না, ভরসাযোগ্য। পুরোনো বাড়িটাকে এবারের মতো বিদায় জানালাম। কাকিমার থেকেও বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম স্কটিশ চার্চ কলেজের দিকে।
চলবে...
প্রথম পর্ব পড়ুন
ট্রেনে চেপে ভারত পৌঁছালাম যেভাবে
দ্বিতীয় পর্ব
জেএমএস/এসইউ/জিকেএস