দেশজুড়ে

কাপ্তাইয়ে পানি কমে যাওয়ায় হ্রদ ঘিরে বাড়ছে সঙ্কট

পানি কমে যাওয়ায় কাপ্তাই হ্রদ ঘিরে এবারও সৃষ্টি হয়েছে নানা সঙ্কটের। ইতোমধ্যে চলতি শুস্ক মৌসুমে হ্রদের পানির স্তর অস্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে গেছে। হ্রদের পানি দ্রুত চলে যাচ্ছে তলানিতে। এ নিয়ে বিপাকে রয়েছে প্রশাসন। এ বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে জেলা প্রশাসক ও হ্রদ পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব মো. সামসুল আরেফিন বলেন, কাপ্তাই লেকটিকে সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা না গেলে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। হ্রদের সঠিক ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি রয়েছে। এর নাব্যতা পুনরুদ্ধারে কমিটি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে কাপ্তাই হ্রদের ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাব দিয়েছে। প্রকল্পটি যাচাই বাছাইসহ অনুমোদনের জন্য বিবেচনাধীন রয়েছে। তিনি বলেন, হ্রদের গভীরতা কমায় চাষাবাদ, পানি সরবরাহ, পর্যটন, নৌ পরিবহন, বিদ্যুৎ ও মৎস্য উৎপাদনসহ হ্রদ ঘিরে গড়ে ওঠা সবক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে সঙ্কট। সৃষ্টির পর গত ৫৬ বছরে একবারও হ্রদটির ড্রেজিং না হওয়ায় এসব ক্ষেত্রে ক্রমশ সঙ্কট বাড়ছে। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, চলতি মৌসুমে বর্তমানে কাপ্তাই হ্রদের পানির স্তর ৮০ এমএসএল (মীন সী লেভেল)। এ মৌসুমে হ্রদে পানির স্বাভাবিক স্তর থাকার কথা ৮২ দশমিক ২৬ এমএসএল। হ্রদের পানির স্তর দ্রুত কমতে থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন, পানি সরবরাহ ও নৌ পরিবহনে সঙ্কট বেড়েছে। নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছে না নৌযানগুলো। আটকে যাচ্ছে আংশিক, আধা ও মাঝপথে। অন্যদিকে কাপ্তাই হ্রদে পানি স্বল্পতার কারণে কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রে মারাত্মক আকারে উৎপাদন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রের পাঁচ ইউনিট দিয়ে পিক-আওয়ারে রেশনিং পদ্ধতিতে বর্তমানে দৈনিক সর্বোচ্চ ৬০-১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ। বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত সঙ্কট বাড়তে থাকবে বলেও জানানো হয়। জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ জানিয়েছে, বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে লেক থেকে পানি উত্তোলন করে শহরে সরবরাহ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদেরকে। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএফডিসি) রাঙামাটির ব্যবস্থাপক ও প্রকল্প পরিচালক কমান্ডার মাইনুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ ৫৬ বছরে একবারও ড্রেজিং না হওয়ায় কাপ্তাই হ্রদের নাব্যতা হারিয়ে যাচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন কাপ্তাই হ্রদকে বলা হত মৎস্য উৎপাদন ভাণ্ডার। কিন্তু হ্রদের গভীরতা হ্রাস এবং পানি ও পরিবেশ দূষণের কারণে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন এখন হুমকির মুখে। বিভিন্ন প্রজাতির মাছ হ্রদ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।তিনি বলেন, ১৯৬৫-৬৬ সালে হ্রদে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালি বাউস, মহাশোলসহ বড় প্রজাতির মাছ ছিল ৮১ দশমিক ৩৫ ভাগ। আর চাপিলা, কাচকি, মলা মাছের মতো ছোট প্রজাতির মাছ ছিল তিন ভাগ। বর্মমানে হ্রদে রুই বা কার্প জাতীয় বড় মাছ আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে কাপ্তাই হ্রদের অস্তিত্ব পুনরুদ্ধার করা না গেলে মৎস্য উৎপাদন সম্ভব হবে না বলে মনে করেন বিএফডিসি রাঙামাটির ব্যবস্থাপক কমান্ডার মাইনুল ইসলাম।সংশ্লিষ্টরা জানান, পানি কমতে থাকায় হ্রদে নৌ চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। বর্তমানে জেলা সদরের সঙ্গে নৌ যোগাযোগ মাধ্যম সাত উপজেলা কাপ্তাই, নানিয়ারচর, বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি, বরকল, লংগদু ও বাঘাইছড়িতে নৌ যোগাযোগ ব্যাহত হতে চলেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল সূত্রের দেয়া তথ্যমতে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সর্বোচ্চ উৎপাদন বাড়াতে এবং রাঙামাটির বিভিন্ন নদীপথে নৌ চলাচল স্বাভাবিক ও সচল করতে সরকারকে হ্রদের পাঁচটি পয়েন্টে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। পয়েন্ট পাঁচটি হলো, রাঙামাটি-কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলির মূল খাল, রাঙামাটি-মারিশ্যার মাইনী ও কাচালং খাল, রাঙামাটি-মহালছড়ির চেঙ্গী খাল, রাঙামাটি-বরকল-ছোটহরিণা খাল এবং কাপ্তাই-বিলাইছড়ির রাইখ্যং খাল।উল্লেখ্য, ১৯৬০ সালে দেশের বৃহত্তম বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য রাঙামাটি পার্বত্য জেলার কাপ্তাইয়ে খরশ্রোতা কর্ণফুলি নদীর ওপর দিয়ে নির্মিত হয় কাপ্তাই বাঁধ। এর ফলে সৃষ্টি হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃত্রিম জলরাশি কাপ্তাই লেক, যার আয়তন প্রায় ৭শ বর্গকিলোমিটারের অধিক। কাপ্তাই লেক ঘিরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও গড়ে ওঠে নৌযোগাযোগ ব্যবস্থা, মৎস্য উৎপাদন, জলেভাসা জমিতে কৃষি চাষাবাদ, পানি সরবরাহ ও পর্যটনসহ বিভিন্ন গণমুখী উন্নয়ন সুবিধা ও অপার সম্ভাবনা। কিন্তু বর্তমানে তলদেশ ভরাট হওয়ায় নাব্যতা হারিয়েছে হ্রদটি। ফলে প্রতি বছর শুস্ক মৌসুমে হ্রদ ঘিরে দেখা দেয় চরম সঙ্কট।এফএ/এবিএস

Advertisement