মতামত

সব আয়োজন নিয়ে আজাইরা বিতর্ক কেন?

আমাদের মানে বাংলাদেশের মানুষের নির্মল আনন্দ, উৎসব, আয়োজন, বলে কি আর কিছুই থাকবে না? সবকিছু নিয়ে কোমড় বেঁধে বাহাস করতে নেমে পড়তে হবে? ধর্মীয় উৎসব থেকে সামাজিক পর্ব ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সবই কেমন যেন ঝগড়ার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অদ্ভুতভাবে একটা জাতি বিশেষ করে রাজধানীভিত্তিক শিক্ষিতজনেরা এই ঝগড়া বিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন। সবাই সবকিছুতে বোদ্ধা। প্রতিটি গ্রুপই মনে করছে তারা যেটা বলছে সেটাই ঠিক, বাকি সব ভুল।

Advertisement

ঈদ নাকি ইদ কোন বানান, রোজার উচ্চারণ, শবেবরাত, পর্দা করার নিয়ম, আরবির সহিউচ্চারণ, মিলাদ, সাতাশে রমজান, একুশে ফেব্রুয়ারি, মুক্তি সংগ্রাম, পহেলা বৈশাখ, শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলে গান কোনটাই আনচ্যালেঞ্জড যেতে দেয়া হচ্ছে না বা আয়োজন করা যাচ্ছে না। সবকিছুতে বাহাস, তর্ক-বিতর্ক ও যুক্তি ও কু-যুক্তি। জায়েজ নাকি না-জায়েজ, বিদাত, হিন্দুয়ানি নাকি শরীয়তি, বাঙ্গালি নাকি বিদেশী এইসব তর্ক-বিতর্ক দিয়ে গলা চিপে ধরে চলমান উৎসব আয়োজনকে ম্লান করে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। যারা এগুলো করছেন, তাদের ভাবটা এমন, “বিনা যুদ্ধে নাহি দেবো সূচাগ্র মেদেনি।”

ছোটবেলা থেকেই দেখছি উপরের প্রতিটি উৎসব-আয়োজন এই দেশে, এই নগরে পালিত হয়ে আসছে নিজের মতো করে। এখন আয়োজন হচ্ছে বড় পরিসরে। দেশে-বিদেশে অসংখ্য বাঙালি এইসব উৎসবের সাথে মিশে গিয়ে বাংলাকে খুঁজে নেন। উৎসব পালন নিয়ে এতো কথা, এতো যুক্তি-তর্ক দেখিনি। পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে ছায়ানটের গানের আয়োজনের মধ্য দিয়েই বর্ষবরণ করার রীতি বহু পুরানো। পরে যোগ হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। নানাধরণের মোটিফ নিয়ে পটচিত্র ও মুখোশ বানিয়ে চারুকলার ছাত্রছাত্রীরা আনন্দ আয়োজনের ব্যবস্থা করে আসছে। মানুষ দুই তিন ধরে এসব দেখার জন্য চারুকলায় ভিড় জমাচ্ছেন পরিবার পরিজন ও বন্ধুদের নিয়ে। ছবি তুলছেন, নিজেরা ছবি আঁকছেন, শিশুরা রং করছে, কেউ কেউ গান গাইছেন, কেউ কেউ আড্ডা মারছেন। এতে কার কী ক্ষতি হচ্ছে বোঝা কঠিন। কিন্তু তাও একশ্রেণির মানুষ ধর্ম গেল. ধর্ম গেল বলে শোরগোল তুলছেন গত কয়েকবছর ধরে।

ইসলামের দৃষ্টিতে বর্ষবরণের মতো বিষয়গুলো সরাসরি কোনোকিছু বলা না হলেও মানুষের হারাম কামাই নিয়ে সাবধান করা হয়েছে। অথচ আমরা ‘হারাম কামাই’ নিয়ে না ভেবে, হালাল বার্গারের দোকান খোঁজাটা জরুরি মনে করি। শোরগোল করা ছাড়া আমাদের প্রার্থনা ও দান-খয়রাত হয় না। বর্ষবরণ করা নিয়ে ইসলামকে পেঁচিয়ে আমরা বিতর্ক করি এবং ক্রমশ বিতর্ক বাড়িয়ে তুলছি। মূল আদেশ নির্দেশ পালন না করে অন্যের পেছনে লাগাটাই যেন আমাদের অধিকাংশ মানুষের আনন্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

Advertisement

অনেকে অভিযোগ করছেন এসব হিন্দুয়ানি কালচার। মুসলমানদের জন্য এগুলো আয়োজন নয়, বরং গোনাহ হচ্ছে। পহেলা বৈশাখ একটি সর্বজনীন উৎসব, বাঙালির নিজস্ব উৎসব এবং বড়ধরনের সাংস্কৃতিক উৎসব। এখানে সব ধর্মের মানুষ নিজের মতো করে অংশগ্রহণ করেন। সেখানে এত কথা বলার কী আছে। গ্রামেগঞ্জে মেলা, ভালুক নাচ, যাত্রাপালা সব হতো বৈশাখ উপলক্ষে। বৈশাখ মাসের গরমকে উপেক্ষা করে মানুষ যদি একটু আনন্দ পায়, তাকে তা পেতে দিন।

পহেলা বৈশাখ তথা বর্ষবরণের সূচনা হয়েছিল কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায় সহজ করতে। ফসল ওঠার পর বাকিতে কেনা জিনিসপত্রের দায়দেনাও মেটানো হতো এ সময়টায়। সেসব ঘিরে মিষ্টিমুখ, বৈশাখী মেলা ও হালখাতার প্রচলন হয়। ক্রমশ বাঙালির অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসেবে উদযাপনের উৎসাহ বেড়েছে। পহেলা বৈশাখকে জাতীয় উৎসব বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। এটি পালনের জন্য বিশেষ বোনাসও চালু হয়েছে ২০১৬ সাল থেকে। তৈরি হচ্ছে ফুল, মিষ্টি ও ফলের বিরাট চাহিদা। এই উৎসব এখন সব মানুষের।

একটা সময় এই শহরে পহেলা বৈশাখটা যারা উদযাপন করতেন তাদের অধিকাংশই ছিলেন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণির মানুষ। এখন এই আনন্দ আয়োজনে সব বয়সের সব শ্রেণির মানুষ সমবেত হন। জামা-কাপড়, ফুল, খাবার-দাবার, গান-বাজনা, ঢোল-তবলা সবকিছুর বাণিজ্য বেড়েছে বৈশাখকে ঘিরে, এগুলোকে বিস্তৃত হতে দেন। দুর্নীতি করে আয় করার সময়, মানুষের ক্ষতি করার সময়, ধর্ষণ-যৌন হয়রানি, নির্যাতন, খুন-খারাপি ও অন্যের সম্পদ মেরে দেয়ার সময়তো হারাম-হালাল নিয়ে কথা বলেন না, তাহলে বৈশাখের শোভাযাত্রা নিয়ে এত শোরগোল কেন।

এবছর শুরু হয়েছে কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলায় হাওরের বুক চিরে নির্মিত ১৪ কিলোমিটার সড়কে আল্পনা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড়। বাংলা বর্ষবরণের অংশ হিসেবে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম এই আল্পনা আঁকা হয়েছে। হাওরের বুক চিরে রাস্তাটি নির্মাণের শুরু থেকেই পরিবেশবাদীরা এর বিরোধিতা করে আসছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল, এই ধরনের সড়ক হাওরের প্রাণীবৈচিত্র্য ধ্বংসে ভূমিকা রাখবে। যাহোক দেরিতে হলেও কর্তৃপক্ষ বুঝতে পেরেছেন এবং বলেছেন ভবিষ্যতে হাওরে এরকম সড়ক নির্মাণ করা হবে না। এটা খুব ভাল সংবাদ।

Advertisement

কিন্তু নতুন করে আবার বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে বর্ষবরণের আল্পনা আঁকা নিয়ে। আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে আল্পনাটি জায়গা করে দেওয়ার জন্য আবেদন করা হবে। সমালোচকরা বলছেন আয়োজকদের ব্র্যান্ডিং করার জন্যই এই আয়োজন। বৈশাখ পালন করা বা মানুষের মনকে রঙে রাঙিয়ে তোলা এখানে একটি অজুহাত।

আল্পনা আঁকতে যে রং ব্যবহার করা হলো, এই রং ধুয়ে পড়বে কোথায়? মাছের পেটে রং যাবে, সেই মাছ মানুষে খাবে। এছাড়া রং পানির মাধ্যমে চলে যাবে মাটিতে। এরপর কেমিক্যালমিশ্রিত এই রঙ ফসলি জমির কী পরিমাণ ক্ষতি করবে সেটি নিয়েও কথা হচ্ছে। পরিবেশবিদরা আরো ভালো বলতে পারবেন। আমাদের কথা হচ্ছে এই কাজ করার আগে নিশ্চয়ই অথরিটির কাছ থেকে অনুমতি নেয়া হয়েছে। তারা কেন পরিবেশবিদদের সাথে কথা না বলেই এরকম একটি কাজে অনুমতি দিলেন? আশাকরি এরপর এইধরনের পরিবেশ বিরোধী সজ্জার অনুমতি দেয়া হবে না। তবে একথাও ঠিক যে বাংলাদেশে নদীনালার পানি দখল, দূষণ, কলকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য, মানুষের পয়ঃবর্জ্যসহ নানাবিধ কারণে এতটাই দূষিত যে এই গ্যালন গ্যালন রং হয়তো সেই মাত্রা কিছুটা বাড়াতে পারবে।

আমরা বলতে চাইছি সবকিছু নিয়ে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে জায়গা নেয়ার দরকার নাই। বিষয়টাকে সৃজনশীল শৈলির মধ্যে রেখে আনন্দ আয়োজন করাই যথেষ্ট। ভবিষ্যতে কোনো উদ্যোগ নেয়ার সময় অবশ্যই পরিবেশের কথা অবশ্যই ভাবা উচিৎ। মানিক মিয়া এভিনিউতে, মেট্রোরেল ও ফ্লাইওভারের পিলারে আল্পনা আঁকা আর হাওরের বুক চিরে বানানো রাস্তায় আঁকা এক নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে যা প্রকৃতি ও পরিবেশ বিরোধী সেটাই অসুন্দর ও অন্যায়। যারা আনন্দ আয়োজনের মধ্যে পাপ-পুণ্য, বিদাত খুঁজেন তারাও আরেকধরনের অন্যায় করেন।

সমাজে চলমান সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য প্রথা ধর্মের অজুহাত দিয়ে থামিয়ে দেয়ার মধ্যে কোনো বীরত্ব নেই। যারা মিলাদ পড়তে চান, পড়বেন এতে অসুবিধার কী হলো? নবীজির নাম বন্দনা হলে ক্ষতি কোথায়? যারা হালুয়া-রুটি বানিয়ে শবেবরাত পালন করতে চান, তারা তাই করবেন। এটা ঠেকানোর কী আছে? রোজাকে বদলে রমাদান না বললে রোজা পোক্ত হবে না এই আইডিয়াইবা কার দেয়া? অপ্রয়োজনীয় এইসব বিতর্ক না করে বরং মানুষের কথা ভাবুন, মানুষের কল্যাণে মন দিন।

শোভাযাত্রা করলে, মুখোশ বানালে, আল্পনা আঁকলে, গান গাইলে, নাচলে, টিপ-ফুল গুঁজে বেড়াতে বের হলে কতটা পাপ হয় জানিনা। তবে দুর্নীতি করে আয় করলে, মানুষের ক্ষতি করলে, ধর্ষণ-যৌন হয়রানি, নির্যাতন, খুন-খারাপি ও অন্যের সম্পদ মেরে খেলে যে পাপ বা গুনাহ হয় তা আমি নিশ্চিত। কারণ পবিত্র কোরানে আল্লাহ বারবার এইসব কাজ থেকে মানুষকে দূরে থাকতে বলেছেন।

ইসলামের দৃষ্টিতে বর্ষবরণের মতো বিষয়গুলো সরাসরি কোনোকিছু বলা না হলেও মানুষের হারাম কামাই নিয়ে সাবধান করা হয়েছে। অথচ আমরা ‘হারাম কামাই’ নিয়ে না ভেবে, হালাল বার্গারের দোকান খোঁজাটা জরুরি মনে করি। শোরগোল করা ছাড়া আমাদের প্রার্থনা ও দান-খয়রাত হয় না। বর্ষবরণ করা নিয়ে ইসলামকে পেঁচিয়ে আমরা বিতর্ক করি এবং ক্রমশ বিতর্ক বাড়িয়ে তুলছি। মূল আদেশ নির্দেশ পালন না করে অন্যের পেছনে লাগাটাই যেন আমাদের অধিকাংশ মানুষের আনন্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

১৬ এপ্রিল, ২০২৪

লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।

এইচআর/এএসএম