আইন-আদালত

আসামিদের হাজির না করায় আটকে আছে বিস্ফোরক মামলার বিচার

২০০১ সালে রাজধানীর রমনা পার্কের বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। ওই হামলায় ১০ জন নিহত হন। আহত হন আরও অনেকেই। এ ঘটনায় করা হত্যা মামলায় দশ বছর আগে আটজনের মৃত্যুদণ্ড ও ছয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। তবে একই ঘটনায় করা বিস্ফোরক আইনের মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ হয়নি ২৩ বছরেও। রাষ্ট্রপক্ষ বলছেন, নিরাপত্তাজনিত কারণে আসামিদের আদালতে হাজির করা হচ্ছে না। তাই দীর্ঘ সময়েও মামলাটির বিচারিক কার্যক্রম শেষ করা যাচ্ছে না।

Advertisement

বিস্ফোরক আইনের আলোচিত এ মামলামামলাটি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এ যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর্যায়ে ছিল। ২০২২ সালের ২৮ জুলাই মামলাটি বদলি করে ঢাকা মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ এ পাঠানো হয়। সেখান থেকে ২০২৩ সালের ৩ জানুয়ারি মামলাটি পাঠানো হয় সপ্তম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে। এ আদালতে একাধিক তারিখ গেলেও আসামিদের কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়নি।

মামলাটি গত এক বছরের বেশি সময় ধরে আসামিদের আত্মপক্ষ শুনানির পর্যায়ে রয়েছে। সর্বশেষ চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি এ মামলায় আত্মপক্ষ শুনানির জন্য দিন ধার্য ছিল। কিন্তু নিরাপত্তাজনিত কারণে আসামিদের কারাগার থেকে আদালতে হাজির করেনি কর্তৃপক্ষ।

এজন্য সপ্তম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ এর বিচারক তেহসিন ইফতেখারের আদালত আগামী ২২ এপ্রিল আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন। ওইদিন আত্মপক্ষ সমর্থন শেষ হলে যুক্তি উপস্থাপনের জন্য দিন ধার্য করবেন বিচারক। যুক্তি উপস্থাপন শেষে মামলার রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য করা হবে।

Advertisement

আরও পড়ুন

রমনার বটমূলে বোমা হামলা মামলার বিচার ২৩ বছরেও শেষ হয়নি ভাবলাম শর্টসার্কিট, দৌড়ে গিয়ে দেখি সামনে ১০টা লাশ পড়ে আছে

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু জাগো নিউজকে বলেন, রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনায় বিস্ফোরক আইনে করা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। এ মামলায় ৫৪ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এখন আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। আশা করছি, দ্রুত মামলাটির বিচারিক কার্যক্রম শেষ করা হবে।

প্রতিবছর নবপ্রাণের আহ্বানে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হয় রমনার বটমূলে

সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মাহবুবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, নিরাপত্তাজনিত কারণে আসামিদের আদালতে হাজির করা হচ্ছে না। আমাদের আদালতে মামলাটি এক বছর আগে এসেছে। আদালতে মামলা আসার পর থেকে আসামিদের আদালতে হাজির করা হয়নি। তাই মামলার বিচারিক কার্যক্রম এগোনো সম্ভব হয়নি।

Advertisement

আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, আসামিদের নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে আদালতে আনা হচ্ছে না। এর ফলে আরও বিলম্বিত হচ্ছে বিচারকার্য। মামলায় যে সাজা হওয়ার কথা, তার চেয়ে বেশি সময় কারাগারে আটক রয়েছে আসামিরা। আমরা ন্যায়বিচার চাই।

২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল (পহেলা বৈশাখ ১৪০৮ বঙ্গাব্দ) ভোরে রমনার বটমূলে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানস্থলে দুটি বোমা পুঁতে রাখা হয়। পরে রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে সেগুলোর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ওইদিন বর্ষবরণের অনুষ্ঠান চলাকালে সকাল ৮টা ৫ মিনিটে একটি ও ১০টা ১৫ মিনিটের পর অন্য বোমাটি বিস্ফোরিত হয়। নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) নৃশংস ওই বোমা হামলায় প্রাণ হারান ১০ জন। এতে আহত হন আরও অনেকেই।

বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে মিলিত হন সব বয়সী ও শ্রেণিপেশার মানুষ

এ ঘটনায় হুজি নেতা মুফতি হান্নানসহ ১৪ জনকে আসামি করে ওইদিনই রমনা থানার পুলিশ বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে আলাদা দুটি মামলা করেন।

আরও পড়ুন

জঙ্গি নয়, দুষ্টু পোলাপান চিরকুট দিয়ে হুমকি দিয়েছে নাম পাল্টে ২১ বছর আত্মগোপনে মুফতি শফিক

মামলার বিবরণে বলা হয়, পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান ‘ইসলাম বিরোধী’ বিবেচনা করে ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালানো হয়। হামলায় ঘটনাস্থলেই নয়জনের মৃত্যু হয়। পরে হাসপাতালে মারা যান আরও একজন।

২০০৮ সালের ২৯ নভেম্বর শীর্ষ হুজি নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ১৪ জনকে অভিযুক্ত করে সিআইডির পরিদর্শক আবু হেনা মো. ইউসুফ আদালতে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে আলাদা দুটি সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এর মধ্যে ২০১৪ সালের ২৩ জুন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. রুহুল আমিন হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন।

রায়ে মুফতি হান্নান, বিএনপি নেতা ও সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনসহ আটজনের মৃত্যুদণ্ড এবং ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন বিচারক।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্য আসামিরা হলেন—মাওলানা আকবর হোসাইন, মুফতি আব্দুল হাই (পলাতক), হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর (পলাতক), মাওলানা আবু বকর, মুফতি শফিকুর রহমান (পলাতক) ও আরিফ হাসান সুমন। দণ্ডপ্রাপ্ত এ আট আসামিকে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ দেন আদালত। এছাড়াও তাদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।

এ বছরও রমনার বটমূলে নতুন বছরকে বরণ করতে মানুষের ঢল নামে

এ মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন—হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, মাওলানা সাব্বির, হাফেজ ইয়াহিয়া, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, মাওলানা আব্দুর রউফ ও মাওলানা শাহাদাৎ উল্লাহ জুয়েল। ৩০২/৩৪ ধারায় তাদের যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন

রমনার বটমূলে মানুষের ঢল, সুরের মূর্ছনায় বর্ষবরণ মঙ্গল শোভাযাত্রায় অন্ধকার দূর করার প্রত্যয়

বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় ২০১৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন মামলার অন্যতম আসামি মুফতি হান্নানসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এ মামলায় ৮৪ জনের মধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন ৫৪ জন।

এ মামলায় অভিযুক্তরা হলেন- মুফতি আব্দুল হান্নান, মাওলানা আকবর হোসাইন, মুফতি আব্দুল হাই, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মাওলানা আবু বকর, মুফতি শফিকুর রহমান, মাওলানা তাজউদ্দিন, আরিফ হাসান সুমন, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, মাওলানা সাব্বির, হাফেজ ইয়াহিয়া, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, মাওলানা আব্দুর রউফ ও মাওলানা শাহাদাৎ উল্লাহ জুয়েল।

এর মধ্যে ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল রাতে অন্য একটি মামলায় মুফতি হান্নানের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ফলে বিস্ফোরক আইনের এ মামলা থেকে অব্যাহতি পান শীর্ষ এ হুজি নেতা।

জেএ/এমকেআর/জেআইএম