অন্ধকার কাটিয়ে আলোর দিকে ধাবিত হওয়ার প্রত্যয়ে হলো ১৪৩১ সনের বাংলা নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা। এবারের শোভাযাত্রার স্লোগান ছিল ‘আমরা তো তিমিরবিনাশী’।
Advertisement
রোববার সকাল সোয়া ৯টায় শোভাযাত্রাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে থেকে শুরু হয়। এরপর শাহবাগের ঢাকা ক্লাবের সামনে দিয়ে ঘুরে টিএসসি মোড় হয়ে ফের চারুকলার সামনে গিয়ে পৌনে ১০টার দিকে শেষ হয় শোভাযাত্রা।
শোভাযাত্রায় আবহমান বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতীকী উপস্থাপনের নানা বিষয় স্থান পেয়েছে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রাণের উৎসব বর্ষবরণ। বাংলা নববর্ষ বরণে বাঙালির নানা আয়োজনের মধ্যে মঙ্গল শোভাযাত্রা অন্যতম।
আরও পড়ুন: এসেছে প্রাণের উৎসব ‘নববর্ষ’
Advertisement
বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার ৩৫ বছর পূর্তি হলো এ বছর। এবারের শোভাযাত্রার স্লোগানটি কবি জীবনানন্দ দাশের ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থের ‘তিমিরহননের গান’ কবিতা থেকে নেওয়া।
শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল। শোভাযাত্রায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রী দীপু মনি, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক উপদেষ্টা কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন স্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেন। শোভাযাত্রা উপলক্ষে কঠোর নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো ছিল পুরো এলাকা।
আরও পড়ুন: রমনার বটমূলে মানুষের ঢল, সুরের মূর্ছনায় বর্ষবরণ
শোভাযাত্রায় নিরাপত্তার কড়াকড়ি থাকলেও তারুণ্যের উচ্ছ্বাসের কাছে হার মানে সবকিছুই। ঢাক-ঢোলের বাদ্যের তালে তালে তরুণ-তরুণীদের নৃত্য, হৈ-হুল্লোড় আর আনন্দ উল্লাস মাতিয়ে রেখেছিল পুরো শোভাযাত্রা।
Advertisement
২০১৬ সালে জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে চালু হওয়া এ মঙ্গল শোভাযাত্রা।
শোভাযাত্রা উপলক্ষে সকাল থেকেই টিএসসি, দোয়েল চত্বর, শাহবাগ ও এর আশপাশের এলাকায় মানুষ জড়ো হতে থাকে। সকাল ৯টার মধ্যেই পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। লাল-সাদা পোশাকে উচ্ছল নারীদের মাথায় শোভা পায় নানান রঙ্গের ফুলের টায়রা। তরুণদের পরনে ছিল লাল-সাদা পাঞ্জাবি।
শোভাযাত্রা ঘিরে ছিল কয়েক স্তরের নিরাপত্তা। পুলিশ, র্যাবের সঙ্গে ছিল সোয়াত সদস্যরা। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও তৎপর ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে ড্রোনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানস্থল পর্যবেক্ষণ করতে দেখা গেছে।
এবারের শোভাযাত্রার শিল্প-কাঠামোগুলোর মধ্যে ছিল ময়ূর, হাতি, গন্ধগোকুল, টেপাপুতুল। মঙ্গলের বারতা পেঁচা। এছাড়া ছিল পাখি, মাছ, রাজা-রানির মুখোশ।
দুই পাখি ও কাঠঠোকরা। শোভাযাত্রায় আরও ছিল মা ও শিশু এবং বাঘের মুখোশ, টেপাপুতুল, রাজা-রানি, বাঘের মুখোশ।
পথিমধ্যে কেউ মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে পারেননি। কারণ চতুর্দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে মানবপ্রাচীর গঠন করা হয়। গতবারের মতো এবারও মুখোশ ব্যবহার ও ভুভুজেলা বাজানো নিষিদ্ধ ছিল শোভাযাত্রায়। নিরাপত্তার জন্য বন্ধ রাখা হয় রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকা ও কেন্দ্রীয় রাস্তা।
আরও পড়ুন: ‘পহেলা বৈশাখ বাঙালি জাতির প্রাণের অসাম্প্রদায়িক উৎসব’
যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে এসেছিলেন শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমরা তিন বন্ধু একসঙ্গে এসেছি। এটি বাঙালির প্রাণের উৎসব। সব ধর্মের লোক এখানে অংশ নেয়। খুবই উপভোগ করি।
অন্যদিকে সপরিবারে এসেছেন মালিবাগের আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রাণের টানে আসি। তবে এবার বেশ গরম। নিরাপত্তারও বাড়াবাড়ি রয়েছে।
বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। মিলেছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ সাল থেকে শুরু হয়েছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা।
শুরু থেকেই চারুকলার শোভাযাত্রাটির নাম ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ ছিল না। তখন এর নাম ছিল ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। ১৯৯৬ সালে এর নাম হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’।
বর্ষবরণ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা চারুকলায় ১৯৮৯ সালে শুরু হলেও এর ইতিহাস আরও কয়েক বছরের পুরোনো। ১৯৮৫ বা ১৯৮৬ সালে চারুপীঠ নামের একটি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে আনন্দ শোভযাত্রার আয়োজন করে।
যশোরের সেই শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরনো বাদ্যসহ আরও অনেক শিল্পকর্ম। শুরুর বছরেই যশোরে সেই শোভাযাত্রা আলোড়ন সৃষ্টি করে।
যশোরের সেই শোভাযাত্রার উদ্যোক্তাদের একজন মাহবুব জামাল শামীম মাস্টার্স ডিগ্রি নিতে পরে ঢাকার চারুকলায় চলে আসেন। পরবর্তীতে যশোরের সেই শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকার চারুকলা থেকে শুরু হয় ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা।’
আরএমএম/জেডএইচ/এমএস