• ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ নয়, পাঠ্যবইয়ে ‘হিজড়াই’ উপযুক্ত শব্দ• মনে মনে নিজেকে ছেলে বা মেয়ে ভাবার সুযোগ নেই• শিশুমনে ‘গুরু মা’ প্রথার ধারণা দেওয়া উচিত নয়• শরীফার গল্পে প্রশ্নের অংশেও আসতে পারে পরিমার্জন
Advertisement
পাঠ্যবইয়ের ভুল-ত্রুটি নতুন নয়। কয়েক বছর ধরেই বই ছাপার পর নানান আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। চলতি বছর প্রচলিত ‘ভুল-ত্রুটি’ ছাপিয়ে বিতর্কের কেন্দ্রে ‘শরীফার গল্প’। নতুন শিক্ষাক্রমের সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ‘মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা’ অধ্যায়ের এ গল্প নিয়ে বিপাকে পড়েছে সরকারও। বাধ্য হয়ে গল্পটি পরিমার্জনের জন্য কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে আড়াই মাসের বেশি সময় পার হলেও প্রতিবেদন দিতে পারেনি কমিটি। তুমুল আলোচিত এ গল্পের সংশোধনী কবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশায় খোদ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
এনসিটিবি কর্মকর্তারা বলছেন, বিশেষজ্ঞ কমিটি শরীফার গল্প নিয়ে কোনো প্রতিবেদন দেয়নি। তারা প্রতিবেদন দিলে এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় তা বিশ্লেষণ করে যে সিদ্ধান্ত দেবে, সেটি চূড়ান্ত হবে। এরপর সংশোধনী পাঠানো হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শরীফার গল্প নিয়ে সিদ্ধান্ত না হওয়ায় বইয়ের সংশোধনী পাঠানোর প্রক্রিয়ায়ও ঝুলে আছে।
‘শরীফার গল্প’ রিভিউ করতে গিয়ে বিপাকে পড়ার কথা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্যরা। তারা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা দিতে আগ্রহী। তবে তা রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ার শঙ্কায় মতামত দিতে গড়িমসি করছেন কমিটির কোনো কোনো সদস্য। তারপরও ঈদের পর একটি প্রতিবেদন দেওয়ার চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন কমিটির প্রধান এবং দুজন সদস্য।
Advertisement
কমিটির বিশেষজ্ঞ সদস্যদের মতে, শরীফ থেকে শরীফা হওয়ার গল্প নিয়ে আপত্তির জায়গাটি মূলত ধর্মীয়। আরও স্পষ্ট করে বললে, ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী এ গল্পে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতেই কমিটি গঠন। এজন্য কমিটিতে আহ্বায়কসহ ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তিনজনকে রেখেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
কমিটিতে থাকা ইসলামিক স্কলার বা বিশেষজ্ঞরা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মতামত দেওয়ার পক্ষে। সেক্ষেত্রে ‘তৃতীয় লিঙ্গ (থার্ড জেন্ডার)’, ‘মেয়ের অবয়বে জন্ম নিয়েও মনে মনে নিজেকে ছেলে ভাবা’, ‘গুরু মা’, ‘শিশু ও নতুন বউকে আশীর্বাদ করে অর্থ আয়-রোজগার’ শব্দের ব্যবহার বাদ দেওয়ার সুপারিশ করবেন তারা। তাদের এ মতামত রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হচ্ছে কি না, তা নিয়ে আরও চিন্তা-ভাবনার জন্য সময় নিচ্ছেন তারা।
‘তৃতীয় লিঙ্গ’ নয়, ‘হিজড়াই’ উপযুক্ত শব্দ
ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ৩৯ নম্বর পৃষ্ঠায় শরীফার গল্প শুরু। গল্পটি মোট ৩৭৪ শব্দের। গল্পের একপর্যায়ে শরীফ থেকে শরীফা হওয়া ব্যক্তির ভাষ্যে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হচ্ছে, ‘একদিন এমন একজনের সঙ্গে পরিচয় হলো, যাকে সমাজের সবাই মেয়ে বলে কিন্তু সে নিজেকে ছেলে বলেই মনে করে। আমার মনে হলো, এই মানুষটাও আমার মতন। সে আমাকে বলল, আমরা নারী বা পুরুষ নই, আমরা হলাম তৃতীয় লিঙ্গ (থার্ড জেন্ডার)।’
Advertisement
গল্পের তৃতীয় লিঙ্গ শব্দের ব্যবহার নিয়ে ইসলামে আপত্তি রয়েছে বলে মনে করেন কমিটির বিশেষজ্ঞ সদস্যরা। তাদের মতে, ইসলামের প্রাথমিক যুগেও হিজড়া ছিল। তাদের ব্যাপারে ধর্মীয় স্পষ্ট বিধানও রয়েছে। এ নিয়ে কোনো সংশয় বা অস্পষ্টতা নেই। তবে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ শব্দ নিয়ে ইসলাম ধর্মে আপত্তি রয়েছে।
আরও পড়ুন
এক সপ্তাহেও বৈঠকে বসেনি পর্যালোচনা কমিটি, প্রতিবেদন কবে? ‘শরীফ থেকে শরীফা’ গল্প পর্যালোচনায় ৫ সদস্যের কমিটিকমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘হিজড়ারা সবসময় ছিল। মহানবি হজরত মুহাম্মদের (সা.) যুগেও হিজড়ারা ছিলেন। ইসলামে তাদের ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। কিন্তু তৃতীয় লিঙ্গ বলে কোনো কিছুকে ইসলাম সমর্থন করে না। শরীফার গল্পে থার্ড জেন্ডার (তৃতীয় লিঙ্গ) কথাটি রয়েছে। এটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তৃতীয় লিঙ্গ শব্দ ব্যবহার ও তার বিস্তৃতি ছড়ানোর ব্যাপারে ঘোর আপত্তি রয়েছে।
মনে মনে নিজেকে ছেলে বা মেয়ে ভাবার সুযোগ নেই
গল্পের একপর্যায়ে শরীফ থেকে শরীফা হওয়া ব্যক্তি তার জীবনের কথা বলতে শুরু করেন। তার ভাষ্যে বইয়ে উল্লেখ রয়েছে, ‘ছোটবেলায় সবাই আমাকে ছেলে বলত। কিন্তু অমি নিজে একসময় বুঝলাম আমার শরীরটা ছেলেদের মতো হলেও আমি মনে মনে একজন মেয়ে। আমি মেয়েদের মতো পোশাক পরতে ভালোবাসতাম।
‘শরীফ’-র শারীরিক অবয়ব ছেলেদের মতো। কিন্তু তিনি নিজেকে মেয়ে ভাবতেন। ছেলে লিঙ্গ নিয়ে জন্ম নিয়েও নিজেকে মেয়ে ভাবার এ প্রবণতা ইসলামে স্পষ্টই হারাম ও গর্হিত কাজ বলে মনে করেন কমিটির দুজন বিশেষজ্ঞ।
কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, গল্পের ব্যক্তি ছেলে হয়ে জন্ম নিয়েছেন। সবাই তাকে ছেলে হিসেবে দেখছেন, জানছেন। তার লিঙ্গও ছেলেদের। অথচ হঠাৎ তার মেয়েদের মতো মনে হলো। কেন এমনটি মনে হলো? এর তো কোনো কারণ থাকতে হবে। ছেলে লিঙ্গ নিয়ে জন্ম নিয়েও হঠাৎ নিজেকে মেয়ে ভাবাটা ইসলাম ধর্ম কোনোভাবেই সমর্থন করে না। শরিয়ত মতে, হিসাব করতে গেলে গল্পের এ অংশে পরিবর্তন আনতে হবে।
কমিটির সদস্য ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গভর্নর মুফতি মাওলানা কফিল উদ্দীন সরকার জাগো নিউজকে বলেন, শরীফা নিজেও ছেলে হয়ে নিজেকে মেয়ে হিসেবে দেখতে চাইতেন। আবার তিনি এমন আরেকজনের গল্প শোনাচ্ছেন যিনি নাকি নারী-পুরুষ কিছুই না। এটা ইসলাম সমর্থন করে না। সবাই তাকে মেয়ে মনে করলেও সে নিজেই নিজেকে ছেলে মনে করে। এটা শিশুদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
আরও পড়ুন
পাঠ্যবইয়ে ‘শরীফার গল্প’ নিয়ে বিভ্রান্তি থাকলে সংশোধন হবে ‘বুঝতে হবে ট্রান্সজেন্ডার আর হিজড়া এক নয়’তিনি বলেন, জন্মের সময় প্রত্যেক শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ করে দেন আল্লাহ। ছেলে, মেয়ে এবং অস্পষ্ট লিঙ্গধারী, যেটিকে আমরা হিজড়া বলি। ছোট বেলায় কেউ স্পষ্টই মেয়ে হয়ে জন্ম নিলো। বড় হয়ে তার শখ হলো যে, সে ছেলে হতে চায়। এটা সমাজে অশান্তির সৃষ্টি করবে। এটা ইসলামের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়।
‘গুরু মা’ প্রথা প্রমোট করা যাবে না
শরীফার গল্পে ‘গুরু মা’ নামের একজন চরিত্রও আছেন। যেখানে হিজড়ারা একসঙ্গে থাকেন, সেখানে সবার দেখভাল করেন তিনি। বলা চলে তিনিই ওই দলের নেতা। কমিটির বিশেষজ্ঞদের মতে, গুরুমা বিষয়টি গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরে প্রমোট করা হচ্ছে। এটা করা যাবে না।
এ প্রসঙ্গে কমিটির প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, হিজড়ারাও মানুষ। শান্তির ধর্ম ইসলাম বলে হিজড়াদেরও পরিবারের সঙ্গে স্বাভাবিক জীবনযাপন করাতে হবে। তাকে গুরুমায়ের কাছে যেতে দেওয়ার মানেই হয় না। গল্পে যে গুরুমায়ের কথা বলা হয়েছে, সেটাকে এভাবে প্রমোট করা ঠিক হবে না।
তিনি বলেন, হিজড়া জনগোষ্ঠীকে আলাদা করা উচিত নয়। আগে আমরা প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা স্কুল খুলতাম। কিন্তু এখন তাদের আমরা অন্য সব শিক্ষার্থীদের সঙ্গেই পড়াচ্ছি। এটা তাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন বয়ে আনছে। তেমনি হিজড়াদেরও মূলস্রোতে আনতে হবে। তাদের ‘গুরুমা’ ধারণা দেওয়া যাবে না। বরং পরিবারের সঙ্গেই বসবাসে উৎসাহিত করে এমন শব্দের ব্যবহার বাড়াতে হবে।
গল্পের প্রশ্ন পর্বেও পরিমার্জন জরুরি
শরীফার গল্পের শেষে শিক্ষার্থীরা কিছু প্রশ্ন তুললো। এরপর ছেলেদের জিনিস ও মেয়েদের জিনিস নিয়ে আলোচনা পর্ব চললো। এরপর শ্রেণিশিক্ষক খুশি আপা বললেন, কয়েকটা প্রশ্নের মাধ্যমে আমরা চিন্তার খোরাক পেতে পারি। তখন ক্লাসের শিক্ষকরা কিছু প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করলো।
সেখানে তৃতীয় প্রশ্নে বলা হচ্ছে, ‘একজন মানুষকে বাইরে থেকে দেখেই কি সবসময় সে ছেলে নাকি মেয়ে তা বোঝা যায়?’ শেষ প্রশ্নটি হলো— ‘এমনটি কি হতে পারে যে, কাউকে আমরা তার শারীরিক বৈশিষ্ট্য দেখে, গলার স্বর শুনে ছেলে বা মেয়ে বলে ভাবছি। কিন্তু সে নিজেকে ভিন্ন কিছু ভাবছে? পাঁচটি প্রশ্নের মধ্যে এ দুটি প্রশ্নও কিছুটা পরিমার্জন করা যেতে পারে বলে মনে করেন কমিটির একাধিক সদস্য।
দুটি প্রশ্ন প্রসঙ্গে ঢাকা আলিয়া মাদরাসার অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, শারীরিক বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ, লিঙ্গ এবং অবয়ব দেখে ছেলে-মেয়ে পার্থক্য করা খুবই সহজ ও সাবলীল বিষয়। সেটিকে এখানে জটিল করা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। কেউ ছেলে লিঙ্গ পেলেন, অবয়ব ছেলেদের মতো হলো। তারপরও প্রশ্ন রাখা হচ্ছে, নিজেকে সে ভিন্ন কিছু ভাবছে কি না? এটা ভাবা তো আর উচিত নয়। এ ভাবার অনুমতি বা অধিকার ইসলাম ধর্মে নেই।
শরীফার গল্পের প্রতিবেদন কবে?
শরীফার গল্প বেশি আলোচনায় আসে গত ১৯ জানুয়ারি। ওইদিন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক আসিফ মাহতাব উৎস জাতীয় শিক্ষক ফোরামের অনুষ্ঠানে বই থেকে ওই গল্পের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলেন এবং অন্যদেরও ছেঁড়ার আহ্বান জানান। মুহূর্তেই ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে পড়ে। শুরু হয় তুমুল আলোচনা-সমালোচনা।
পরিস্থিতি সামাল দিতে ‘শরীফার গল্প’ পর্যালোচনা করে প্রয়োজনে পরিমার্জনের জন্য ২৪ জানুয়ারি বিশেষজ্ঞ কমিটি করে দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আড়াই মাস পার হলেও কমিটি প্রতিবেদন দিতে পারেনি। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে কমিটির প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, প্রথম দিকে একজন সদস্য অসুস্থ থাকায় বসতে পারিনি। তারপর আমরা বসেছি বেশ কয়েকবার। বিষয়টিও স্পর্শকাতর। আমরা আলোচনা করেছি, মতামত দিয়েছি। ঈদের পর আরেকটি মিটিং হবে। সেখানে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে সবার সই নিয়ে জমা দেবো।
কমিটির সদস্য সচিব ও এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, এতে বেশি কিছু পরিবর্তনের সুযোগ আছে বলে মনে করি না। তারপরও কমিটির সব সদস্যের মতামতের ভিত্তি প্রতিবেদন দেওয়া হবে। শিগগির আমরা তা জমা দেওয়ার চেষ্টা করবো।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, পরিমার্জন হবে কি না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমরা কবে সংশোধনী পাঠাবো; সবই কমিটির প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করছে। তারা তো এখনো প্রতিবেদন দিলেন না। কবে দেবেন, তাও জানি না। আমার কোনো ধারণাও নেই। তাদের প্রতিবেদন ও সুপারিশ না পাওয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী পাঠানোর প্রক্রিয়াও ঝুলে আছে।
এএএইচ/এমএইচআর/এসএইচএস/জেআইএম