বেশ ঘটা করেই সিএনএন এবং বিবিসিসহ পশ্চিমা গণমাধ্যম বলে যাচ্ছে যে, ইরান যে কোনো মুহূর্তে ইসরায়েল আক্রমণ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তো অনেকটা নিশ্চিত করেই বলছেন যে এই আক্রমণ হবে।
Advertisement
ইসরায়েলে ইরানের হামলা এখন একটি বাস্তব ও গ্রহণযোগ্য হুমকি হয়ে উঠেছে বলে হোয়াইট হাউস বলছে। প্রায় দুই সপ্তাহ আগে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে ইসরায়েলি হামলায় দেশটির কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সামরিক কমান্ডার নিহত হওয়ার পর থেকেই ইরানের সম্ভাব্য প্রতিশোধমূলক হামলা নিয়ে উদ্বেগ চলছে। ইসরায়েলের স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরেও এমনটা বলা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। কয়েকটি ভারতীয় গণমাধ্যমও দেখলাম এমন খবর দিয়েছে এবং ভারতীয়দের ইরান এবং ইজ়রায়েলে না যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে সরকারের তরফে।
গত ১ এপ্রিল দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে যুদ্ধবিমান থেকে ওই হামলা চালানো হয়। এতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় কনস্যুলেটটি। নিহত হন ইরানের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা। এরপর দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেছেন, এই কর্মকাণ্ডের জন্য ইসরায়েলকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে।
এর আগে গত বছর ডিসেম্বরে সিরিয়ায় রাজধানী দামেস্কের বাইরে ইসরায়েলের বিমান হামলায় ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের এক জ্যেষ্ঠ কমান্ডার সাইদ রাজি মৌসাভি নিহত হয়েছেন। রেভল্যুশনারি গার্ডের এলিট বাহিনী কুদস ফোর্সের সাবেক কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলাইমানির সহচরদের একজন ছিলেন সাইদ রাজি। ২০২০ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় সোলাইমানি নিহত হয়েছিলেন।
Advertisement
একের পর এক শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা মারা যাচ্ছে ইরানের কিন্তু কিছু করতে পারছে না। শুধু হুমকিই দিয়ে যাচ্ছে। কারণ কী, সেটাই জানতে আগ্রহী মানুষ।
তবে এবার মার্কিন সামরিক কর্মকর্তার অনেকটা নিশ্চিত যে, ইরান আক্রমণ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যম সিবিএসকে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, শিগগিরই বড় ধরনের হামলা চালাতে পারে ইরান। এ হামলায় শতাধিক ড্রোন ও কয়েক ডজন ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হতে পারে। ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইসরায়েলের সামরিক স্থাপনাগুলোতে এ হামলা হতে পারে। তা ঠেকানো ইসরায়েলের জন্য কঠিন হবে।
কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন, সেটা ইরান জানে। কারণ ইসরায়েলকে আক্রমণ করা মানে আসলে যুদ্ধটা শুরু হবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে, কারণ যুক্তরাষ্ট্র সবসময় ইসরায়েলে সব অন্যায়কে নগ্নভাবে সমর্থন কে যাচ্ছে এবং আগামীতেও করে যাবে বলে জানিয়েছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এরই মধ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, ইরান হামলা চালালে ইসরায়েলকে ‘লৌহবর্মের’ মতো সমর্থন দিয়ে যাবেন তারা। এই যুদ্ধে ইরানের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে যুক্তরাজ্য ও পশ্চিম ইউরোপ।
হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের সংঘাতের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে ইরান। ইসরায়েলে এবং ইরান এখনও পর্যন্ত সরাসরি যুদ্ধে না গেলেও দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনা অনেক বেশি। তবে ইরানের জন্য পরিস্থিতি এতটা সহায়ক নয়। সিরিয়ার দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে ইসরায়েলি হামলায় ১৩ জন নিহত হবার পর ইরানের জন্য জন্য একটি কঠিন সময় যাচ্ছে। একদিকে এই হামলার জবাব দিতে চাইছে দেশটি। অন্যদিকে ইরান এমন কোনো কাজ করতে চায় না যার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
Advertisement
আক্রমণ যদি করেও তবে কীভাবে হবে সেটিও একটি বিষয়। ড্রোন ও মিসাইল হামলা ইরাক ও সিরিয়ার মাটি থেকে নাকি ইরানের ভেতর থেকে পরিচালনা করা হবে সেটিও এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি মার্কিন গোয়েন্দারা। ইসরায়েল বলেছে যে ইরান যদি পাল্টা আঘাত করে তাহলে তারা আবারো হামলা চালাবে। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধের সংকেত বেজে উঠতে পারে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ইসরায়েল মঝ্যপ্রাচ্যে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ চায়। জো বাইডেনও নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ চান।
যা বলছিলাম, ইরান বড় জটিলতায় পড়েছে। ইসরায়েলি হামলার যথাযথ জবাব দিতে না পারলে ইরানের সামরিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। ফলে ভবিষ্যতে ইসরায়েল ইরানকে আরও দুর্বল ভাববে এবং তাদের ওপর চেপে বসবে। ইরানকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা দুর্বল নয়। যে কোনো হামলার জবাব দেবার ক্ষমতা তাদের রয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের কোনো যুদ্ধের সূত্রপাত না করে ইরান কীভাবে ইসরায়েলকে জবাব দিতে পারে সেটি নিয়ে এক ধরনের দোদ্যুল্যমানতা তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে ইসরায়েলকে পাল্টা আঘাত করার মতো সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সামর্থ্য ইরানের রয়েছে কী না? আসলে ইসরায়েলের সাথে সংঘাতে জড়ানোর মতো সামর্থ্য ইরানের নেই। কিন্তু দেশের ভেতরে জনগণকে দেখানোর জন্য হলেও ইরানকে একটি জবাব দিতে হবে। এছাড়া নিজেদের মিত্রদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা টিকিয়ে রাখার জন্যও ইরানকে একটি পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রকৃত অবস্থা এই যে, ইরান তাড়াহুড়া করবে না। ইসরায়েলের কাছে ইরান যতই অপদস্থ হোক না কেন, এর কড়া জবাব দেবার সম্ভাবনা খুবই কম। এর পরিবর্তে ইরানকে ‘কৌশলগত কারণে ধৈর্য’ ধরতে হবে। কারণ, ইরানের এখন অগ্রাধিকার হচ্ছে পারমাণবিক বোমা তৈরি করা। কিছু ব্যালিস্টিক মিসাইল ছুঁড়ে ১০০ জন ইসরায়েলিকে হত্যা করার চেয়ে পারমাণবিক বোমা তৈরির পথে এগিয়ে যাওয়া যুক্তিযুক্ত। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে শুধু ইসরায়েল নয়, পশ্চিমা বড় শক্তিকেও মোকাবিলা করার সক্ষমতা অর্জন করবে ইরান।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/এএসএম