জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও উপস্থাপক শফিক রেহমান একজন ভালোবাসার মানুষ। তিনি ভালোবাসা ছড়িয়ে দিয়েছেন সারাদেশে। তার বদৌলতে ভালোবাসা দিবস বাংলাদেশে পেয়েছে জনপ্রিয়তা। তিনি নিজে মৃত্যুদণ্ড বন্ধে বই লিখেছেন। সেই বইয়ের জনপ্রিয়তায় দেশ-বিদেশ ঘুরেছেন। কিন্তু এমনই একজন মুক্তমনা ও প্রগতিশীল লেখককে সরকার অন্তরীণ করে বাকশালী আচরণই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। কলমসংগ্রামী এ মানুষটির কলমকে থামিয়ে দিতেই সরকার অন্তরীণ করেছে বলে মন্তব্য করেছেন তার স্ত্রী তালেয়া রেহমান।রোববার দুপুরে রাজধানীর ১৫, ইস্কাটনের বাসায় জাগো নিউজকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এমন কথা বলেছেন তালেয়া রেহমান। সাক্ষাৎকারে তিনি শফিক রেহমানের মুক্তি দাবি করেছেন। পাশাপাশি দমনপীড়ন করে আওয়ামী লীগ কখনো ক্ষমতা স্থায়ী করতে পারবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ জাগো নিউজের পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো।জাগো নিউজ : বুঝতেই পারছি আপনার মানসিক অবস্থা। শফিক রেহমানের মুক্তির ব্যাপারে কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন?তালেয়া রেহমান : আপনারা জানেন তিনি (শফিক রেহমান) বাংলাদেশের পাশাপাশি ব্রিটিশ নাগরিক, আমিও। আমার ছেলে লন্ডনেই থাকে। শুধু দেশের টানেই দেশকে ভালোবেসেই আমরা এদেশেই রয়ে গেছি। এই দেশের মানুষও আমাদের ভালোবাসে। ও তো জনপ্রিয় এক ভালোবাসার মানুষ। ওকে গ্রেফতারে খুবই মর্মাহত হয়েছি। ইতোমধ্যে ব্রিটিশ হাইকমিশন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আমি আজ (রোববার) ব্রিটিশ হাইকমিশনে গিয়ে দেখাও করে এসেছি। আর পাশাপাশি আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্তির বিষয়ে চেষ্টা চলছে।জাগো নিউজ : ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে তিনি ব্রিটিশ হাইকমিশনের সহায়তা পেতেই পারেন। তারা কি কোনোভাবে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন?তালেয়া রেহমান : জি, মুক্তির বিষয়ে তারা নানা পরামর্শ দিয়েছেন। পাশাপাশি অন্তত ওয়েলফেয়ারের বিষয়টি তারা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। তারা সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করে প্রবীণ এ মুক্তমনা মানুষটির মুক্তির চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন।জাগো নিউজ : যে অভিযোগ কিংবা মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে তা কি আগে থেকে জানতেন?তালেয়া রেহমান : না, জানতাম না। কারণ এর আগে বিষয়টি আমরা শুনলেও মামলার বিষয়টি জানতাম না। কারণ মামলায় তার কোনো নামই নেই। আর প্রধানমন্ত্রী-পুত্রকে অপহরণ-ষড়যন্ত্রে যারা অংশ নিয়েছিল তারা তো আমেরিকাতেই আটকা পড়েছে। কই তখন তো শুনিনি শফিকের নাম?জাগো নিউজ : গ্রেফতারের পর তো দেখা করতে পারেননি। ডিবি পুলিশের পক্ষ থেকে কি কোনো ধরনের যোগাযোগ হয়েছে আপনার?তালেয়া রেহমান : না, ডিবি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তবে তার প্রতিদিনের ওষুধ, নাস্তা এবং পছন্দের খাবার চেয়ে ডিবি অফিস থেকে টেলিফোন করা হচ্ছে। আমরা সেসব পৌঁছে দিচ্ছি। গতকাল গ্রেফতারের পর আমি নিজে দেখা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু অতিথি কক্ষে বসে থেকে ফিরে এসেছি। দেখা করতে দেয়া হয়নি।জাগো নিউজ : আপনার কী মনে হয়? কী কারণে শফিক রেহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে?তালেয়া রেহমান : দেশের মানুষ সবাই জানে শফিক রেহমান একজন মুক্তমনা, প্রগতিশীল লেখক, বুদ্ধিজীবী। তিনি এদেশে ভালোবাসার মানুষ হিসেবে পরিচিত। তিনি নিজে মৃত্যুদণ্ড-বিরোধী প্রচার চালিয়েছেন। বই লিখেছেন। দেশ-বিদেশ ঘুরে মৃত্যুদণ্ড-বিরোধী প্রচারে অংশ নিয়েছেন। সেই মানুষটির বিরুদ্ধে যদি কাউকে অপহরণ করার অভিযোগ তোলে তাহলে কেউ কি তা মানতে পারবে? শফিক রেহমানের বাবা বঙ্গবন্ধুর শিক্ষক ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমার শ্বশুরকে খুবই সম্মান করতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের; তারই কন্যা শেখ হাসিনা সরকারের হাতেই আমার স্বামী আজ অন্তরীণ। অভিযোগ সবই মিথ্যে। এমন অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। যে মামলা হয়েছে সে মামলায় শফিক রেহমানের নামও ছিল না। তবুও আজ তিনি অন্তরীণ। গ্রেফতারের কারণ তিনি স্পষ্টবাদী মানুষ। যা বলেন মুখের উপর বলেন। রাখঢাক না করে প্রতিবাদ করেন। প্রগতিশীল মুক্তমনা এ মানুষটির কলমকে থামিয়ে দিতেই সরকার তাকে অন্তরীণ করেছে।জাগো নিউজ : সরকার পক্ষের লোকজন তো বলছেন তিনি বিএনপি নেতা। তিনি বিএনপির লবিস্ট হিসেবে কাজ করেন?তালেয়া রেহমান : এসবই মিথ্যাচার। তিনি বিএনপির কোনো প্রোস্টেট লিডার নন। তিনি খালেদা জিয়ার উপদেষ্টাও নন। তাছাড়া তিনি বিএনপির কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও যান না। তবুও যদি কেউ বলেন তিনি বিএনপি নেতা তাহলে তাকে আপনি কী বলতে পারেন? তবে তিনি সম্প্রতি দলমত নির্বিশেষে সৃজনশীল কিছু কাজে অংশ নিয়েছেন বটে।জাগো নিউজ : আওয়ামী লীগ পক্ষ তো বলছে যে তিনি খালেদা জিয়ার স্ক্রিপ্ট লিখে দেন। বক্তৃতা লিখে দেন। আন্তর্জাতিক লবিস্ট হিসেবে কাজ করেন?তালেয়া রেহমান : আশ্চর্য ধরনের কথা। তিনি তো পেশাদার লেখক, সাংবাদিক। খালেদা জিয়ার সঙ্গে তো আজ থেকে আমাদের পরিচয় নয়। একজন প্রবীন সাংবাদিক লেখক হিসেবে শফিক রেহমানের কাছে তিনি সহযোগিতা নিতেই পারেন। শফিক তাকে সহযোগিতা করতেই পারেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি কখনো ডেকেছেন? বলেছেন কখনো আমার এই কাজে একটু সহযোগিতা করেন? তিনি ডেকে না পেলে না এই ধরনের কথা বলা শোভা পায়। আসলে এসব কিচ্ছু নয়। তাকে গ্রেফতার করে চাপে রেখে তার কলম বন্ধ করতে চায় সরকার।জাগো নিউজ : আপনি কি মনে করেন শফিক রেহমানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে এর কোনো ভিত্তি নেই?তালেয়া রেহমান : মামলা করা হয়েছে ৩ বছর আগে। দেখুন শফিক রেহমান ২০১৩ সালে আমেরিকাতেই যাননি। তিনি রুয়ান্ডা, জার্মানি ও ইংল্যান্ডে গেছেন। যুক্তরাষ্ট্র গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ করে হত্যার পরিকল্পনা করার প্রশ্নেই ওঠে না।জাগো নিউজ : শফিক রেহমানকে গ্রেফতারের বিষয়টি আপনি কী হিসেবে দেখছেন? সরকারের কাছে আপনার কোনো মেসেজ রয়েছে কিনা?তালেয়া রেহমান : আমি যুবসমাজের প্রতি আহ্বান জানাবো শফিক রেহমানকে তা আরো ভালো করে জানতে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকে শফিক রেহমানের পরিবার এ দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছেন। এই বাড়িতে থাকতেই এ দেশে স্বাধীনতার যুদ্ধ দেখেছি। অনেক কষ্ট সহ্য করেছি। কিন্তু পালাইনি। এরশাদের পতনের দাবিতে পুরো দেশ যখন অচল তখন ডেমোক্রেসি ওয়াচ রিপোর্ট এরশাদের ভীত নড়িয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক চাপ এসেছে। ইচ্ছে করলেই আমরা লন্ডন পাড়ি জমাতে পারতাম। দেশকে ভালোবাসি বলেই থেকে গেছি। এর মানে এই নয় এই সরকারের সব ধরনের অন্যায় আচরণ মেনে নেবো। শফিক রেহমানকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। সরকার কী বোঝাতে চাইছে? দমনপীড়ন চালিয়ে মুক্তমনা মানুষের মুখ বন্ধ রাখা যায়? কলম বন্ধ করা যায়? যায় না। সরকার যে আচরণ করেছে তা তো বাকশালী আচরণ। বাক-স্বাধীনতা হরণের নামান্তর। সরকারকে জানাতে চাই, জনগণের বাক-স্বাধীনতা হরণ করে ক্ষমতায় কখনো স্থায়ীত্ব আসে না। বরং ভেঙে পড়ে।জেইউ/বিএ
Advertisement