মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-ফিতর। এক মাস সিয়াম সাধনার পর এই উৎসব পালন করা হইয়। পুরো বিশ্বের মুসলিম ধর্মের অনুসারীরা শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখার পর ঈদ পালন করেন। পুরো বিশ্বই যেন ঈদের খুশি ও আনন্দে মেতে ওঠে। তবে ঈদ পালনের কিন্তু একেক দেশে একেক রীতি।
Advertisement
চলুন বিভিন্ন দেশের ঈদ উদযাপনের রীতি জেনে আসি-
ইন্দোনেশিয়াপৃথিবীর মোট মুসলিমের প্রায় ১৩ শতাংশই থাকেন ইন্দোনেশিয়ায়! তাদের জনসংখ্যার ৮৭ শতাংশ মুসলিম। তাই সেখানে ঈদ ভীষণ ধুমধাম করে পালন করা হয়। দেশটিতে ঈদ-উল-ফিতারকে লেবারান বলা হয়ে থাকে। ঈদের সন্ধ্যায় বাচ্চারা ড্রাম, টর্চ নিয়ে রাস্তায় প্যারেড করে। রাতের আকাশকে আতশবাজির আলোয় রাঙিয়ে দেওয়া হয়। মানুষজন ঈদ উপলক্ষ্যে পরিবারের কাছে চলে যায়। হালাল বি হালাল নামের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়ানরা পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাতকালে ঈদের শুভেচ্ছা জানায় এবং ক্ষমা চায় পূর্ববর্তী কোনো ভুলের জন্যে। এজন্য বড়রা ছোটদের দু হাত ধরে হাত মেলায় এবং ছোটরা বড়দের হাত, কপাল, গাল স্পর্শ করে।
তুরস্কতুরস্কের মোট জনগোষ্ঠীর ৯৮ -৯৯ শতাংশই মুসলিম! ঈদ উৎসব এদেশে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তুরস্কে পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরকে রামজান বায়রাম অথবা সেকের বায়রামও বলা হয়ে থাকে। বায়রাম শব্দটির মানে হচ্ছে জাতীয়ভাবে পালিত উৎসব। এই দিনে অনেকে কবরস্থানে গিয়ে মৃত মানুষের জন্য প্রার্থনা করেন। একটি মজার ঈদ সংস্কৃতি আছে তাদের। বাচ্চারা পাড়া প্রতিবেশীদের বাড়িতে গিয়ে বলে ‘শুভ বায়রাম’ এবং নানা রকম টার্কিশ মিষ্টি, চকলেট, পেস্ট্রি অথবা টাকা পেয়ে থাকে। তাই ঈদকে সামনে রেখে দেশটিতে মিষ্টি কেনার ধুম পড়ে যায়। ছোটরা বড়দের ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে, ডান হাতে চুমু খায়।
Advertisement
আফগানিস্তানআফগানিস্তানের ৯৯.৭ শতাংশই মুসলিম! ঈদ উৎসব বিশেষভাবে পালিত হওয়াই স্বাভাবিক। আফগানরা নতুন পোশাক পরিধান করে, ঈদের নামাজ আদায় করে, আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে গিয়ে, বাড়ি পরিষ্কার করে, মজার সব খাদ্য রান্না করে ঈদকে স্বাগতম জানায় অন্য যে কোনো দেশের মতোই। তবে তাদের ভীষণ মজার একটি ঈদ ঐতিহ্য আছে যার নাম টখম-জ্যান্গি অথবা ডিম যুদ্ধ! এই উৎসবে সব বয়সের মানুষ খোলা জায়াগায় মিলিত হয় সেদ্ধ ডিম নিয়ে এবং একে অপরের ডিম ভাঙার চেষ্টা করে!
সৌদি আরবসৌদি আরবের জাতীয় উৎসব হল ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আজহা। তিন দিন সরকারি ছুটি থাকে। তাদের একটি প্রচলিত রীতি হলো পুরুষরা তাদের ছেলেমেয়ে, স্ত্রী নিয়ে বাবার বাসায় ঈদ পালন করবে। ঈদ উপলক্ষে খাবার ও উপহার দেয়া হয়। এমনকি অমুসলিমদেরও উপহার দেওয়া হয়। গরিবদের খাবার বিতরণ করা হয়। ঘরে ঘরে মিষ্টিজাতীয় খাবার বানানো হয়। এ সময় আত্মীয়-প্রতিবেশীরা বেড়াতে আসেন। অনেকে আবার বাইরে বিভিন্ন পার্কে বেড়াতে যান ও একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করেন।
মালয়েশিয়ামুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ মালয়েশিয়ায় ঈদ-উল-ফিতর বড় করে উদযাপিত হয়। এ সময় সরকারি ছুটি থাকে। সবাই নিজ নিজ পরিবারের সঙ্গে ঈদ পালন করে। এখানে ঈদের আগের দিন থেকেই উৎসব পালিত হয়। ঈদের আগের রাতকে তাকবিরান বলা হয়। মসজিদ ও রাস্তায় তাকবির ধ্বনি উচ্চারিত হয়। রাস্তাঘাটে মশাল, আতশবাজি করা হয়। তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার রেন্দাং, কেতুপাট, লেমাং রান্না করে। শহরে ঘরে ঘরে প্রচুর পরিমাণে খাবার রান্না করে প্রতিবেশী এমনকি অমুসলিমদেরই দাওয়াত দেওয়া হয়। খাওয়ার পর গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। চীন থেকে বাঁশি আমদানি করা হয়। এ বাঁশি খুব জোরে বাজে। সন্ধ্যায় বাজি উৎসব চলে।
সোমালিয়াসোমালিয়ার ৯৯ শতাংশ মানুষ মুসলিম। ঐতিহ্যবাহী নাচের মাধ্যমে ঈদকে স্বাগতম জানাচ্ছেন এক সোমালি পুরুষ। ঈদ উপলক্ষ্যে এক নারী হাতে মেহেদি দিয়েছেন। অন্যান্য দেশের মতোই, ঈদের দিনে নতুন পোশাক পরিধান করেন সোমালিরা। পরিবার পরিজনের সঙ্গে মুখোরচক ট্রাডিশনাল খাদ্য উপভোগ করে থাকেন।
Advertisement
মরক্কোদেশটির ৯৯ শতাংশ জনগোষ্ঠী ইসলাম ধর্মালম্বী। জাকাত আল ফিতর মরক্কোর গুরুত্বপূর্ণ ঈদ ট্রাডিশন। এদেশে জাকাত আল ফিতার শোধ করার আগে পরিবারগুলো পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উদযাপন করতে পারেনা! জাকাত আল ফিতর পরিশোধের শেষ সময়সীমা ঈদের নামাজের আগ পর্যন্ত। তারপরে যদি কেউ দেয় তবে সেটা দান হিসেবে গণ্য হলেও জাকাত হিসেবে গণ্য হবে না। এটা অপশনাল না, প্রতিটি পরিবারকে যাকাত আল ফিতর আদায় করতেই হবে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে। দেশটির ইসলামিক আইন বাধ্যতামূলক করেছে জাকাত আল ফিতরকে। বেশিরভাগ পরিবারই ঈদের কদিন আগেই জাকাত আল ফিতর আদায় করে দেয়। পরিবারের প্রধানকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। সাধারণত যাকাত আল ফিতর হিসেবে প্রধান খাদ্য দ্রব্য গম ও ময়দা নেওয়া হয়, তাছাড়া টাকা, এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যও গ্রহণ করা হয়। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী এক ব্যাগ গমের সমান দান করতে হবে পরিবারের প্রতি সদস্যের পক্ষ থেকে। পুদিনার চা এবং প্যানকেক, পেস্ট্রি সহ নানা ধরনের খাবার মরোক্কানরা পরিবারের সঙ্গে উপভোগ করেন ঈদের দিনে।
মিশর ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে তিন দিনের সরকারি ছুটিতে পরিবারের সঙ্গে পার্ক, সিনেমা, থিয়েটার কিংবা সমুদ্রতটে ভ্রমণ করতে পছন্দ করে অধিকাংশ মিশরীয়। এছাড়া এ দিনটিতে মিশরের বিখ্যাত অবকাশযাপন কেন্দ্র ‘শারম আল শেখ’-এ উপচেপড়া ভীড় লক্ষ করা যায়। ঈদের দিনটিতে মিশরে বিশেষ খাবারের আইটেমে চিনি ও বাদামের ব্যবহার বেশি লক্ষ করা যায়। ঈদের বিশেষ খাবার হিসেবে মিশরে ‘কাহক’ নামের এক ধরনের বিশেষ কুকি বা পিঠা বেশ জনপ্রিয়। সেই দশম শতাব্দীতে মিশর রাজপ্রাসাদ থেকে আবির্ভাব হয়েছে এই বিশেষ পিঠার, যার ভেতর খেজুরভর্তা, বাদাম বা টার্কিশ ডিলাইটের পুর দেওয়া হয়। এমনই আরেকটি মিষ্টিজাতীয় পদের নাম ‘কাতায়েফ’, যা মিশরজুড়ে জনপ্রিয়।
মিশরে এ ঈদ-উল-ফিতর আনুষ্ঠানিকভাবে তিন দিনের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। বন্ধুবান্ধব, নিকটজন, পাড়া-প্রতিবেশী একে অপরকে ঈদ মোবারক বলে ঈদের শুভেচ্ছা জানায়। ঈদের প্রথম দিনটি সবাই কাটায় আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে, বাকি দিনগুলো তারা কাটায় সিনেমা হলে, পার্কে বা সমুদ্রসৈকতে। ‘হারম আল শেখ’ জায়গাটি ঈদের ছুটি কাটানোর জন্য অন্যতম জনপ্রিয় স্থান। শিশুরা বড়দের কাছ থেকে নতুন জামা এবং ঈদ সালামি পেয়ে থাকে।
বিভিন্ন রকম খাবার রান্না করা হয়, যার মধ্যে ‘ফাতা’ ঈদের বিশেষ একটি খাবার। এটি বাদাম এবং চিনি দিয়ে তৈরি। ‘কাহক’ নামক আরও একটি খাবার আছে যার কারণে মিশরের বেকারিগুলো ঈদের সময় কোলাহলপূর্ণ থাকে। টেলিভিশনেও বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্প্রচারের মাধ্যমে ঈদ উদযাপিত হয়। শিশুরা রাতে সবাই একসঙ্গে হয়ে গল্পগুজব করে অথবা বড়দের কাছ থেকে গল্প শোনে, গানের আসর বসে। শিশুদের জন্য মোটরসাইকেল ভাড়া করে শহর ঘুরে বেড়ানো অপরিহার্য বলা যায় মিসরে। মিশরের মানুষ সবাই মিলে একসঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করে বলে তাদের রাস্তাগুলো এ সময় অনেক বেশি কোলাহলপূর্ণ থাকে।
কেএসকে/এমএস