নদীর দুইপাড় খালি, মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি অর্ধনির্মিত সেতু। এপার থেকে ওপারে যেতে পারছেন না কেউ। আবার মাঠের ফসলও আনা নেওয়া করা যাচ্ছে না। ফলে বিপাকে পড়েছেন মেহেরপুর সদর উপজেলার উজলপুর গ্রামের ৫ হাজার মানুষ। বর্ষায় নৌকা দিয়ে পারাপার চলে। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে কাঠ ও বাঁশের পাটাতন রেখে মানুষ চলাচল করে। ফলে এই সময়ে ঝুঁকি নিয়ে মানুষদের পারাপার করতে হয়।
Advertisement
স্থানীয় লোকজন দীর্ঘদিন ধরে সেখানে একটি সেতু নির্মাণের দাবি করে আসছিলেন। তারই প্রেক্ষিতে ২০২১ সালে এলজিইডি কর্তৃপক্ষ সেখানে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সেতু নির্মাণ শুরু হলেও অর্ধেক কাজ করেই লাপাত্তা ঠিকাদার।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ৬ কোটি ৩৭ লাখ ৮৩ হাজার টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ওই সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২১ সালের জুন মাসে। সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ জুন মাসে। সেই মেয়াদ শেষ হয়েছে ৯ মাস হলো। এ সময়ে কেবল সেতুটির দুটি পিলার ও দুই পাশের সংযোগ সড়কের গাইড ওয়াল তৈরি হয়েছে। এরইমধ্যে ৫০ শতাংশ বিল তুলে নিয়ে লাপাত্তা হয়েছেন ঠিকাদার।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের মেহেরপুর সদর উপজেলার নির্বাহী প্রকৌশলী সাব্বির উল ইসলাম জানান, বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ৯৭৫ মিটার চেইনেজে ৯৬.১০ মিটার পিএসসি গার্ডার ও ৯৬ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতুটির নির্মাণকাজের দরপত্র পায় কুষ্টিয়ার কামারজানি (জেভি) নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এরপর প্রতিষ্ঠানটি কুষ্টিয়ার ঠিকাদার সুমন মিয়াকে সেতু নির্মাণের দায়িত্ব দেন। কিন্তু ঠিকাদার সুমন মিয়া সেতুর ৫০ শতাংশ কাজ করে রড সিমেন্ট ও অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ার অজুহাতে কাজ ছেড়ে চলে যান। সেতুটি এখনো সেভাবে পড়ে রয়েছে। তবে সম্প্রতি সেতুটির কাজে অগ্রগতি আনতে ঠিকাদার কামারজানিকে তলব করা হয়েছে। তিনি নিজেই সেতুর কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন।
Advertisement
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভৈরব নদের এপারে উজলপুর গ্রাম, ওপারে শোলমারি ও শোভরাজপুর গ্রাম। এই তিন গ্রামের মাঠে প্রচুর পরিমাণে সবজি, ধান, পাট ও গমের উৎপাদান হয়ে থাকে। একেবারে ভৈরব নদের কূলঘেঁষা গ্রামের মানুষের একমাত্র ভরসা শোয়ারী ঘাট। দুই পারের কয়েক হাজার মানুষ তাদের উৎপাদিত ফসল বাজারে তুলতে নিত্যদিন বেগ পাচ্ছেন এই সেতুর অভাবে।
এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরকে দিয়ে একটি সেতু নির্মাণের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু সেতু নির্মাণের মাঝপথে ঠিকাদার কাজ ফেলে পালিয়ে যান। দীর্ঘ ৯ মাস সেতুর কোনো কাজ হয়নি। সেতু নির্মাণের লোহার রডগুলো মরিচা পড়ে গেছে। অনেক যন্ত্রাংশ রাতের বেলায় চুরিও হয়েছে।
সেতুটি দেখভালের দায়িত্বে থাকা গরিবল্লাহ বলেন, মাসিক ১৫ হাজার টাকা বেতনে তিনি দেখভালের দায়িত্ব পালন করছেন। ছয় মাস কোনো বেতন পাননি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওই সময় থেকে কাজ বন্ধ রেখেছেন। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কেউ না থাকায় কাজও ছাড়তে পারছেন না।
কামারজানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, সেতু নির্মাণের কাজ চলছিল পুরোদমে। হঠাৎ করে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়ে যায়। এ কারণে ঠিকাদার সুমন মিয়া কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। সেই সময় থেকে সেতুর কাজ বন্ধ রয়েছে। দ্রুত কাজ শুরু করা না গেলে লোহার রডগুলো মরিচা পড়ে নষ্ট হয়ে যাবে। ওই রড দিয়ে সেতু নির্মাণ করা হলে সেতুর স্থায়ীত্ব অনেকাংশে কমে যাবে। উজলপুর গ্রামের বাসিন্দা মিলন হোসেন বলেন, সেতু নির্মাণ বন্ধ রেখে আরও বিপাকে ফেলা হয়েছে এলাকাবাসীকে। যেখানে আগে শোয়ারী ঘাটে আমরা নৌকায় করে সবজি আনা নেওয়া করতাম। সেখানে অর্ধেক সেতু তৈরি করে ফেলে রাখার কারণে মানুষ ছাড়া আর কিছু আশা যাওয়া করা সম্ভব না। স্থানীয়রা মিলে বাঁশ দিয়ে সরু সাঁকো তৈরি করেছে। তাতে মানুষ ছাড়া অন্যকিছু আনা নেওয়া করা যায় না।
Advertisement
কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম রেজা জানান, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সেতুটির নির্মাণ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু ২৩-২৪ অর্থবছরের শেষের দিকেও এর কাজ শেষ হয়নি। এই সেতুটি নিয়ে এ অঞ্চলের জনসাধারণ অনেক ভোগান্তির মধ্যে আছে। দ্রুত কাজ শেষ না হলে এলাকাবাসীকে নিয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে কর্মসূচি পালন করা হবে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী সাখাওয়াত হোসেন বলেন, উজলপুর সেতুর কাজ বন্ধ থাকায় সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। ঠিকাদার সুমন মিয়া নানান অজুহাত দিয়ে কাজ বন্ধ করে লাপাত্তা হয়েছেন। এসব বিষয় নিয়ে মূল ঠিকাদার কামারজানিকে দ্রুত কাজ শেষ করতে নির্দেশ দেওয় হয়েছে। অন্যাথায় নতুন করে ঠিকাদার নিয়োগ করে সেতুর কাজ শেষ করা হবে।
এফএ/এমএস