জাতীয়

পাহাড়ের চলমান অস্থিরতায় রোহিঙ্গা ইস্যু যুক্ত নয়

আলতাফ পারভেজ। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস গবেষক। লিখছেন রাজনীতি ও ইতিহাসের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। সম্প্রতি পার্বত্য জেলা বান্দরবানে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) যে সশস্ত্র তৎপরতা, তার সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুর কোনো সম্পৃক্ততা আছে কি না- এ নিয়েই এ গবেষক মুখোমুখি হয়েছেন জাগো নিউজের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।

Advertisement

আলতাফ পারভেজ বলছেন, পাহাড়ের চলমান অস্থিরতায় রোহিঙ্গা ইস্যু যুক্ত নয়। অন্তত আমার কাছে তা-ই মনে হয়েছে। কুকি-চিন এবং রোহিঙ্গা ইস্যু একেবারেই আলাদা।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীতে রোহিঙ্গারা যোগ দিচ্ছে বলে বিবিসি যে খবর প্রকাশ করেছে, সে প্রসঙ্গেও জাগো নিউজ এ গবেষকের মতামত নিয়েছে। পাহাড়ের চলমান অস্থিরতা নিয়েও আলোকপাত করেছেন তিনি।

সেনাবাহিনীতে রোহিঙ্গাদের নিয়োগ প্রসঙ্গে গবেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হয়ে কাজ করতে পারে, তবে এটি এখনো আমি নিশ্চিত না। এটি ঘটতে পারে। ঘটলেও বিচিত্র বলে মনে হবে না। আমিও বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি।

Advertisement

আরও পড়ুন

মিয়ানমার বিষয়ে বাংলাদেশের ব্যাপকভিত্তিক নীতি-কৌশল দরকার মিয়ানমারে অস্থিতিশীলতা বাড়লে বাংলাদেশের ঝামেলা আরও বাড়তে পারে

‘সেনা নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদেরই এখন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হয়ে লড়তে হচ্ছে’- এমন শিরোনামে গত ৮ এপ্রিল খবর প্রকাশ করে বিবিসি। প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী হাজার হাজার মুসলিম রোহিঙ্গাকে হত্যা করার প্রায় সাত বছর পর এখন তাদেরই সাহায্য চাইছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়নকে জাতিসংঘ আক্ষরিক অর্থেই ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ বলে অভিহিত করেছিল।

সেনা নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদেরই এখন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হয়ে লড়তে হচ্ছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী হাজার হাজার মুসলিম রোহিঙ্গাকে হত্যা করার প্রায় সাত বছর পর এখন তাদেরই সাহায্য চাইছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়নকে জাতিসংঘ আক্ষরিক অর্থেই ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ বলে অভিহিত করেছিল

২০১৭ সালে বাংলাদেশে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশ করে

Advertisement

সেখানে বলা হয়, রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে বিবিসি জানতে পেরেছে, তাদের মধ্যে অন্তত একশো জনকে সম্প্রতি যুদ্ধরত জান্তার পক্ষে লড়াই করার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

‘২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যের মিশ্র বসবাসের এলাকা থেকে কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। তাদের ক্যাম্পে বসবাস করতে বাধ্য করা হয়েছিল। এর পাঁচ বছর পর ২০১৭ সালের আগস্টে সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে নৃশংস জাতিগত নির্মূল অভিযান শুরু করে। এতে নতুন করে আরও সাত লাখ রোহিঙ্গা নিজ দেশ থেকে পালিয়ে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়’- বলছে বিবিসি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মিয়ানমারে সে সময় হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা ও ধর্ষণ করা হয়েছিল এবং তাদের গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা এখনো রাখাইন রাজ্যে রয়ে গিয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এমন আচরণের জন্য মিয়ানমার এখন দ্য হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার বিচারের মুখোমুখি হয়েছে।

কুচি-চিনের প্রধান সমন্বয়ক চেওসিম বমকে গ্রেফতার করে র্যাব

‘সম্প্রতি আরাকান আর্মি নামক একটি জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর কাছে রাখাইনের বিশাল এলাকা হারানোর পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী এখন সেই রোহিঙ্গাদেরই জোরপূর্বক বাহিনীতে নিয়োগ দিচ্ছে’- এমন তথ্যও উঠে আসে প্রতিবেদনে।

যুদ্ধরত একটি দেশে নানা ঘটনা ঘটতেই পারে, যা অবিশ্বাস্য নয়। রোহিঙ্গাদের মধ্যেও নানা গ্রুপ কাজ করে। কোন গ্রুপ কখন কার হয়ে কাজ করে তা বলা মুশকিল। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই ভাড়া খাটে। অনেকেই কৌশল পরিবর্তন করে। সময়ও অনেক কিছু বদলে দেয়। কে কার বিরুদ্ধে কাজ করবে অনুমান করে বলা যাবে না। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের সেনাদের হয়ে কাজ করতে পারে

গবেষক আলতাফ পারভেজের বিশ্লেষণ হচ্ছে, যুদ্ধরত একটি দেশে নানা ঘটনা ঘটতেই পারে, যা অবিশ্বাস্য নয়। রোহিঙ্গাদের মধ্যেও নানা গ্রুপ কাজ করে। কোন গ্রুপ কখন কার হয়ে কাজ করে তা বলা মুশকিল।

আরও পড়ুন

রোহিঙ্গা বিষয়ে বাংলাদেশের চীননির্ভরতার বদল দরকার গণতন্ত্রের সংগ্রামে মিয়ানমারের তারুণ্য জিততে চলেছে

‘এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই ভাড়া খাটে। অনেকেই কৌশল পরিবর্তন করে। সময়ও অনেক কিছু বদলে দেয়। কে কার বিরুদ্ধে কাজ করবে অনুমান করে বলা যাবে না’- বলছেন তিনি।

‘রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হয়ে কাজ করলে প্রভাব পড়বেই। কিন্তু আমূল পরিবর্তন ঘটবে না। কারণ, রোহিঙ্গরা তো আপাতত সে অবস্থানে নেই। তারা তো মুভমেন্ট করতে পারছে না। তবে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়ে রোহিঙ্গারা আরও দলে-উপদলে বিভক্ত হবে।’

পাহাড়ের চলমান অস্থিরতা এবং রোহিঙ্গা ইস্যু প্রসঙ্গে এ গবেষক আরও বলেন, পাহাড়ের চলমান অস্থিরতায় রোহিঙ্গা ইস্যু যুক্ত নয়। অন্তত আমার কাছে তা-ই মনে হয়েছে। কুকি-চিন এবং রোহিঙ্গা ইস্যু একেবারেই আলাদা। অনেকেই মিলিয়ে কথা বলতে চাইছেন। কিন্তু আমি এখনো মিলিয়ে আলোচনা করতে চাই না।

আরাকান বিদ্রোহীদের কাছে একের পর এক ঘাঁটি হারাচ্ছে জান্তা

‘রোহিঙ্গাদের মধ্যে মূলত এখন কোনো লিডারশিপ নেই। তাদের মধ্যে চোরাগুপ্তা সংঘাত আছে, অস্ত্র আছে। মারামারি আছে, মাদক আছে। খুন-খারাবিও হচ্ছে। তবে অনেকেই আরাকানের অস্থিরতার সঙ্গে কুকি-চিন ও রোহিঙ্গা ইস্যুটি মিলিয়ে ফেলছেন। কিন্তু না। কুকি-চিন এবং রোহিঙ্গা সংকট সম্পূর্ণ আলাদা। যদিও একই এলাকায় ঘটছে। রাজনৈতিক কোনো সম্পর্ক তাদের মধ্যে নেই। কোনো উপদল ভিন্ন কারণে যুক্ত হতে পারে। তবে সেটা মাদক বা অস্ত্রের ব্যবসাকেন্দ্রিক হতে পারে।’

রোহিঙ্গাদের মধ্যে মূলত এখন কোনো লিডারশিপ নেই। অনেকেই আরাকানের অস্থিরতার সঙ্গে কুকি-চিন ও রোহিঙ্গা ইস্যুটি মিলিয়ে ফেলছেন। কিন্তু না। কুকি-চিন এবং রোহিঙ্গা সংকট সম্পূর্ণ আলাদা। যদিও একই এলাকায় ঘটছে। রাজনৈতিক কোনো সম্পর্ক তাদের মধ্যে নেই। কোনো উপদল ভিন্ন কারণে যুক্ত হতে পারে। তবে সেটা মাদক বা অস্ত্রের ব্যবসাকেন্দ্রিক হতে পারে

‘পাহাড়ে অস্ত্রের ব্যবহার বহু আগে থেকেই হয়ে আসছে। মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ চলছে বহু আগে থেকে। সেখানে ব্যাপক অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। গত এক বছর ধরে উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি রাজ্য মণিপুরে সংঘাত চলছে। এটি নতুন সমস্যা নয়’- বলছিলেন আলতাফ পারভেজ।

আরও পড়ুন

চার হাজার সশস্ত্র সদস্য কেএনএফের, দাবি না মানলে আরও হামলার হুমকি ধর্মীয় ও জাতিগত হিংসার রাজনীতিতে পুরো দক্ষিণ এশিয়া হারছে

মিয়ানমারের এ যুদ্ধাবস্থা রোহিঙ্গাদের ভাগ্যে কী প্রভাব ফেলছে? এ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে রোহিঙ্গারা কোনো পলিটিক্যাল পজিশন নিতে পারেনি। রোহিঙ্গাদের স্ট্রং কোনো পলিটিক্যাল লিডারশিপ না থাকার কারণেই পজিশন নিতে পারেনি। যে কোনো সিচুয়েশন থেকে ফায়দা নিতে গেলে পলিটিক্যালি স্ট্রং হওয়া দরকার। তারা কমিউনিটি আকারে আছে। তবে রাজনৈতিক কমিউনিটি আকারে নেই।

‘ফায়দা নেওয়ার সুযোগ ছিলও বটে। ঘরে-বাইরে মিলিয়ে ২০ লাখের মতো রোহিঙ্গা সদস্য ছিল। আরাকান অঞ্চলে ২০ লাখ মানুষ (রোহিঙ্গা) কম নয়। সমান সংখ্যক লোক নিয়ে রাখাইনরা স্ট্রং লিডারশিপ দাঁড় করিয়েছে। যা রোহিঙ্গারা পারেনি’- বলেন গবেষক আলতাফ পারভেজ।

এসএস/এমকেআর/এমএস