পুরুষের পাশাপাশি নারীকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে সমাজের সর্বক্ষেত্রে কাজে লাগানোর পরিকল্পনায় বদ্ধ পরিকর বর্তমান সরকার। এই পরিকল্পনার প্রেক্ষাপটে নারীদের জন্য সরকারী চাকরির কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যান্য চাকরির পাশাপাশি সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, আনসার-ভিডিপিসহ ব্যতিক্রমধর্মী চাকরিতেও নারীদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। দক্ষতার সঙ্গে নারী সার্জেন্ট ও নারী পুলিশ রাস্তায় ট্রাফিক কন্ট্রোল করছেন। ফিল্ড লেবেলে প্রশাসনিক কাজে নারী কর্মকর্তা নিয়োগ চোখে পড়ার মতো। প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সচিব পদে এখন নারীরা দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।
Advertisement
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ২০১৫ সালের ২৫-২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদর দফতরে ৭০তম অধিবেশনে ১৯৩টি সদস্য দেশ পরবর্তী উন্নয়ন এজেন্ডা হিসেবে এসডিজি অনুমোদন করেছেন। সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীসহ বিশ্বের অনেক দেশের সরকার প্রধান উপস্থিত ছিলেন। জাতিসংঘ বিশ্বের উন্নয়ন টেকসই বাস্তবায়নে ১৭টি লক্ষ্য এবং ১৬৯টি টার্গেট রয়েছে। এর মধ্যে অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষগুলো হল, দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনা। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করা। আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
জাতিসংঘ এসডিজি’র ভিত্তিতে বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে পঞ্চম স্থানে রয়েছে লিঙ্গ সমতা ও নারী ক্ষমতায়ন। যার মূল লক্ষ্য, নারীর সামাজিক অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত স্থায়িত্বের ভারসাম্য নির্ধারণ করা। এই লক্ষ্যমাত্রার ৯টি লক্ষ্য এবং ১৪টি সূচক রয়েছে। লক্ষ্যগুলির মধ্যে ৬টি ‘ফলাফল ভিত্তিক’। অর্থাৎ সর্বত্র সকল নারী বা মেয়েদের প্রতি সকল প্রকার বৈষম্যের অবসান। অর্থাৎ সহিংসতা ও শোষণের অবসান ঘটানো। শিশু, বাল্য ও জোরপূর্বক বিবাহ এবং মহিলাদের যৌনাঙ্গ বিকৃতকরণের মতো ক্ষতিকারক অভ্যাসগুলো দূর করা।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আলোকে ধারণা দেয় হয় আগামী ১৫ বছর পর বাংলাদেশে নারীদের অবস্থা কেমন হবে। ২০৩০ সালে এসডিজি সফল বলে গণ্য হবে, যদি ২৫ বছর বয়সী কোনো বাংলাদেশী নারী সহিংসতা ও নিপীড়নমুক্ত জীবন কাটাতে পারেন। যদি তাঁকে ১৮ বছর বয়সের আগেই বিয়ে দেয়া না হয়। যদি তিনি যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা পর্যাপ্তভাবে পান।
Advertisement
অবৈতনিক যত্নের মূল্য বৃদ্ধি এবং ভাগ করে ঘরোয়া দায়িত্বের প্রচার। নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীদের পূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। সর্বজনীন প্রজনন অধিকার এবং স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ৩টি উপায় হল অর্থনৈতিক সম্পদ, সম্পত্তির মালিকানা এবং মহিলাদের জন্য আর্থিক পরিষেবাগুলির সমান অধিকার বৃদ্ধি করা। প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের প্রচার এবং লিঙ্গ সমতার জন্য নীতি গ্রহণ, শক্তিশালীকরণ এবং আইন প্রয়োগ করা।
এমডিজিতে ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ক্ষুধা-দারিদ্র্য অর্ধেক দূর করার প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু এসডিজির লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসইভাবে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা-দারিদ্র্যের অবসান ঘটানো। এসডিজির উদ্দেশ্য সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের অগ্রাধিকার দেয়া। এসডিজিতে প্রথমবারের মতো শিক্ষার মান, তথা জ্ঞানার্জন ও শিক্ষার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ ও মানবিক বিশ্ব তৈরির কথা বলা হয়েছে। জেন্ডার সমতার লক্ষ্য ভিত্তিক অর্জনের জন্য লক্ষ্যভিত্তিক আর্থিক সাক্ষরতা এবং সচেতনতা তৈরির ওপর জোর দিতে হবে।
লিঙ্গ সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়নে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। এক জরিপে দেখা গিয়েছে, নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধির সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা বেড়েছে। কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অনুপাতের ব্যবধান আগের তুলনায় অনেক কমেছে। পড়ালেখার সুযোগ-সুবিধা বাড়ার সঙ্গে স্কুল-কলেজে মেয়েদের অংশগ্রহণ এবং ফলাফলে দৃষ্টান্তমূলক সাফল্য রয়েছে।
দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে পিছনে রেখে কখনোই এসডিজি অর্জন সম্ভব নয়। নারীদের উন্নয়ন কাজে লাগানোর জন্য তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা জরুরি। একজন নারী সক্ষম না হলে কোনো অবস্থাতেই তার কাছ থেকে ভাল কিছু আশা করা যায় না। এসডিজি অর্জনের জন্য নারীর ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছেন সরকার।
Advertisement
জাতিসংঘ নির্ধারিত সহস্রাব্ধ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে রোল মডেল। ২০০০ সালে প্রণীত এমডিজির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর। এমডিজিতে মূল লক্ষ্য অর্জনের জন্য ২১টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে এমডিজির ৮টি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যমাত্র হলো-ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণ, সর্বজনীন শিক্ষার প্রসার, জেন্ডার সমতা অর্জন, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাস, এইচআইভি, ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য রোগ প্রশমন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও আর্ন্তজাতিক সহযোগিতা প্রদান। সম্পদশালী দেশগুলোর এসব বিষয়ে পর্যাপ্ত সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি থাকলেও বাস্তবে তা তেমন দেখা যায়নি।
ভারতের অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বকে চমকে দেয়ার মতো সাফল্য আছে বাংলাদেশে। বিশেষ করে নারীশিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, গরিব মানুষের জন্য শৌচাগার ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান এবং শিশুদের টিকাদান কর্মসূচি সফল করার মতো কাজগুলো বাংলাদেশ দক্ষতার সঙ্গে করেছেন।
এসডিজির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশেষত্ব হলো অর্ন্তভুক্তিমূলক সমাজ গড়া। যেখানে মানুষের ন্যায় বিচার পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মানবাধিকার সংরক্ষণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার কথা বলা হয়েছে। কার্যকর আইনের শাসন ও সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং স্বচ্ছ, কার্যকর ও দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠান গড়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নকে এমডিজিতে প্রধান প্রতিপাদ্য হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমাতায়ন দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তারই ধারবাহিকতায়, বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে জেন্ডার বৈষম্য দূর করতে এবং উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশ যতটা এগিয়েছে, সামাজিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ততটা অগ্রসর হতে পারেনি। পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এবং সামাজিক সচেতনতার অভাবে নারীরা নানাভাবে বঞ্চনা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের সাম্প্রতিক জনসংখ্যাতাত্ত্বিক প্রভাব গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ২০৩১ সাল নাগাদ ১৯ কোটিতে পৌঁছাবে। ২০৪০ সালের আগেই এ সংখ্যা ২০ কোটি হবে। তাহলে ধরে নেওয়া যায় নারী সংখ্যা হবে ১০ কোটি। এবং তারা দেশের মানব মূলধন ভিত্তিক অর্ধেকের প্রতিনিধিত্ব করে এবং প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করে। কোন দেশের নারী ও মেয়েরা যখন বৈষম্যের বা অন্যায়ের শিকার হয়, তখন দেশের অর্থনৈকিত প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক উন্নয়নের গতিও কমে যায়।
অন্যদিকে নারীদের যখন সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হয় তখন পুরুষ বা ছেলেসহ সব নাগরিকই সুবিধাপ্রাপ্ত হয়। প্রত্যেকটি দেশে নারীরা একটি শক্তিশালী দেশ, স্থিতিশীল সমাজ ও পরিবারের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। তবুও বাংলাদেশে নারীরা বিভিন্ন বাধা ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে। এসব কারণে তাদের সম্ভাবনাগুলো অপূর্ণ রয়ে যাচ্ছে। এবং মানবাধিকার ও স্বাধীনতা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। যেমন ২০১১ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর নারীর প্রতি সহিংসতা শীর্ষক এক জরিপে দেখা যায়, ৮৭ শতাংশ বিবাহিত নারী কোনো না কোনো সময় স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ নারী শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের ব্যাপকতা বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১২-১৩ সালে এক জরিপ চালায়। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৬২ দশমিক ৮ শতাংশ নারী ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন।
এছাড়া সামাজিক ও রাজনৈকিত ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ এখনো খুবই কম। শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার ৬০ শতাংশ। এটি পুরুষের তুলানায় প্রায় ৩০ শতাংশ কম। আর একই কাজের জন্য নারীদের তুলনামূলক কম নিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ দেওয়া হয়। অনেক সময় তাঁরা এমনসব শ্রমে নিয়োজিত থাকেন যেখানে সামাজিক নিরাপত্তা বা শ্রমিক অধিকার সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকে না। আবার সংসদেও নারীর প্রতিনিধিত্ব তুলনামূলক কম। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের উচ্চপদে এবং বেসরকারি খাতের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপনা পদগুলোতেও নারীর উপস্থিতি পুরুষের চেয়ে কম।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আলোকে ধারণা দেয় হয় আগামী ১৫ বছর পর বাংলাদেশে নারীদের অবস্থা কেমন হবে। ২০৩০ সালে এসডিজি সফল বলে গণ্য হবে, যদি ২৫ বছর বয়সী কোনো বাংলাদেশী নারী সহিংসতা ও নিপীড়নমুক্ত জীবন কাটাতে পারেন। যদি তাঁকে ১৮ বছর বয়সের আগেই বিয়ে দেয়া না হয়। যদি তিনি যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা পর্যাপ্তভাবে পান।
সুতরাং এসডিজি লক্ষ্যমাত্র বাস্তবায়ন করতে বর্তমানে ১০ বছর বয়সী যে সব মেয়েরা রয়েছে, অর্থাৎ যারা ২০৩০ সালে ২৫ বছর বয়সী নারীতে পরিণত হবেন, তাদের জন্য এই পৃথিবী ও সমাজকে বসবাসযোগ্য করে তোলার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও নাট্যপরিচালক।
এইচআর/এএসএম