দেশজুড়ে

জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ‘গোশত সমিতি’

দাম নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় বাজার থেকে মাংস কিনতে পারেন না স্বল্প আয়ের মানুষ। ৫-৭ বছর ধরে এ অবস্থা চলছে। মাংস কেনার টার্গেট নিয়ে গ্রামীণ মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ ‘গোশত সমিতি’ করে বছরজুড়ে টাকা জমানো শুরু করেছেন। বছর শেষে তারা নিজেদের জমানো টাকা দিয়ে গরু বা মহিষ কিনে মাংস ভাগ করে নিচ্ছেন। এতে বাজারে কসাইদের হাঁকানো দরের চেয়ে কেজিতে অন্তত একশ-দেড়শ টাকা কম দামে তারা মাংস পাচ্ছেন। পাবনা জেলাজুড়ে প্রায় গ্রামেই এমন একাধিক গোশত সমিতি গড়ে উঠেছে।

Advertisement

রমজানের ঈদের সময় গ্রামের বাড়ি বাড়ি গরু-মহিষের মাংস আসায় ঈদ আনন্দও বাড়তি মাত্রা পেয়েছে। তবে এতে বিপাকে পড়েছেন পেশাদার মাংস বিক্রেতারা। তারা জানিয়েছেন, ঈদের মৌসুমে তাদের ব্যবসা আগের চেয়ে অর্ধেকেরও নিচে নেমে গেছে।

‘গোশত সমিতি’র সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাবনার বিভিন্ন গ্রাম বা মহল্লায় ঈদুল ফিতর সামনে রেখে এ ধরনের গোশত সমিতি গঠন করা হয়। সমিতির মেয়াদ এক বছর। সমিতির অন্তর্ভুক্ত প্রতিজন সদস্য মাসে মাসে সমিতিতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা রাখেন। বছর শেষে ঈদের আগে জমাকৃত অর্থ একত্র করে পশু কেনা হয়। ঈদের দিন বা তার দু-একদিন আগে এই পশু জবাই করে গোশত সমিতির প্রত্যেক সদস্যকে ভাগ করে দেওয়া হয়। এতে ঈদ উদযাপনের ক্ষেত্রে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের ওপর আর্থিক চাপ যেমন কমে, তেমনি ঈদের আগে সবাই বাড়তি আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পারেন।

জেলার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে এমন সমিতি গড়ে উঠছে। প্রতিটি গোশত সমিতির সদস্য সংখ্যা ৩০ থেকে ১০০ জন পর্যন্ত হয়ে থাকে। স্থানীয়দের ভাষায় এই সমিতির নাম ‘গোশত বা মাংস সমিতি’। অনেকের কাছে ‘গরু সমিতি’ নামেও পরিচিত।

Advertisement

গোশত সমিতির সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন গ্রামের লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, প্রতিবছর বাড়ছে গোশত সমিতির সংখ্যা। গোশত সমিতির প্রত্যেক সদস্য সপ্তাহে ১০০ টাকা চাঁদা জমা দেন। জমা করা টাকায় গরু কিনে এনে শবে কদরের দিন থেকে শুরু হয় পশু জবাইয়ের কাজ। চলে ঈদের দিন পর্যন্ত। ঈদুল ফিতরের দুই বা এক দিন আগে জবাই করে সদস্যরা গোশত ভাগ করে নেন। এরপর পরের বছরের জন্য তহবিল গঠন করে সমিতির কার্যক্রম চলে।

সাঁথিয়া উপজেলার কুমিরগাড়ী গোশত সমিতির মূল উদ্যোক্তা রতন আলী জানান, সমিতিতে এবার ৮০ জন সদস্য। প্রতি সপ্তাহে সদস্য প্রতি ১০০ টাকা করে অর্থ জমা রাখেন। বছর শেষে রোজার ঈদের আগে জমানো টাকা দিয়ে গরু কিনে জবাই করে সমিতির সদস্যদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। তুলনামূলক বাজার দরের চেয়ে কম দামে এবং একসঙ্গে বেশি পরিমাণ গোশত পেয়ে প্রত্যেকেই খুব খুশি হয়।

তিনি জানান, তিন বছর আগে তিনি গ্রামের কয়েক বন্ধুর সঙ্গে উদ্যোগ নিয়ে এ গোশত সমিতি গঠন করেন। সমিতির মাধ্যমে গরু কিনে মাংস ভাগ করায় কম দামে ফ্রেশ মাংস পাওয়ায় গ্রামের লোকজন ব্যাপক উৎসাহিত হয়। এতে পরের বছর সদস্য সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। এ বছর তাদের সমিতিতে ৮০ জন সদস্য হওয়ার পর আরও অনেকের আসার ইচ্ছা থাকলেও নেওয়া সম্ভব হয়নি।

তিনি জানান, তাদের সমিতিতে সেক্রেটারি ও ক্যাশিয়ার রয়েছেন। ক্যাশিয়ার বানানো হয়েছে গ্রামের মসজিদের ঈমামকে। প্রত্যেক সদস্যকে পাশবই দেওয়া হয়েছে, তার জমা টাকার হিসাব মিলিয়ে নেওয়ার জন্য।

Advertisement

রতন আলী জানান, এ বছর সদস্য সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ২টি গরু এবং একটি মহিষ কেনা হয়েছিল। তারা সোমবার (৮ এপ্রিল) গরু-মহিষ জবাই করেছেন। তারা ৬৪০ টাকা দরে মহিষের মাংস পেয়েছেন। গরুর মাংসের দাম পড়েছে ৬৫০ টাকা।

সমিতির এক সদস্য আবুল কালাম বাবু জানান, তারা সারা বছর ধরে সপ্তাহে সপ্তাহে টাকা জমা দিয়েছেন। এতে বছর শেষে ৬ হাজার টাকা জমা হয়েছিল, তিনি টেরই পাননি। কিন্তু এখন একবারে ৬ হাজার দিয়ে তিনি মাংস কিনতে পারতেন না। এছাড়া এখানে যে দাম পড়ছে সে দামে কসাইরা মাংস বেচে না। তাতে ওজনে কম, পানি দেওয়া ও তেল-চর্বি, হাড় দিয়ে ভরা থাকে। বনগ্রাম এলাকার একটি সমিতির সদস্য ভ্যানচালক বাবু আলী বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। ঈদে ছেলেপেলের কাপড়চোপড় কিনে টাকা শ্যাষ অয়া যায়। কোনোমতে তেল-সেমাই কিনি। আবার মাংস কেনব কীভাবে? যহন জানছি সমিতি অইছে, তহন থেন সমিতিতে নাম লেহাই। ঈদের আগে ৮ কেজি মাংস পাইছি।’

কুমিরগাড়ী গ্রামের বাসিন্দা প্রভাষক মকবুল হোসেন জানান, গ্রামের মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তসহ সব শ্রেণির মানুষ এ সমিতিতে সদস্য হয়েছেন। সদস্যরা বছরে অল্প অল্প করে টাকা জমা রাখেন বলে বছর শেষে তারা টেরই পান না যে এত টাকা হয়েছে। এ পদ্ধতি না থাকলে দরিদ্র মানুষের পক্ষে ১০ কেজি মাংস কেনার সাধ্য হত না।

এদিকে প্রবীণ মাংস বিক্রেতা মাবুদ আলী জানান, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে তারা আগে যে মাংস বিক্রি করতেন তা এখন অর্ধেকও হচ্ছে না। কারণ গ্রামে গ্রামে একাধিক গোশত সমিতি হয়েছে। সমিতির লোকজন নিজেরাই গরু-মহিষ কিনে জবাই করে মাংস ভাগ করেন।

তবে কসাইয়ের কাজ করা কিছু ব্যক্তি জানান, গ্রামে গ্রামে সমিতি বেড়ে যাওয়ায় তাদের কাজের চাহিদা বেড়ে গেছে।

বেলাল হোসেন নামে একজন জানান, তারা গ্রুপে ৪ জন কাজ করেন।

তিনি তার ১০ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে জানান, এখন গ্রামে গ্রামে অনেক সমিতি গড়ে উঠছে। ফলে এত বেশি সংখ্যক পশু জবাই হচ্ছে যা ঈদুল আজহার চেয়ে কম নয়। একটি গরু প্রসেস করতে তাদের দুই আড়াই ঘণ্টা লাগে। তারা গরু প্রসেস করতে ৩-৪ হাজার টাকা মজুরি নেন আর মহিষ ৪-৫ হাজার টাকা নেন। ফলে ঈদ মৌসুমে তাদের জনপ্রতি প্রতিদিন ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় থাকছে।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন পাবনার সাধারণ সম্পাদক এসএম মাহবুব আলম জানান, জনসাধারণের এমন সমিতি গঠনের ফলে মাংস ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব হচ্ছে। মানুষ ভালো মানের মাংস কম দামে পাচ্ছেন। বাজার নিয়ন্ত্রণেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে গোশত সমিতি।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. গৌরাঙ্গ কুমার তালুকদার জানান, সুস্থ সবল গরু জবাই করে জনসাধারণ আমিষের চাহিদা মেটাচ্ছেন। ভোক্তারা যেমন উপকৃত হচ্ছেন তেমনি গো খামারিরা ঈদুল ফিতরেও একটি বাজার ধরতে পারছেন। এতে খামারি ও ভোক্তা উভয়েই উপকৃত হচ্ছেন। সমিতিগুলোর পরিচালকরা যদি সরাসরি খামার থেকে পশু সংগ্রহ করতে আগ্রহী হন তাহলে তারা অফিস থেকে তাদের সহযোগিতা করবেন।

এফএ/এমএস