মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার
Advertisement
ঐতিহ্যে ভরা শ্যামল বাংলার অকৃত্রিম সৌন্দর্য্য ও কালের আবর্তনে আঁচড়ে পড়া চির সজীব ঐতিহ্যকে কাল্পনিক মনন থেকে রংতুলির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার এক অনন্য শিল্পী মাহফুজা বিউটি। প্রথমে বাস্তবধর্মী বিভিন্ন চিত্র অঙ্কণ করলেও বর্তমানে তিনি জোড় দিয়েছেন কাল্পনিক চিত্রকর্ম নির্মাণে।
চিত্রকর্মের মাধম্যে বাংলার ঐতিহ্যকে বিশ্বব্যাপী প্রসারে ভূমিকা রেখে চলেছেন তিনি। জীবনের নানা বোঝাপড়ার মধ্যে নানা বাধা বিপত্তি প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও যিনি ছবি আঁকা কখনো ছাড়েননি এবং রংতুলি ক্যানভাসের হাত ধরেই পৌঁছে গেছেন বিশ্বের দরবারে সেই মাহফুজা বেগম বিউটি একাধারে চিত্রশিল্পী ,কবি , শিক্ষক এবং বাংলাদেশ চিরন্তন আর্ট গ্রুপের কিউরেটর। যিনি নিজগুণে জয় করে নিয়েছেন আপন দক্ষতায় শৈল্পিক কর্ম প্রকাশের অধিকার।
সম্প্রতি দুবাইয়ে একশ আটটি দেশের নারী শিল্পীদের নিয়ে চিত্র প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে এসেছেন। মাহফুজা তার কর্ম দিয়ে জয় করে নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা , মধ্যপ্রাচ্য , দক্ষিণ এশিয়ার ভারতসহ বিভিন্ন দেশের শিল্পপ্রেমীদের হৃদয়। তার শিল্পকর্ম চড়া মূল্যে বিক্রি হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চিত্র প্রদর্শনীতে। যার কথায় ছবিতে কবিতায় বারবার উঠে আসে নারী। মাহফুজা বিউটির কাছে ছবি আঁকা হলো নিজেকে ভালো রাখার সাধনা। যিনি রং ও রেখায় খুঁজে পান আত্মার শান্তি।
Advertisement
পড়াশোনা নিয়ে বাবার সঙ্গে দ্বন্দ্বের মাঝেই বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিত্রকলা বিভাগে স্নাতকোত্তর পাস করেন মাহফুজা। আসলে তার বাবা কখনোই চাননি ছবি আঁকার মতো অনিশ্চিত ভবিষ্যত পেশার পথে পা বাড়াক মেয়ে। সেই ছোটবেলা থেকে যে ছবি আঁকা শুরু, একজন নারী শিল্পী হিসেবে জীবনের পথচলায় বহু বাধা বিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে অব্যাহত রয়েছে মাহফুজা বিউটির সৃজনশীল কর্মযজ্ঞ। জীবনের প্রায় সতের বছর ছবি আঁকতে পারেননি কিন্ত তার ছবি দেখে বোঝার উপায় নেই যে মাত্র ছয় বছর ধরে ছবি আঁকছেন। মাহফুজা বিউটি হৃদয়ের সব অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে স্থির করেছেন ছবি আঁকাকে। নারী হিসেবে সামাজিক বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে মুক্তির স্বাদ পেয়েছেন, হয়েছেন অপরাজিতা।
মাহফুজা বিউটি জানান, জীবনের সব প্রতিকূল পরিস্থিতিকে স্বীকার করে নেওয়ার সাহস ও শক্তি তাকে দিয়েছে এই শিল্প সাধনা। ছবির বিষয় ভাবনা নিয়ে জানতে চাইলে উত্তরে তিনি জানান, ‘আমার ছবিতে আমি বাংলাদেশের প্রতিটি মেয়ের কথা বলতে চাই। তাদের সুখ, দুঃখ, ক্ষোভ, হতাশা ও অবসাদকে ছবিতে ফুটিয়ে তুলতে চাই বিভিন্ন মোটিভের মাধ্যমে। ফুটিয়ে তুলতে চাই বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত নারী মনের নানা না বলা কথা।’
তিনি ছবির মাধ্যমে মেয়েদের দেখাতে চান সফলতার নতুন দিশা, মুক্ত আকাশে পাখা মেলে সামাজিক সংকট থেকে উত্তরণের নতুন পথ। দুর্গমের দুর্গ হতে সাধনার ধন আহরণ করে আনতে তিনি নিজেকে করে নেন বদ্ধপরিকর । তিনি চান অন্য মেয়েদেরও চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে যাওয়া শেখাতে।
মাহফুজার বিভিন্ন ছবিতে মূল বিষয় হিসেবে দেখা যায় নারীর অবয়ব ,ফুল ,পাখি ও রোদ-বৃষ্টির পালাবদলের খেলা। ফুলের মধ্য দিয়ে ছবিতে তিনি নিজেকেই তুলে ধরেন এবং বাংলাদেশের প্রতিটি মেয়ের স্বত্ত্বা ফুলের মতোই বিকশিত হোক এই বার্তা পৌঁছে দিতে চান সমাজের কাছে। প্রতিটি মেয়ের মধ্যে তিনি খুঁজে পেতে চান নিজেকে। তিনি স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশের প্রতিটি নারীর প্রতিভা একদিন মুক্ত আকাশে পাখির মতো ডানা মেলবে। বর্তমানে তিনি কানাডায় বসবাস করলেও শিকড়কে আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন অন্তরে ও চিত্রকলায়। নিজের মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং নাড়ির টানকে সজীব রাখতে বার বার ফিরে আসেন মাতৃভূমি বাংলাদেশে।
Advertisement
যেসব মেয়েরা বাংলাদেশের বিখ্যাত নকসী কাঁথার কারুকার্য ও আলপনা করেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাতে মাহফুজা তার ছবিতে এই কাঁথার ডিজাইন ও আলপনার সংমিশ্রণ করেন খুব নিবিড়ভাবে। একজন সফল নারী হিসেবে দেশে-বিদেশে আয়োজন করেছেন বহু চিত্র প্রদর্শনীর। তার অর্জনের ঝুলিতে জমা হয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহু পুরস্কার। জীবনের সব বাধা বিপত্তি দুঃখ-কষ্টই তাকে অনুপ্রেরণা দিয়ে সফলতার সঙ্গে শিল্পের পথে চলতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে বলে মনে করেন মাহফুজা ।
চিত্র শিল্পের রাজ্যে, যেখানে সৃজনশীলতা গভীর অভিব্যক্তি পূরণ করে সেখানে একজন আত্মপ্রত্যয়ী শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মাহফুজা। একজন অবিশ্বাস্য শিল্পী যার যাত্রা বাংলাদেশের সমৃদ্ধ শৈল্পিক ঐতিহ্যের একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে।
মাহফুজা এমন এক ব্যতিক্রমী শিল্পী এবং বাংলাদেশের শিল্পী সমাজের অন্যতম জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, শিল্পসম্মত অভিব্যক্তি এবং সমাজের ওপর চিত্র শিল্পের এক গভীর প্রভাবের দৃষ্টান্ত। তার যাত্রা শিক্ষাঙ্গনের সরব ক্যাম্পাস থেকে সৃজনশীল চিত্রশালার গভীর নীরবতায়। তার ছবির বর্ণনা সমাজ, সময় ও বাংলার ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করে।
কেএসকে/জেআইএম