মতামত

ভারত বয়কটের শোরগোলে আমদানি প্রতিস্থাপন ও গরুর মাংসের দাম

বেশ কিছুদিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভারতের পণ্য বর্জনের একটা শোরগোল ওঠার পর বহু লোক এই আওয়াজের সাথে গলাও মেলাচ্ছেন। ভার্চুয়াল মাধ্যমে তুমুল বাকবিতণ্ডার মধ্যে বাস্তবেই নিজের গায়ে ভারতীয় চাদর খুলে ফেলে দিয়ে এতে রাজনৈতিক রং মিশিয়েছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। ভারতের পণ্য ছাড়াই বাংলাদেশের চলবে এমন যুক্তিও খারা করছেন অনেকে। কিন্তু কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই হঠাৎ সবচেয়ে নিকটের এই প্রতিবেশীর কাছ থেকে আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশের কতটুকু লাভ হবে অথবা পণ্যের দামে এর প্রভাব পড়বে কতটুকু সেই বিবেচনা ভুলে গেলে কী করে চলে।

Advertisement

পণ্য আমদানি করতে গেলে বৈদেশি মুদ্রা খরচ হয়, দেশেই শিল্পায়নের মাধ্যমে তা বাঁচানো যায়। চলতি ডলার সংকটের দুর্দিনে এ কথা আরও বেশি সত্য। আর দুই বছর পরই বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাব উন্নয়শীল দেশের ক্লাবে যোগ দেবে, তখন মুক্তবাজার অর্থনীতির নিয়ম মানতে হবে; রপ্তানিতে শুল্ক সুবিধা হারানোর ঝুঁকির মধ্যে আমদানি বাণিজ্যেও শুল্ক বাধা দিয়ে অন্য দেশের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। অবাধে প্রবেশ করতে দিতে হবে বিদেশি পণ্য। এমন পরিস্থিতিতে কিছু পণ্যের বেলায় আমদানি প্রতিস্থাপন শিল্প করতে গেলে জাতীয় পর্যায়ে কৌশলগত যে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন সক্ষমতা থাকা দরকার, সেই পথে আমাদের অবস্থান কোন পর্যায়ে তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের সুযোগ আছে।

উৎপাদন প্রতিস্থাপন কী; কবে শুরু হয়েছিলবিদেশে উৎপাদিত পণ্য আমদানি কমিয়ে দেশেই ওইসব পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের সিদ্ধান্তকে উৎপাদন প্রতিস্থাপন শিল্প নীতি বলা হয়। এই প্রক্রিয়ায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিল্পায়ন গতি পায়। রপ্তানিতেও এগিয়ে যায় দেশ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ডলার সংকট চরমে পৌঁছলে কিছু দেশ তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য নিজেরাই উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৫০ পরবর্তী দুই দশকজুড়ে এ চিন্তায় নেতৃত্ব দেন অর্থনীতিবিদ রাউল প্রেবিশ, মায়ার্ডাল, ডব্লিউ আর্থর লুইস, অ্যালবার্ট হির্সম্যানসহ অনেকে। কিন্তু আশির দশকের পর থেকেই মুক্তবাজার অর্থনীতি চর্চার কাছে উৎপাদন প্রতিস্থাপনের এ উদ্যোগ ভেস্তে যেতে থাকে। অভ্যন্তরীণ শিল্প সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এই প্রক্রিয়ায় দরকার পড়ে শুল্ক সুবিধা দেওয়া। এতে আমদানি নিরুৎসাহিত হয় বটে, বিকল্প না থাকায় দেশি পণ্যের চাহিদাও বাড়ে। কিন্তু কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ এবং দক্ষতার ঘাটতি হলে আমদানি প্রতিস্থাপন শিল্পের টিকে থাকাও কঠিন হয়ে পড়ে।

Advertisement

লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো এই উদ্যোগে সফল হলেও প্রত্যাশা মতো এগোয়নি পেরু, ইকুয়েডোর এবং বলিভিয়ায়। এই দেশগুলোর ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, আমদানি প্রতিস্থাপন শিল্পের শুরুতে কর্মসংস্থান বাড়লেও চূড়ান্ত পণ্যের চড়া দামের কারণে সাধারণ ক্রেতাদের আগ্রহ কমতে থাকে। এতে রুগণ শিল্পের ঝুঁকি তৈরি হয়, অনেকটা যে পরিস্থিতিতে এখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকল কোম্পানিগুলো ধুঁকে ধুঁকে চলছে। অবশ্য, পর্যাপ্ত শুল্ক সহযোগিতা এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনা যুক্ত হলে আমদানি প্রতিস্থাপনে সফল হওয়ার উদাহরণ বাংলাদেশেই আছে। এখানে আমদানি করা ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যে নির্ভরতা অনেকটাই কমে এসেছে; কম দামের মোবাইল ফোন, মোটরসাইকেলের মতো পণ্যের আরও অনেক পণ্য এর উদাহরণ। এছাড়া ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য রপ্তানিতেও বেশ এগিয়েছে কয়েকটি দেশি প্রতিষ্ঠান।

এছাড়া, বাংলাদেশের আগেই দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া এবং ভারতও আমদানি প্রতিস্থাপন শিল্প স্থাপনে সফলতা পায়।

ভারত থেকে কী আমদানি হয়, প্রতিস্থাপনের সম্ভাবনা কতটুকুআমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের সাথে যুক্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত থেকে সিংহভাগই শিল্পের কাঁচামাল আমদানি হয়। এরমধ্যে তুলা, কাপড়, তৈরি পোশাক, শাড়ি, গাড়িসহ চূড়ান্ত ও বিভিন্ন মধ্যবর্তী পণ্য অন্যতম। এলসি খোলার পর পণ্যের চালান দেশে আসতে সময় ও খরচ কম লাগে বলেই ব্যবসায়ীদের প্রথম পছন্দ ভারত। এসবের বাইরেও বিশেষ করে খাদ্যপণ্য বিশেষ করে চাল, পেঁয়াজ ও বিভিন্ন ধরনের ফল আমদানির অন্যতম উৎস ভারত।

বাংলাদেশে চালের সংকটে ভারতই সবচেয়ে কাছের উৎস। দেশটি থেকে সর্বশেষ আমদানির তালিকায় যুক্ত হয়েছে আলু। উৎপাদন ঘাটতির কারণে আলু রপ্তানিকারক বাংলাদেশ আমদানিতে নাম লিখিয়েছে। বলা বাহুল্য, এবারে আলুর সরবরাহ ঘাটতিতে ভারতের আলু আমদানি না হলে দাম আরও বেশি হতে পারতো, যদিও বাংলাদেশ আলু উৎপাদনে পৃথিবীতে অন্যতম।

Advertisement

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক বিশ্লেষণ থেকে দেখে গেছে, বাংলাদেশের মোট আমদানির ১৮ শতাংশই ভারত থেকে আসে। এরপরই চীনের অবস্থান। বাংলাদেশ ভারত চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাতলুব আহমাদ সাম্প্রতিক ‘বয়কট‘ বিতর্কে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ভারত থেকে বছরে ১৪ বিলিয়ন ডলারের কাঁচামাল আমদানি হয়। অন্য দেশ থেকে সমপরিমাণ আমদানি করতে গেলে খরচ পড়বে ২০ বিলিয়ন ডলারের মতো।

তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষ দেশে আমদানির বাস্তবতামেড ইন বাংলাদেশ ব্র্যান্ডিংয়ে বাংলাদেশের পোশাক সারা বিশ্বে সুপরিচিতি। একক দেশ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পোশাক রপ্তানি করে এবং বাণিজ্য ভারসাম্যের হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। বাংলাদেশের পোশাকের পরই অন্যতম গন্তব্য ইউরোপের দেশগুলো। কিন্তু এই অর্জনের পরও দেশের পোশাকের মার্কেটগুলোতে ভারতের কাপড়ে ছয়লাব বলা যায়।

বিদেশি ব্র্যান্ডের পোশাক পরার আগ্রহ এর একমাত্র কারণ নয় বরং দেশি ব্র্যান্ডের উচ্চ দরের পোশাক কেনার সামর্থ্য অনেক ক্রেতারই নেই। শুধু তাই নয়, ব্র্যান্ডগুলোর পোশাক তৈরির বহু কারিগর আছেন যারা নিজেদের বানানো পোশাক কিনতে পারেন না চড়া দামের কারণে। এই সুযোগে বাজারে ভারত ও চীনের পোশাক পণ্য ঢুকছে। উচ্চ শুল্ক চাপিয়ে এই আমদানি থামিয়ে দিলে দেশি ব্র্যান্ডগুলো যে কম দামে ক্রেতাকে পোশাক দেবে তার নিশ্চয়তা নিয়ে সন্দেহ আছে।

গরু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে মাংসের দাম চড়াভারতীয় পণ্য বয়কটের মধ্যেই নতুন করে গরুর মাংস বয়কটের ডাক শোনা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে নতুন বছরের পুরোটা সময় ধরেই এক কেজি গরুর মাংসের জন্য ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে কমবেশি ৭৫০ টাকা। অবশ্য এই সময়ে ভারতে এই মাংসের দাম ২৫০ টাকার মধ্যে।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য মতে, ২০১৪ সালে এক কেজি গরুর মাংসের দাম ছিল ৩০০ টাকা। ওই বছরই ভারত গরু রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এরপর সরবরাহ সংকটে বাংলাদেশে প্রতি বছরই গরুর মাংসের দাম বাড়তে থাকে। গত একদশকে প্রাণিজ মাংসের এই উৎসটির দাম বেড়েছে ১৫০ শতাংশ।

২০১৩ সালে ভারত থেকে আমদানি হয়েছিল ২৩ লাখ। সরকারি হিসাবে, ওই বছর দেশে উৎপাদিত গরুর সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৩৫ লাখ। এর পরের বছর ভারত গরু রপ্তানি নিষিদ্ধ করলে বাংলাদেশ আমদানিনির্ভরতা কাটাতে গবাদিপশু উৎপাদনে জোর দেয়। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ৪৯ লাখ গরু। আমদানির সংখ্যাসহ স্থির চাহিদা বিবেচনা করা হলেও গরুর ঘাটতি থাকে এখনো ৩০ লাখ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে মাংসের চাহিদা যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি।

মাংসের দামের আকাশচুম্বী অবস্থাও প্রমাণ করে বাজারে সরবরাহের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। সরকারি পরিকল্পনা ও যথেষ্ট লাভের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমদানি প্রতিস্থাপন শিল্প নীতির মাধ্যমে গো-মাংসের চাহিদা সবটুকু পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ বিভিন্ন সময় সরকারের মন্ত্রীরা ঘোষণা দিয়েছেন, গরু উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে দরিদ্র শ্রেণির বহু মানুষ আছেন যারা সারা বছরেও একবাবর এই আমিষ কিনতে পারেন না।

এমন একটা পরিস্থিতিতে উৎপাদনে সত্যিকারের স্বয়ংসম্পূর্ণ না হয়ে, ভারতীয় পণ্য বর্জনের যে ডামাডোল, তাতে আখেরে সাধারণ ক্রেতার পকেট কাটা যাবে নিশ্চিত। বাজারে পোশাক, মাংস, চাল, আলু পেঁয়াজসহ অন্য নিত্যপণ্যের সরবরাহ সংকট বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে; আর মুনাফার পকেট ভারী হতে থাকবে সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীদের।

লেখক: কলাম লেখক।

এইচআর/ফারুক/এমএস