মতামত

কানাডায় বাংলাদেশ হাইকমিশনারের অগ্রাধিকার

কানাডায় বাংলাদেশ হাইকমিশনার ড. খলিলুর রহমানের নিয়োগের মেয়াদ এপ্রিল মাসে শেষ হয়ে যাওয়ায় তাঁকে দেশে ডেকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সরকার। খলিলুর রহমান একা নন, জার্মানির রাষ্ট্রদূত মোশারফ হোসেনসহ এরকম ১০জন রাষ্ট্রদূতের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তাঁদেরকে সরকার দেশে ডেকে পাঠিয়েছে। পরবর্তীতে সরকার অবশ্য জার্মান রাষ্ট্রদূত মোশারফ হোসেনের ফিরিয়ে নেওয়ার আদেশ স্থগিত করে, তাঁর মেয়াদ ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে বলেই আমরা জেনেছি। বাকি ৯ জন রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনারের ব্যাপারে এরকম কিছু এখন পর্যন্ত শোনা যায়নি। অবশ্য কানাডার প্রগতিশীল এবং বিশেষ করে স্বাধীনতার পক্ষের অনেক নাগরিক, যারা বাংলাদেশের বিগত জাতীয় নির্বাচনের আগে আন্তর্জাতিক অপপ্রচার এবং ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জোরালোভাবে কাজ করেছেন, তাঁরা হাইকমিশনার ড. খলিলুর রহমানের ব্যাপারেও এরকম একটি সিদ্ধান্ত প্রত্যাশা করছিলেন। এই প্রত্যাশার পিছনে কিছু যুক্তিসংগত কারণও আছে। কেননা হাইকমিশনার নিজ উদ্যোগে এবং একান্তই ব্যাক্তিগত কমিটমেণ্ট থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন, যা আগে কখনো কোনো হাইকমিশনাকে নিতে দেখা যায়নি। সুতরাং তাঁদের বদ্ধমূল ধারণা যে বর্তমান হাইকমিশনার ড. খলিলুর রহমান চলে যাওয়ার পর তাঁর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় অগ্রগতি হওয়া পদক্ষেপগুলো গতি হারিয়ে ফেলবে এবং এব্যাপারে আর তেমন কোনো কাজই হবে না।

Advertisement

একথা ঠিক যে কানাডা থেকে বাংলাদেশ হাইকমিশনারকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার কারণে প্রবাসী বাংলাদেশীদের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার তেমন কিছুই নেই। কেননা কানাডায় বসবাসরত বাংলাদেশীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে এখানকার বাংলাদেশ হাইকমিশনারের কিছু করণীয় নেই। অবশ্য যারা এখানে শিক্ষার্থী হিসেবে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে বা যারা ভিজিট ভিসা নিয়ে এসেছেন তাঁদের কোনো সমস্যা হলে তাঁদের দেখভাল করার দায়িত্ব অবশ্যই এখানে নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশনারের। কিন্তু এদের সংখ্যা এখন পর্যন্ত খুবই নগণ্য। কানাডায় যাঁরা এসেছেন তাঁদের অধিকাংশই কানাডার নাগরিকত্ব বা স্থায়ী বাসিন্দার স্ট্যাটাস (পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট) নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। শুধুমাত্র বাংলাদেশী পাসপোর্ট নবায়ণ এবং বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য কানাডিয়ান পাসপোর্টে ‘নো ভিসা’ সিল মারা ছাড়া এরকম বাংলাদেশীদের জন্য এখানকার বাংলাদেশ হাইকমিশনের কিছু করার নেই। তাও এই কাজটি করে থাকে হাইকমিশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। কানাডার প্রবাসী বাংলাদেশীদের কোনো সমস্যা দেখার ক্ষেত্রে এখানকার বাংলাদেশ হাইকমিশনারের কোনোরকম ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই এবং সেই প্রয়োজনও নেই। কেননা তাদের সমস্যা দেখবে কানাডার সরকার, কারণ তাঁরা হয় কানাডার নাগরিক বা পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট, তাই তাদের দেখভাল করার দায়িত্ব এখানকার সরকারের। মধ্যপ্রাচ্যের মতো দেশের বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতের সেখানকার বাংলাদেশীদের দেখভাল করার দায়িত্ব আছে, কেননা সেখানকার বসবাসরত বাংলাদেশীরা সেসব দেশের নাগরিক বা পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট না। কিন্তু কানাডা বা অন্যান্য উন্নত দেশে যেখানে বাংলাদেশীরা হয় নাগরিকত্ব, নাহয় পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট হয়ে বসবাস করছেন সেখানে বাংলাদেশ হাইকমিশনারের কোনোকিছু করার থাকে না এবং করেও না।

কানাডার বাংলাদেশ হাইকমিশনারের ব্যাপারটাও সেরকমই। এখানে বাংলাদেশ হাইকমিশনারের মূল দায়িত্বটা হচ্ছে সরকারের প্রতিনিধিত্ব করে এখানকার সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। বাংলাদেশ সরকারের রাজনৈতিক নীতি-আদর্শের বিষয়টি তুলে ধরা এবং বাংলাদেশের ব্যবসাবাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করা। তবে একথা ঠিক যে সম্প্রতি কানাডায় বাংলাদেশের বিষয় নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে, যারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:

১. এখানকার জনপ্রিয় একটি টেলিভিশন চ্যানেল, সিবিসি, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি নূর চৌধুরীর উপর একটি ডকুমেন্টারি প্রচার করেছিল যা এখানকার মূলধারার জনগণকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে এবং কানাডা সরকার বিষয়টি নিয়ে একটু বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। ২. কানাডার কয়েকজন প্রভাবশালী এমপি সবসময়ই জোরালো ভাবে বর্তমান বাংলাদেশ সরকার, বিশেষকর শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকারের প্রশংসা করে থাকে। এমনকি গত নির্বাচনে আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশের বিরোধিতার মধ্যেই কানাডার কয়েকজন এমপি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের পক্ষে প্রশংসা করে স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন। গত জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে এসে ভালো মতামত দিয়েছেন। ৩. কানাডায় আন্তর্জাতিক গণহত্যা মিউজিয়ামে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা অন্তর্ভুক্ত করার বিষয় অনেকদূর এগিয়ে গেছে। ৪. কানাডার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের ক্ষেত্রেও ভাল অগ্রগতি হয়েছে, বিশেষকরে দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ সুরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনায় আছে।

Advertisement

৫. কানাডায় বসবাসরত মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের বাংলাদেশীরা সংগঠিত হয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পার্লামেন্টারি সদস্যদের চিঠির এবং আমেরিকার কংগ্রসম্যানদের চিঠির আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছে। এমনকি দেশবিরোধী প্রচারণার প্রতিবাদ অব্যাহত রাখা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করা এবং দেশের ব্যবসাবাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখার উদ্দেশ্যে তাঁরা একটি থিংক ট্যাংকও প্রতিষ্ঠা করেছে।

এসব কার্যক্রম যে এমনিতেই হয়েছে তেমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। যে কাজ বিগত কয়েক দশকে হয়নি, তা মাত্র তিন বছরে এতদূর এগিয়েছে অনেকের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য। বিশেষ করে বর্তমান হাইকমিশনার ড. খলিলুর রহমান দায়িত্ব নিয়ে আসার পর থেকেই এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন এবং সে অনুযায়ী কাজও করেছেন। বলা চলে তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় বিষয়গুলো সামনে এসেছে এবং এতদূর এগিয়েছে। তাঁর এতসব কাজের জন্য অবশ্য এখানকার একশ্রেণির প্রবাসী বাংলাদেশি তাঁকে ফিরিয়ে নেওয়ার সংবাদে বেশ খুশিই হয়েছে। কারণ তারা ভাল করেই জানে যে বর্তমান হাইকমিশনার চলে গেলে উদ্যোগগুলো এমনিতেই হিমাগারে চলে যাবে। উপরে উল্লেখিত প্রচেষ্টাগুলোর ক্ষেত্রে বর্তমান হাইকমিশনারের সরাসরি ভূমিকা আছে। তার চেয়ে বড় কথা তিনি বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সময়মত সঠিক স্থানে সঠিক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন এবং নিয়মিত যোগাযোগ রেখে বিষয়গুলো ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করেছেন।

হাইকমিশনার ড. খলিলুর রহমান নিজেও বিষয়গুলোর গুরুত্ব তুলে ধরে বাংলাদেশের একাধিক পত্রিকায় কলাম লিখেছেন এবং একাধিক টেলিভিশন টকশোতে অংশ নিয়ে স্পষ্টভাবে বক্তব্য দিয়েছেন। সেসব লেখা এবং টেলিভিশন টকশোতে তিনি স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছেন যে তাঁর সময়ে ব্যক্তিগত কমিটমেণ্ট এবং দায়বদ্ধতা থেকেই তিনি এসব বিষয়ে কাজ করেছেন এবং এতটুকু অগ্রগতি করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর লেখা এবং বক্তব্যে তিনি এই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে তাঁর উত্তরসূরি এসব কাজের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখবে এবং উদ্যোগগুলো সফলতার দিকে নিয়ে যাবে। আমরাও তাই প্রত্যাশা করি, কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতার কারণে খুব একটা আশ্বস্ত হতে পারি না। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে দাপ্তরিক দায়িত্বপালন এবং ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য আছে।

আমাদের অধিকাংশ সরকারী আমলা এবং কূটনীতিকরা অফিসিয়াল দায়িত্বই পালন করে থাকেন। ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুরুত্বহীনই থেকে যায়।

Advertisement

সম্প্রতি একটি ডিনার অনুষ্ঠানে কানাডার বাংলাদেশ দূতাবাসে সদ্য যোগ দেওয়া একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে তাঁকে কিছু কাজের বিষয় উল্লেখ করেছিলাম এবং প্রতিউত্তরে তিনি আমাকে জানালেন যে বিধি মোতাবেক সব হবে। হ্যাঁ, সরকারি আমলারা একটি বিষয় খুব ভাল জানেন, তা হচ্ছে ‘বিধি মোতাবেক’, কিন্তু বিধির বাইরে যে কতোকিছু ঘটে তা কতটুকু জানেন, সেটাই বড় প্রশ্ন। বেশ কয়েক বছর আগে আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন এক ব্যক্তি যিনি সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে কিছু সম্ভাব্য পদক্ষেপ উল্লেখ করে প্রকাশিত একটি লেখা নিজে নিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তারপর সে বিষয়ে আমরা আর কোনো কিছুই শুনিনি। আমি নিশ্চিত সেসময়ের হাইকমিশনার সেই লেখা পড়ে দেখার সুযোগও পাননি। এসব কারণেই আমরা মোটেই আশ্বস্ত হতে পারছি না যে কানাডার নতুন বাংলাদেশ হাইকমিশনার ড.খলিলুর রহমানের নেওয়া উদ্যোগগুলো সফলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। যা হোক কানাডায় বাংলাদেশ হাইকমিশনারের আসা-যাওয়া খুবই স্বাভাবিক এবং নিয়মিত ঘটনা। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান হাইকমিশনার ড. খলিলুর রহমান তাঁর মেয়াদ শেষে চলে যাবেন এবং তাঁর স্থলে নতুন হাইকমিশনার যোগ দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। এতে আমাদের ব্যক্তিগতভাবে কিছুই এসে যায় না। কেননা আগেই উল্লেখ করেছি কানাডার বাংলাদেশ দূতাবাসে আমাদের বাংলাদেশ পাসপোর্ট নবায়ণ এবং নো-ভিসা সিল লাগানো ছাড়া আমাদের কোনো কাজ নেই। কিন্তু আমরা এতটুকু প্রত্যাশা করি যে সরকার এমন একজনকে কানাডায় বাংলাদেশ হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগ দিবেন যিনি খলিলুর রহমানের মেয়াদকালে অগ্রগতি হওয়া বিষয়গুলো সফলতার দিকে এগিয় নিতে সক্ষম হবেন। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এবং উন্নত বাংলাদেশের ব্যাপারে কানাডায় সম্প্রতি যেসব অগ্রগতি হয়েছে তা এখানে নিযুক্ত হাইকমিশনারের গুরুত্ব অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এই পদ এখন আরে গতানুগতিক কূটনীতিকের পর্যায়ে নেই। একারণেই ড. খলিলুর রহমানের উত্তরসূরির সেই মাপের যোগ্যতা, মানসিক প্রস্তুতি এবং অঙ্গীকার থাকতে হবে। বিষয়টি সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে এমন কাউকে হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগ দিবেন, যিনি এই উদ্যোগগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখবেন এবং চূড়ান্ত পর্যায় নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন।

লেখক: সার্টিফায়েড অ্যান্টি-মানিলন্ডারিং স্পেশালিষ্ট ও ব্যাংকার, টরনটো, কানাডা।

এইচআর/জিকেএস