জাতীয়

সেচের নামে সরকারের ৪৬৩ কোটি টাকা পানিতে যাওয়ার শঙ্কা

সেচ কার্যক্রম সম্প্রসারণে অনিশ্চয়তা নিয়েই ৪৬৩ কোটি ৮৪ লাখ ৩৯ টাকা খরচের ছক কষেছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ ও নরসিংদীর পলাশে সেচ উন্নয়নে ক্যানেল (খাল) তৈরি করতে এ প্রকল্প প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি। প্রস্তাবিত আশুগঞ্জ-পলাশ সবুজ প্রকল্পের ক্যানেলটি যে জায়গায় হবে সেটি সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের।

Advertisement

সওজ অধিদপ্তর তাদের জায়গায় এ ক্যানেল করতে দিতে রাজি হলেও শর্ত জুড়ে দিয়ে জানিয়েছে, সড়ক সম্প্রসারণের প্রয়োজনে তিনমাসের নোটিশে ওই জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। অর্থাৎ, সেচের নামে পানিতে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে ৪৬৩ কোটি টাকা। এ নিয়ে প্রকল্পটির মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) মাধ্যমে কুলিং রিজার্ভারভরাট করা এবং আশুগঞ্জ নদীবন্দর-সরাইল-ধরখার-আখাউড়া স্থলবন্দর মহাসড়ককে চার লেন জাতীয় মহাসড়কে উন্নীতকরণের ফলে বিএডিসির সেচ কার্যক্রম ব্যাহত হয়। উদ্ভূত এ সমস্যা নিরসনে প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নরসিংদী জেলার সাতটি উপজেলায় বাস্তবায়িত হবে।

সওজ অধিদপ্তর তাদের জায়গায় এ ক্যানেল করতে দিতে রাজি হলেও শর্ত জুড়ে দিয়ে জানিয়েছে, সড়ক সম্প্রসারণের প্রয়োজনে তিন মাসের নোটিশে ওই জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। অর্থাৎ, সেচের নামে পানিতে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ৪৬৩ কোটি টাকা। এ নিয়ে প্রকল্পটির মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন

Advertisement

প্রস্তাবিত প্রকল্পের মাধ্যমে ভূ-উপরিস্থ পানি দ্বারা প্রকল্পের খরাপ্রবণ এলাকা পানি পাবে এবং মাটির পানি ধারণক্ষমতা নিম্নমান থেকে মধ্যম মানে উন্নীত করবে। এছাড়া এসডিজি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এ প্রকল্পের আওতায় দুটি জেলায় দারিদ্র্য ও ক্ষুধার অবসান, খাদ্যনিরাপত্তা, পুষ্টিমান অর্জন এবং কৃষির প্রসারে সহায়তা করবে।

বিএডিসি জানায়, চলতি সময় থেকে জুন ২০২৭ মেয়াদে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদর, আশুগঞ্জ, নবীনগর ও সরাইলে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এছাড়া নরসিংদীর সদর, পলাশ ও শিবপুরে বাস্তবায়ন হবে প্রকল্পটি।

আরও পড়ুন

জলাশয় ভরাট করে বিএডিসির ল্যাব নির্মাণ অবৈধ সৌরশক্তির সেচে সবজি চাষে সফল কৃষক বয়সের ভারে ন্যুব্জ গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ, বন্ধ পানি সরবরাহ

কমিশন জানায়, ক্যানেল নির্মাণে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের সঙ্গে বিএডিসির চুক্তি হয়। ভূমি ব্যবহার সংক্রান্ত চুক্তি সই হলেও চুক্তিটিতে মাত্র পাঁচ বছরের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও প্রকল্পটি ভবিষ্যতে নবায়নের সুযোগ রয়েছে। অথচ চুক্তির শর্ত ৬-এ বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে সড়ক সম্প্রসারণের প্রয়োজন হলে মাত্র তিন মাসের নোটিশে বিএডিসি নতুন অ্যালাইনমেন্টে নিজস্ব খরচে নির্মিত সেচ স্থাপনাসহ সব কাজ অপসারণ করবে।

Advertisement

আশুগঞ্জে সেচ প্রকল্পের খাল যেন ময়লার ভাগাড়

এ ধরনের অস্থায়ী ব্যবস্থাপনা চুক্তির ওপর ভিত্তি করে সরকারের ৪৬৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ যথার্থ হবে কি না, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন বলে জানিয়েছে কমিশন। এমন অনিশ্চিত প্রকল্প না নিয়ে বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে আসতেও বলা হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশন জানায়, আশুগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের পানি শীতলীকরণ করে সেচ কাজে ব্যবহার করতে কুলিং রির্জাভার তৈরির লক্ষ্যে ভূমি ব্যবহারের জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে চুক্তি করার কথা থাকলেও পিইসি সভা অনুষ্ঠানের এক বছর দুই মাস পার হলেও এখনো চুক্তিটি সই হয়নি। বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ এর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, কৌশল ও কার্যক্রমের সঙ্গে এ প্রকল্পের কার্যক্রম কীভাবে সম্পৃক্ত তার সুস্পষ্ট বর্ণনা উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা বা ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

এ প্রকল্পের মাধ্যমে ভূ-উপরিস্থ পানি দ্বারা প্রকল্পের খরাপ্রবণ এলাকা পানি পাবে এবং মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা নিম্নমান থেকে মধ্যম মানে উন্নীত হবে। এছাড়া এসডিজি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এ প্রকল্পের আওতায় দুই জেলায় দারিদ্র্য ও ক্ষুধার অবসান, খাদ্যনিরাপত্তা, পুষ্টিমান অর্জন এবং কৃষির প্রসার ঘটবে

পাশাপাশি প্রকল্প এলাকার দুর্যোগ ও জলবায়ু ঝুঁকি চিহ্নিত করতে ডিজাস্টার অ্যান্ড ক্লাইমেট রিস্ক ইনফরমেশন প্ল্যাটফর্ম (ডিআরআইপি) ব্যবহার করে ডিজাস্টার ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ডিআইএ) করা হয়নি। ডিআরআইপির মাধ্যমে ডিআইএ করে প্রকল্প এলাকার দুর্যোগ ও জলবায়ু ঝুঁকি চিহ্নিত করে তা নিরসনের উপায় ডিপিপিতে সংযোজন করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের একজন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, প্রকল্পটি নিয়ে পিইসি সভা হয়েছে। সভায় আমরা কিছু নির্দেশনা দিয়েছি। আশুগঞ্জ-পলাশ সবুজ প্রকল্পের ক্যানেলটি অস্থায়ী জায়গায় প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা এক ধরনের অনিশ্চয়তা, যা ঠিক করে দিতে বিএডিসিকে বলেছি। তারা যদি ঠিক করে দেয় তবে অনুমোদনের জন্য একনেক সভায় তুলবো, নয়তো আবারও পিইসি সভা করবো।

প্রকল্পের খালে পানি না থাকলে বিপাকে পড়েন কৃষক

বিএডিসি জানায়, আশুগঞ্জ-পলাশ সবুজ প্রকল্পের ওপর পিইসি সভা হয়েছে ২০২৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর। সভায় পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাবেক সদস্য একেএম ফজলুল হক সভাপতিত্ব করেন। কিন্তু অন্যের জমিতে ক্যানেল নির্মাণের বিষয়টি সে সভায় সুরাহা হয়নি। বিএডিসির দাবি, এ জায়গা ছাড়া তাদের হাতে বিকল্প কোনো জায়গা নেই। এ কারণে সওজের জায়গায় ক্যানেল করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

জমির মালিকানা নিয়ে সওজ ও গণপূর্তের রশি টানাটানি! নাকের ডগায় জমি দখল হলেও নীরব সওজ

বিএডিসির প্রধান প্রকৌশলী (ক্ষুদ্র সেচ) শিবেন্দ্র নারায়ণ গোপ জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রস্তাবিত আশুগঞ্জ-পলাশ সবুজ প্রকল্পের ক্যানেলটি যে জায়গায় হবে, সেটি সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের। এটা ছাড়া বিকল্প জায়গা নেই। পরিকল্পনা কমিশন এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কিন্তু বিকল্প জায়গা না থাকায় এ জায়গার প্রস্তাব করা হয়েছে। দরকার হলে আবারও কমিশনের সঙ্গে পিইসি সভা করবে।

প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম

প্রকল্পের আওতায় আশুগঞ্জ থেকে এক হাজার ১০০ এবং ঘোড়াশালের থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে প্রাপ্ত ৮০০ কিউসেক পানি শীতলীকরণের মাধ্যমে ২৪ হাজার ৮৬০ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেওয়া হবে। এর মাধ্যমে এক লাখ ২৪ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন খাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব হবে। জুন ২০২০ অর্থবছরে সমাপ্ত আশুগঞ্জ-পলাশ অ্যাগ্রো ইরিগেশন (৫ম পর্যায়) প্রকল্পের ধারাবাহিকতা রক্ষায় এ প্রকল্পটি নেওয়া হচ্ছে।

প্রকল্পটি নিয়ে পিইসি সভা হয়েছে। সভায় আমরা কিছু নির্দেশনা দিয়েছি। আশুগঞ্জ-পলাশ সবুজ প্রকল্পের ক্যানেলটি অস্থায়ী জায়গায় প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা এক ধরনের অনিশ্চয়তা, যা ঠিক করে দিতে বিএডিসিকে বলেছি। তারা যদি ঠিক করে তবে অনুমোদনের জন্য একনেক সভায় উঠাবো, নয়তো আবারও পিইসি সভা করবো

ভূ-উপরিস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার করে স্থায়ী ও টেকসই সেচ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অধিক ফসল উৎপাদন নিশ্চিতকরণ; সেচ ব্যবস্থাপনা, খাদ্যশস্য উৎপাদন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজে স্থানীয় কৃষাণ-কৃষানিদের নিয়োজিত করার মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য বিমোচন করা হবে।

বিএডিসি জানায়, নানান কারণে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে কীভাবে পুনর্গঠন করা যায়, সে বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। তখন দেশজুড়ে চলছিল ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষ। তিনি এ ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষ থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে কৃষকদের প্রতি সবুজ বিপ্লবের ডাক দেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে কৃষক জনতা তখন কৃষিতে বিপ্লব ঘটায়, যা চলমান আজও।

আরও পড়ুন

২০ হাজার কৃষকের মুখে হাসি ফোটাতে পুনঃখনন হচ্ছে নান্দ খাল অনুমতি ছাড়াই রাস্তা কাটলেন ঠিকাদার

বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে আশুগঞ্জের স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্য ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি এবং কৃষকদের উদ্যোগে আশুগঞ্জ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কুলিং কাজে ব্যবহৃত গরম পানি শীতলীকরণের মাধ্যমে আশুগঞ্জ সবুজ প্রকল্প নামে সেচ কার্যক্রম শুরু করে।

খাল ভরাট করে চলে মহাসড়ক নির্মাণকাজ

পরবর্তীসময়ে সরকারিভাবে ১৯৭৮ থেকে ১৯৭৯ সময়ে ‘আশুগঞ্জ সবুজ প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। একই সময়ে নরসিংদীর পলাশ এলাকায় অনুরূপ একটি সেচ প্রকল্প গড়ে ওঠে। ১৯৯০ থেকে ৯৫ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য দুটি প্রকল্প একীভূত করে ‘আশুগঞ্জ-পলাশ অ্যাগ্রো-ইরিগেশন প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদিত হয়, যা ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে বাস্তবায়ন শেষে জুন ২০২০ সময়ে ‘আশুগঞ্জ-পলাশ অ্যাগ্রো-ইরিগেশন প্রকল্প’ নামে পঞ্চম পর্যায় সমাপ্ত হয়।

প্রস্তাবিত প্রকল্পটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নরসিংদী জেলা নিয়ে গঠিত। মোট সাতটি উপজেলা এ প্রকল্পের আওতায়। প্রকল্প এলাকায় মোট জমির পরিমাণ এক লাখ ১৪ হাজার ৯৮৫ হেক্টর। যেখানে চাষযোগ্য জমি এক লাখ ছয় হাজার ৪১ হেক্টর, সেচযোগ্য ৮৩ হাজার ৪৩৪ হেক্টর এবং সেচকৃত জমির পরিমাণ ৬৪ হাজার ৯৯৩ হেক্টর।

এমওএস/এমকেআর/জেআইএম