দেশজুড়ে

কমিটি করে পাঁচ গ্রামকে মাদকমুক্ত ঘোষণা করলেন এলাকাবাসী

মাদক একটি সামাজিক ব্যাধি। একটি পরিবারকে ধ্বংস করতে একজন মাদকসেবক বা মাদক কারবারিই যথেষ্ঠ। তাই বর্তমান ও আগামী প্রজন্মকে মাদকমুক্ত রাখতে যুব সংঘ নামে কমিটি গঠন করে মাত্র ৬ মাসের চেষ্টায় গ্রামকে মাদকমুক্ত গ্রাম ঘোষণা করেছে এলাকাবাসী।

Advertisement

এমনই এক সাফল্য অর্জন করেছে রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দির বহরপুর ইউনিয়নের চরবহরপুর শান্তিমিশন গ্রামবাসী। এখন তাদের দেখাদেখি ইউনিয়নের আরও ৪টি গ্রামবাসী তাদের গ্রামকে মাদকমুক্ত ঘোষণা করেছেন।

মাদকমুক্ত গ্রামগুলো হলো- বহরপুর ইউনিয়নের চরবহরপুর শান্তিমিশন, দিলালপুর, চরবহরপুর উত্তর পাড়া, চরফরিদপুর ও নতুন চর।

এদিকে গ্রামবাসীর এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে সকল ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন পুলিশ সুপার জি.এম. আবুল কালাম আজাদ। মাদক নির্মূল সমাবেশে গ্রামবাসীকে শপথবাক্য পাঠ করান তিনি।

Advertisement

মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) যুবকদের মঝে মাদকবিরোধী জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে মাদক নির্মূল র্যালি ও সমাবেশ করেন স্থানীয়রা। সেসময় তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে র্যালি ও সমাবেশে যোগ দেয় জেলা পুলিশ, উপজেলা প্রশাসন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ অনেকে।

জানা গেছে, রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দির বহরপুর গত কয়েকমাস আগেও ছিল মাদকের স্বর্গরাজ্য। হাত বাড়ালেই পাওয়া যেত মাদকদ্রব্য। মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে গ্রামের উঠতি বয়সী তরুণ, কিশোর, যুবকসহ বয়স্করা। এদের মাধ্যমে পারিবারিক কলোহসহ নানা অপকর্ম সংগঠিত হতো।

একপর্যায়ে বহরপুর শান্তিমিশন এলাকার বাংলাদেশ নিম ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. এম এ হাকিম মাদক নির্মূলে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রথমে চরবহপুর শান্তিমিশন গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারের মানুষকে নিয়ে মাদকবিরোধী যুব সংঘ কমিটি গঠন করেন। পরবতীর্তে ওই কমিটি তাদের এলাকা থেকে ৫ জন মাদক সেবীকে ধরে পুলিশে দেয় এবং মাদকবিরোধী নানাবিধ কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখে। যার প্রেক্ষিতে এখন গ্রামবাসী চরবহরপুর শান্তিমিশন এলাকাকে মাদকমুক্ত স্মার্ট গ্রাম হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। তাদের দেখাদেখি আশপাশের আরও ৪টি গ্রাম একইভাবে কমিটি গঠন করে মাদকমুক্ত গ্রাম ঘোষণা দিয়ে মাদকবিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে।

মাদক থেকে ফিরে আসা জাহিদ মোল্লা ও ইবাদত শেখ বলেন, মাদক সেবনকালে তাদের পরিবারে নানা রকম সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। যার কারণে তাদের জেল খাটা ও মাদক নিরাময় কেন্দ্রে থাকতে হয়েছে। সেসময় তাদের গ্রামবাসী ও পুলিশি ভয়ে থাকতে হয়েছে, এমনকি তাদের শরীর-স্বাস্থ্যও খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এখন তারা আর মাদকসেবন করেন না। যার কারণে অনেক ভালো আছেন এবং এখন সবাই তাদেরকে মূল্যায়ন করে। এখন ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের পাশাপাশি গ্রামকে মাদকমুক্ত করতে কাজ করছেন।

Advertisement

চরবহরপুর শান্তিমিশন যুব সংঘের সভাপতি মাহউদ্দিন খান বাবু, সাধারণ সম্পাদক পিয়াস খান, স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা মনসুরুল আলম, ইদ্রিস শেখ বলেন, কয়েকমাস আগেও তাদের গ্রাম ছিল মাদকের অভয়াশ্রম। তবে এখন আর তাদের গ্রামে কেউ মাদকসেবন, গ্রহণ বা বেচাকেনা করে না। এমনকি স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীরাও এখন আর ইভটিজিংয়ের শিকার হয় না। তাদের দেখাদেখি ইউনিয়নের আরও ৪টি গ্রামবাসী তাদের গ্রামকে মাদকমুক্ত ঘোষণা করেছেন এবং এটি বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম মাদকমুক্ত গ্রাম।

চরবহরপুর শান্তিমিশন গ্রামের বাসিন্দা বাংলাদেশ নিম ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. এম এ হাকিম বলেন, এটা তার জন্মস্থান হলেও শিক্ষা অর্জনের জন্য ঢাকায় থেকেছেন। গ্রামে এলে মাদকের ভয়াবহতা, ইভটিজিং সম্পর্কে জানতে পারেন। দেখেন যুব সমাজ সবচেয়ে বেশি আসক্ত হয়েছে। একজন গবেষক হিসেবে তিনি মনে করেন একটা জাতিকে ধ্বংস করতে ওই সমাজের কিশোর ও যুব সমাজই যথেষ্ঠ। মাদকাসক্তের কারণে তারা মানসিকভাবে পঙ্গু, তাদের স্মৃতিশক্তি নষ্ট, অপরাধ প্রবণ ও মাদকের টাকার জন্য মা-বাবার গয়ে হাত পর্যন্ত তুলছে। এই মাদক থেকে যুব সমাজকে রক্ষায় তিনি এলাকার যুবক ও বয়স্কদের নিয়ে একটি সভা করেন। সভায় সবাই তাকে সহযোগিতার আশ্বাস দিলে তিনি গ্রামকে মাদকমুক্ত করতে কাজ শুরু করেন।

তিনি বলেন, মাত্র কয়েক মাসের চেষ্টায় বাংলাদেশের প্রথম মাদকমুক্ত গ্রাম হিসেবে বালিয়াকান্দির চরবহরপুর শান্তিমিশন গ্রামকে মাদকমুক্ত গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করেন। যারা মাদক থেকে ফিরে এসেছে তারা এখন নিয়মিত স্কুল ও মসজিদে যাচ্ছে। এখন গ্রামের কেউ আর ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছে না। আর তারাই মাদক নির্মূলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাদের এই সফলতা দেখে আশপাশের আরও ৪টিসহ মোট ৫টি গ্রাম মাদকমুক্ত ঘোষণা করেছে।

রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার জি.এম. আবুল কালাম আজাদ (পিপিএম) বলেন, এটি একটি চমৎকার উদ্যোগ। মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য পুলিশ সব সময় জনগণকে পাশে চায়। এরইমধ্যে তারা একটি থেকে ৫টি এবং ৫টি থেকে ৭টি গ্রামকে মাদকমুক্ত ঘোষণা করেছে। এটা বড় একটি সাফল্য। গ্রামবাসীর মাদকবিরোধী লড়াইয়ের সঙ্গে পুলিশ সবসময় ছিল, আছে এবং থাকবে। গ্রামবাসীকে পাশে নিয়ে পুলিশ গ্রামগুলোকে মাদকমুক্ত রাখতে কাজ করবে।

রুবেলুর রহমান/এফএ/এমএস