বাবা ভ্রাম্যমাণ ফলের দোকানের কর্মচারী। মাকেও সংসার চালাতে করতে হয় নানা কাজ। টিনের ঘরটি বর্ষায় পানিতে ডুবে যায়। ঘরে নেই পড়শোনার ভালো পরিবেশও। সংসারে নূন আনতে পান্তা ফুরায়। এতোসব প্রতিকূলতার মধ্যেও ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের দক্ষিণ ইদিলপুর গ্রামের তাহমিনা আক্তার মুন্নি। এ খবরে পুরো এলাকায় প্রশংসায় ভাসছেন তিনি।
Advertisement
তাহমিনা এ বছর ভর্তি পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বি’ ইউনিটে ১৮১তম ও ‘সি’ ইউনিটে ৩১২তম হয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ডি’ ইউনিটে ৭৯তম এবং ‘বি’ ইউনিটে ৪৫৪তম হয়েছেন।
তাহমিনার বাবা মো. মিজান শ্রবণপ্রতিবন্ধী। সীতাকুণ্ড পৌরসদর বাজারে একটি ভ্রাম্যমাণ ফলের দোকানে সামান্য বেতনে কাজ করেন তিনি। মা কোহিনুর বেগমও সংসারের প্রয়োজনে নানা কাজ করেন।
অদম্য ইচ্ছাশক্তি কীভাবে মানুষকে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছে দেয় মেধাবী শিক্ষার্থী তাহমিনা তার বড় উদাহরণ। তাহমিনা বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডার হতে চান।
Advertisement
পুলিশ ক্যাডারে আগ্রহের কারণ জানতে চাইলে তাহমিনা বলেন, ‘আমার বাবা একজন সামান্য ফলবিক্রেতা। ফুটপাতে ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় ফল বিক্রি করেন বাবা। আমার বাবার পেশা আমার কাছে সবচেয়ে বড়। আমি গর্বিত আমি ফলবিক্রেতার মেয়ে। কাজ করতে গিয়ে আমার বাবাকে অনেক সময় পুলিশের কাছে হেনস্তা হতে হয়েছে। সেসব কথা আমি বলতে চাই না। আমি বড় হয়ে পুলিশ কর্মকর্তা হয়ে সমাজের সেবা করতে চাই।’
২০০৬ সালের ২ এপ্রিল সীতাকুণ্ডের দক্ষিণ ইদিলপুর গ্রামে জন্ম তাহমিনার। তারা দুই বোন ও দুই ভাই। ২০২১ সালে তাহমিনা সীতাকুণ্ড বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে ব্যবসায়শিক্ষা বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করেন। এরপর ২০২৩ সালে একই বিভাগে সীতাকুণ্ড সরকারি মহিলা কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এইচএসসি পাস করেন।
একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময়ই তাহমিনার স্বপ্ন জাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তণ ছাত্র মুসলিম উদ্দিন তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সবসময় তাকে এবং তার পরিবারকে সহযোগিতা করেছেন।
তাহমিনা আক্তার বলেন, আমি দৈনিক ১০ ঘন্টার বেশি পড়াশোনা করতাম। ছাত্রজীবনে অনেক কষ্ট করেছি। একটি ভালো মানের ব্যাগ পাওয়া, ঘড়ি পাওয়া স্বপ্নের মতো ছিল। কতদিন না খেয়ে স্কুলে গিয়েছি তার কোনো হিসাব নেই। স্কুল থেকে এসেও না খেয়ে পড়তে বসেছি। আমাকে আমার চলার পথে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণা দিয়েছে আমাদের প্রতিবেশী মুসলিম মামাদের পরিবার। তারা আমাদের আত্মীয়ের চেয়ে কোনো অংশে কম নন। এরপর আমার শিক্ষক ও প্যাসিফিক জিন্স ফাউন্ডেশন। আমার শিক্ষকরা টিউশন ফি নিতেন না। আমি বই, খাতা, কলম পেতাম বিনামূল্যে। প্যাসিফিক জিন্স ফাউন্ডেশন আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করার সুযোগ দিয়েছে। আমি তাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। সবাই সম্মিলিতভাবে আমাকে সহযোগিতা না করলে আমার এতোদূর আসা সম্ভব হতো না।
Advertisement
তাহমিনার মা কোহিনূর বেগম বলেন, মেয়েকে পড়াশোনা করাতে জীবনে অনেক সংগ্রাম করেছি। শত ত্যাগের ফসল আমি পেয়েছি। মেয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ায় অনেক খুশি হয়েছি।
তার বাবা মো. মিজান বলেন, আমি অন্যের অধীনে কাজ করে সামান্য টাকা রোজগার করি। যে পয়সা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হয়। মেয়ে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে এটা জেনে আমি খুবই খুশি হয়েছি। যেন আমার জীবনের সব দুঃখ, কষ্ট আর না পাওয়ার বেদনা ধুয়ে মুছে গেছে।
তবে কীভাবে মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাবেন, বই কিনবেন এবং ব্যয় বহন করবেন তা নিয়ে বরাবরই চিন্তিত তিনি। মেয়ে বড় হয়ে দেশের সেবা করুক সেটিই চান তাহমিনার বাবা।
সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কে এম রফিকুল ইসলাম বলেন, একজন ফল বিক্রেতার মেয়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সুযোগ পাওয়া অত্যন্ত আনন্দের বিষয়। উপজেলা প্রশাসন সবসময় গরিব, অসহায় ও মেধাবীদের পাশে থাকে। তার ভর্তির জন্য আর্থিক সাহায্যের আবেদন করলে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে।
এম মাঈন উদ্দিন/এফএ/এএসএম