আমরা এমন একটা সমাজে বাস করছি যেখানে সবচেয়ে বেশি আদর, ভালোবাসা ও নিরাপত্তার মধ্যে যাদের থাকার কথা, তারাই সবচাইতে অনিরাপদ ও ভালোবাসাহীন পরিবেশে বসবাস করছে। নানাধরনের নির্যাতন ও নিপীড়নের মধ্যে আপনার-আমার শিশু বড় হয়ে উঠছে। এর কিছু আমরা জানতে পারি, কিন্তু বেশিটাই জানতে পারি না। উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সব সমাজেই শিশুর অবস্থান খুব নাজুক। আর পথশিশুদের নিয়ে ভাবার অবকাশ নেই আমাদের কারও। ফলে এরা থেকে যাচ্ছে সবচেয়ে প্রান্তিক অবস্থানে, হিসাবের বাইরে। যদিও আমরা মনে করি শিশু আমাদের কাছে সবচাইতে আদর ও ভালোবাসার ধন এবং বাবা-মায়ের কাছে ও পরিবারে শিশুর অধিকার সবচেয়ে বেশি। কিন্তু পরিসংখ্যান সে কথা বলে না।
Advertisement
নতুন বছরের প্রথম তিন মাসে অর্থাৎ ২০২৪ এ দেশে অন্তত ১৩৯ শিশু নিহত হয়েছে। এছাড়া এ সময়ের মধ্যে আরও ২৭ শিশু আত্মহত্যা করেছে। সারাদেশ থেকে আরও ৩২ শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। মোট ৩২৫ শিশু নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে। ১৪ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে এবং যাদের মধ্যে একজনকে পরে হত্যা করা হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) একটি প্রতিবেদনে এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ২০২৪ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে মার্চ এর মধ্যে ১০টি জাতীয় দৈনিক এবং অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এর বাইরে যে আরও কত নিহত, আহত ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে, তা আমরা জানতেও পারছি না।
দেশে শিশু মৃত্যু ও নির্যাতনের ঘটনা একদম মূল্যহীন একটা ব্যাপার হয়ে গেছে। পরিবার, সরকার, মানবাধিকার সংগঠন, পেশাজীবী কারও কাছেই যেন এটা কোনো খবর নয়। শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত খবর পত্রিকায় একটার পর একটা প্রকাশিত হচ্ছে কিন্তু কারও গায়ে কোন আঁচ লাগছে না। সবাই ভাবছি আমার সন্তান তো নিরাপদ। অন্যের সন্তানের যা হয় হোক। বিশেষ করে মেয়েশিশুর যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের ঘটনা কারও কাছে কোনো গুরুত্ব পায় না। দরিদ্র মানুষের কর্মজীবী শিশুর নির্যাতনের ঘটনাও গুরুত্বহীন। স্কুলে মাদরাসায় শিক্ষক পেটাচ্ছেন, যৌন হয়রানি করছেন এগুলো কোনো খবর নয়। প্রায় প্রতিদিন এরকম খবর একটা দুটি প্রকাশিত হচ্ছেই। শিশুকে আমরা নির্যাতন ও অবহেলা করছি বলেই দেশে বাড়ছে শিশু-কিশোর অপরাধীর সংখ্যা। কিশোর গ্যাং, কিশোরদের দ্বারা খুন, মাদক সেবন, পর্নোগ্রাফিতে শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি সবই বড়দের তৈরি কর্মফল।
শিশুদের রক্ষার জন্য, শিশুদের প্রতি সহিংসতা, দুর্ব্যবহার, অবহেলা ও শোষণ রোধে এখনই একটি সমন্বিত জাতীয় শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। শুধু বক্তৃতা ও আলোচনা করে নয়, ভালোবেসে। শিশু বাঁচলে দেশ বাঁচবে। অন্যথায় যত বড় পরিকল্পনাই গ্রহণ করেন না কেন, যত বড় অবকাঠামো নির্মাণ করেন না কেন, যত সুদূরপ্রসারী উন্নয়ন কাঠামো গ্রহণ করেন না কেন, সবই বৃথা যাবে।
Advertisement
শিশুদের নিয়ে কর্মরত জাতিসংঘ সংস্থা ইউনিসেফও মনে করে যাদের দ্বারা শিশুরা সুরক্ষিত ও নিরাপদ থাকার কথা, তাদের হাতেই বাংলাদেশের লাখ লাখ শিশু প্রতিনিয়ত সহিংসতা, ভর্ৎসনা এবং শোষণের শিকার হচ্ছে। প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন শিশুই তাদের বাবা-মা এবং শিক্ষকসহ সেবাদানকারীদের দ্বারা শারীরিক শাস্তি বা মানসিক আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে।
বাংলাদেশে অনেক শিশুই সময়ের আগেই বড় হয়ে যেতে বাধ্য হয়। নিজেকে বোঝার আগেই এরা বড় হয়ে যায়। সমাজের কূটচালের শিকার হয়। নিজেদের পরিবারের বেঁচে থাকার কৌশলের অংশ হিসেবে অনেক কিশোর-কিশোরীকে কাজে পাঠানো হয় বা তাদের অপরিণত বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সী প্রায় সাত শতাংশ শিশু কোনো না কোনো ধরনের শিশুশ্রমে জড়িত। এছাড়া খুব অল্প বয়সী শিশুদেরও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত করা হচ্ছে।
শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা একধরনের মানসিক বিকৃতি বা অসুস্থতা। বিকৃত মনের মানুষ যে কোনো তুচ্ছ কারণে শিশুর ওপর নির্যাতন করে। শিশুদের ওপর যে কোনো ধরনের অত্যাচার করা সহজ। কারণ শিশু বাধা দিতে ও প্রতিবাদ করতে পারে না। এমনকি অত্যাচারিত হলে কারও কাছে অভিযোগও করতে ভয় পায়। যারা অপরাধী তারা জানে শিশুকে কষ্ট দিলে, অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যা করলে বাবা-মা ও শিশুর পরিবার সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে এবং অপরাধীর পক্ষে দাবি-দাওয়া আদায়ও সহজ হয়। কাজেই কাউকে শাস্তি দেওয়ার জন্য সবচেয়ে ভালো পন্থা হলো তার পরিবারের শিশুটিকে নির্যাতন করা।
বইয়ে পড়েছিলাম, মানুষই এ জীবজগতে সবচেয়ে বেশি নৃশংস। কারণ একমাত্র মানুষই পারে অপ্রয়োজনে বা তুচ্ছ কারণে মানুষ ও পশুপাখিকে ভয়ংকরভাবে হত্যা করতে, আর কোনো জীব তা পারে না। এমনকি খুব বিষধর সাপও হঠাৎ মানুষকে আক্রমণ করে না। একথাটা সেসময় শুধু পড়েছিলাম, যত দিন যাচ্ছে মানুষের সেই কদর্য চেহারাটা তত খালি চোখেই দেখতে পারছি।
Advertisement
বাচ্চাকে জন্ম দিয়ে সেই নবজাতককে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া, বাক্সবন্দি করে লুকিয়ে রাখা, মাটিতে পুঁতে ফেলা, হত্যা করে খালবিলে ফেলে রাখা বা গাছে ঝুলিযে রাখা এখন কোনো ঘটনাই নয়। এভাবে শিশু কয়েকদিন নিখোঁজ হয়ে থাকে। একদিন কুকুর, শিয়াল, শকুন আর কাক তাকে টানাটানি করে খায়। তখনই হয়তো শিশুটিকে খুঁজে পায় বাবা-মা।
প্রসঙ্গক্রমে মনে হলো রাজবাড়িতে একটি ঘোড়ার চার পা বেঁধে পায়ুপথে ও মূত্রনালিতে বাঁশের লাঠি ঢুকিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল দুর্বৃত্তরা। শত্রুতা ছিল ঘোড়ার মালিকের সঙ্গে, কিন্তু মারা যেতে হলো ঘোড়াটিকে। একইভাবে হত্যা করা হয়েছিল বগুড়ার কাহালুতে এবিসি টাইলস কারখানায় রাসেলকে ও রুবেলকে। খুলনায় শিশু রাকিব এবং নারায়ণগঞ্জে শিশু সাগর বর্মণকে একইভাবে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।
আমরা ভেবেছি এরকম ভয়াবহ ঘটনার জন্য চরম শাস্তি পাবে অপরাধী। কিন্তু না, অপরাধীরা শাস্তি পায় না বলে এইধরনের পৈশাচিক ঘটনা আবার ঘটেছে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই। চট্রগ্রামে এক কিশোরকে তার মালিক কাজে ভুল করার দায়ে পায়ুপথে লোহার রড ঢুকিয়ে শাস্তি দিয়েছে। অনুমতি ছাড়া আইসক্রিম খাওয়ায় পটুয়াখালির বাউফলে ৩ শিশুকে শিকলে বেঁধে নির্যাতন করেছে এক দোকানদার। সন্ধ্যার পর শিশুদের লাঠি ও লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করেন তিনি। ওই শিশুদের বয়স ৭, ৯ ও ১০ বছর। এগুলো শুধু ২/৪টি উদাহরণ। ঘটনার হার আরো অনেক বেশি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এই ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৩ মাসে হত্যার শিকার শিশুদের মধ্যে ৬ বছরের কম বয়সী শিশু ৩২টি, ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশু ২৬, ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী ৫৩ এবং বাকি ১৪টি শিশুর বয়স উল্লেখ ছিল না গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে। খুব বেশি উদ্বেগজনক খবর হচ্ছে আরও ২৭ শিশু আত্মহত্যা করেছে এই তিন মাসেই।
শিশু কেন নিজের জীবন নিজে কেড়ে নিতে চাইছে? শিশু আত্মহত্যা বা স্বেচ্ছামৃত্যু বিষয়টি কতটা বুঝে? যে বয়সে তার পাখির মতো উড়ে বেড়ানোর কথা, কলকল করে হাসার কথা, খলখল করে গল্প করার কথা, ঠিক সেই বয়সেই মাসে গড়ে ৯টি শিশু মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছে কেন? কী এমন দুঃখ, কষ্ট, চাপ, অতৃপ্তি তাদের তাড়া করে ফিরছে?
আশঙ্কাজনকভাবে গত কয়েক বছরে দেশে শিক্ষার্থী আত্মহত্যার হার বেড়েছে। বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন ২০২৩ এর জানুয়ারিতে সমীক্ষার প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে যে ২০২২ সালে ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এর মধ্যে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের ৪৪৬ জন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৬ জন শিক্ষার্থী। ২০২২ সালে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৩৭ জন স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। সমীক্ষাটি করতে দেশের দেড় শতাধিক জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা এবং অনলাইন পোর্টাল থেকে শিক্ষার্থীদের আত্মহননের যাবতীয় তথ্য নেয়া হয়েছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রী ৬৩ দশমিক ৯০ শতাংশ এবং ছাত্র ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ। শুধু স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রী ৬৫ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং ছাত্র ৩৪ দশমিক ৭০ শতাংশ।
আঁচল ফাউন্ডেশন বলছে, মান-অভিমানের বশে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে, এর হার ২৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ। তাদের বড় অংশেরই অভিমান ছিল পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। অন্য কারণের মধ্যে প্রেম অন্যতম। এছাড়া পারিবারিক কলহ, হতাশা, মানসিক সমস্যা, আর্থিক সমস্যা, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। আরো আছে আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়া, শিক্ষক দ্বারা অপমানিত হওয়া, মোবাইল গেম খেলতে বাধা দেয়া, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, মোবাইল ফোন ও মোটর সাইকেল কিনে না দেয়া ও পড়াশোনার চাপ ইত্যাদি কারণে শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট শাহরিনা ফেরদৌস এই জরিপ প্রসঙ্গে বলেছেন, “এ জরিপে দেখা যাচ্ছে ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহননের প্রবণতা অনেক বেশি। অর্থাৎ তারা বয়ঃসন্ধিকালের যে সময় পার করছে, এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের যতœ এবং সচেতনতা তৈরির বিকল্প নেই। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। বিশেষ করে পরিবার ও প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্বশীল হতে হবে।” কিন্তু আমরা দেখছি শিশুর জীবনে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সময় এই ‘বয়ঃসন্ধিকাল’ টা পরিবার, শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সমাজ সবার কাছেই উপেক্ষিত। শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবার মতো কেউ নেই।
পরিবার একবারও ভেবে দেখে না তার পরিবারের শিশুটি কী চাইছে, কী চাইছে না, সে কী বলতে চায়, করতে চায় ও পড়তে চায়। শিশুর ভালো লাগা মন্দ লাগার দিকটিতে নজর না দিয়ে বাবা-মা বা অভিভাবকদের যা ভালো লাগছে, তাই শিশুর উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে পরিবারের সাথে অভিমান করে। কাজেই শিশু কেন পরিবারের উপর অভিমান করছে সেই দিকটিতে আমাদের দৃষ্টি দেয়া অবশ্য কর্তব্য।
শিশু নির্যাতনের সংবাদে আমরা এমনই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি যে বছরের পর বছর প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারছে না। আমরা কেউ মাথা ঘামাই না শিশুর মানসিক ও শারীরিক অবস্থা নিয়ে। বিভিন্নকারণে শিশু পরিবারে ও সমাজে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত ও অবহেলিত হয়। যেমন বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ, পারিবারিক কলহ ও শত্রুতা, প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়, দারিদ্র্য, উচ্ছেদ, অভিবাসন শিশুকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে বেশি।
বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতন। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) নতুন একটি গবেষণার তথ্য বলছে, শুধু ঢাকা মহানগরে যত শিশু নির্যাতনের শিকার হয়, তার প্রায় ৭৬ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার। যারা পেডোফাইল তারা সবসময় শিশুর প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করে। সুযোগ পেলেই এরা মেয়েশিশু ও ছেলেশিশুর উপর নির্যাতন চালাতে পারে এবং চালিয়ে থাকে। তবে পেডোফাইল ছাড়াও অন্যরাও শিশুদের ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি করে।
যৌন হয়রানির শিকার শিশুরা পরবর্তী সময়ে খাবারে অরুচি, নিদ্রাহীনতা, আত্মগ্লানি, স্বাধীনভাবে চলাচল করতে না পারা, হতাশা, হীনমন্যতা, দুশ্চিন্তা, লজ্জা ও ভয়ের মতো মানসিক সমস্যায় ভোগে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তাদের মধ্যে প্রায় ৭৪ শতাংশ শিশু আপত্তিকর স্পর্শের শিকার হয়েছে। প্রায় ৩৪ শতাংশ শিশুকে জোর করে অশ্লীল জিনিস দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে, ২৮ শতাংশ শিশুকে যৌনাঙ্গ স্পর্শের মাধ্যমে নির্যাতন করা হয়েছে এবং প্রায় ২৪ শতাংশ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ন্যায়বিচারের পথে বাধা এবং নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারি কর্মকৌশলের দুর্বলতার কথা উঠে এসেছে গবেষণা প্রতিবেদনে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের গত চার বছরের (২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর) মামলা থেকে নির্যাতনের ২৫টি ঘটনার অভিযোগপত্র বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দেখা গেছে, ঢাকা শহরে ১৪ থেকে ১৬ বছরের শিশুরা সবচেয়ে বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে, এ হার ৫৩ শতাংশের বেশি। যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুদের মাত্র ৩৪ শতাংশ থানায় গেছে।
আপনার, আমার শিশুকে বাঁচানোর জন্য পথ খুঁজে বের করতে হবে। গুটিকতক শিশুর ভালো থাকা নিয়ে আমরা আহ্লাদিত হতে পারি কিন্তু আমাদের অধিকাংশ শিশু খুব খারাপ আছে। শিশু, অভিভাবক ও শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময় করার মাধ্যমে আমাদের দেখা দরকার যে বাড়িতে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কী কৌশল ব্যবহার করে শিশুদের নিরাপদ রাখা যায়। শিশুর সাথে কথা বলতে হবে, শিশুকে কথা বলতে দিতে হবে এবং তাদের কথা শুনতে হবে।
সামান্য প্রস্তুতি আর অল্প কিছু কৌশলের মাধ্যমে কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে আমরা শিশুদের সচেতন করে তুলতে পারি। শিশুদের নিরাপদে রাখতে হলে কিছু বিষয় নিয়ে শিশুদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। তবে চিন্তার বিষয় হলো এসব নিয়ে শিশুদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলা যেতে পারে, সে সম্পর্কে মা-বাবা কিংবা অভিভাবকদের জ্ঞানের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। শিক্ষকেরাও এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে অস্বস্তিবোধ করেন। শিশু যে নানাভাবে ভিক্টিম হচ্ছে, অভিভাবকরা মনেই করেন না যে এতে তাদের কোনো দায় আছে।
শিশুদের রক্ষা করার জন্য, শিশুদের প্রতি সহিংসতা, দুর্ব্যবহার, অবহেলা ও শোষণ রোধে এখনই একটি সমন্বিত জাতীয় শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। শুধু বক্তৃতা ও আলোচনা করে নয়, ভালোবেসে। শিশু বাঁচলে দেশ বাঁচবে। অন্যথায় যতো বড় পরিকল্পনাই গ্রহণ করেন না কেন, যতো বড় অবকাঠামো নির্মাণ করেন না কেন, যতো সূদূরপ্রসারী উন্নয়ন কাঠামো গ্রহণ করেন না কেন, সবই বৃথায় যাবে। কারণ সুবিধা পেয়ে বড় হওয়া গুটিকতক শিশু বিদেশে চলে যাচ্ছে।
সিংহভাগ শিশু যারা থেকে যাচ্ছে এই দেশে, এদের অধিকাংশই নানাভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়ে মানবেতরভাবে বড় হচ্ছে। এই শিশুদের নিয়ে বাংলাদেশ কোন স্বপ্ন দেখছে, আমি জানিনা। গাছের চারা শক্ত না হলে গাছ কি দাঁড়িয়ে থাকতে পারে?
২ এপ্রিল, ২০২৪
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।
এইচআর/ফারুক/এএসএম