মতামত

বুয়েটে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ অগ্রাধিকার পাক

দেশের একটি নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। গত কয়েকদিন ধরে এই প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা চলছে। এবারের ঘটনার সূত্রপাত ছাত্রলীগের সভাপতির বুয়েট ক্যাম্পাসে যাওয়া নিয়ে। গত ২৭ মার্চ রাতে ছাত্রলীগের সভাপতি ও দপ্তর সম্পাদকসহ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা বুয়েট ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার চত্বরে যান। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা, যিনি বুয়েটের শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় ২৯ মার্চ বিকালে বুয়েটের শহীদ মিনারের সামনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালকের (ডিএসডব্লিউ) কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিক্ষোভ করে।

Advertisement

তাদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিমালা লঙ্ঘন করে পুরকৌশল বিভাগের ২১তম ব্যাচের ছাত্র ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইমতিয়াজ হোসেন রাহিম রাব্বি ছাত্রলীগ নেতাদের ক্যাম্পাসে নিয়ে আসেন। ওইদিন রাতেই হলের সিট বাতিল করা হয় ইমতিয়াজের। এখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার স্থায়ী বহিষ্কারের দাবিতে আন্দোলন করছে শিক্ষার্থীরা। এর সঙ্গে নতুন করে তারা আরো ৪টি দাবি যুক্ত করেছে। মোট ৫ দফা দাবিতে তারা এখন আন্দোলন করছে। প্রতিবাদে টার্ম ফাইনাল পরীক্ষাসহ সব একাডেমিক কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে তারা।

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে শেরেবাংলা হলের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ নিহত হন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মীর হাতে। আবরার নিহত হওয়ার পর বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ ঘোষণা করে ছাত্রলীগ ও অন্যান্য সব গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হলেও সাম্প্রদায়িক ও উগ্রবাদী চিন্তার সংগঠনগুলো সক্রিয় বুয়েট ক্যাম্পাসে রয়েছে।

বুয়েটের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন শিক্ষার্থী মনে করেন, বুয়েটে একটি অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তচিন্তা ও গণতান্তিক রীতিনীতিতে বিশ্বাসীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সেখানে অবাধে চালানো হচ্ছে চিহ্নিত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির সাম্প্রদায়িক প্রচার-প্রচারণা। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণার পরও বুয়েটে ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখা গেলেও সেসবের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতে শোনা যায় না কোনো শিক্ষার্থীকে। এমনকি গত বছর টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে গ্রেপ্তার হওয়া ২৪ শিবিরকর্মীর বিরুদ্ধেও কোনো প্রতিবাদ করা হয়নি। অথচ ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা ক্যাম্পাসে আসায় প্রতিবাদ করা হচ্ছে। তারা মনে করছেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে যে আন্দোলন চলছে, তা প্রকৃতপক্ষে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নয়; এদের নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছে ছাত্রশিবির আর হিজবুত তাহরীর। তারাই মূলত ইন্ধন দিচ্ছে এই আন্দোলনে। অথচ হিজবুত তাহরীর একটি নিষিদ্ধ উগ্রপন্থী সংগঠন।

Advertisement

গত বছর টাঙ্গুয়ার হাওরে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে গিয়ে বুয়েটের যে ২৪ জন ছাত্র পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল। তারা এখন সবাই জামিনে আছে। জামিন পেয়েই এরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। বুয়েট মসজিদসহ বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে তারা বৈঠকও করেছে। এরাই মূলত সামনে ও পেছন থেকে বর্তমান আন্দোলনে উসকানি দিচ্ছে। ছাত্রলীগসহ অন্য প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর রাজনৈতিক কার্যক্রম না থাকায় এই মৌলবাদী ও নিষিদ্ধ সংগঠনগুলো কৌশলে ক্যাম্পাসে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা ক্যাম্পাসে আসায় তাদের আঁতে ঘা লেগেছে।

অন্যদিকে বুয়েটে সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে রুখতে সেখানে পুরোদমে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি চালুর দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। আন্দোলনের মাধ্যমেই দাবি আদায়ের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছ সংগঠনটি। ৩১ মার্চ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক প্রতিবাদ সমাবেশে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেছেন, বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা ‘অসাংবিধানিক’। আমরা সেখানে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতি চালুর দাবি জানাচ্ছি।

বুয়েট প্রশাসনের কাছে আমাদের আহ্বান অনতিবিলম্বে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি চালু করতে হবে। যে নিয়ম আপনারা শুরু করেছেন সেটি কালাকানুন, সেটি কালো আইন। বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের কোনো বিধি বা আইন নেই। যদি থেকেও থাকে সেটি সংবিধানবিরাধী। বুয়েট প্রশাসনকে আলটিমেটাম দিয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি বলেছেন, অনতিবিলম্বে ছাত্ররাজনীতি চালু করতে হবে। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে হবে। বুয়েট শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইমতিয়াজ হোসেন রাহিম রাব্বির সিট ফিরিয়ে দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের স্বাধীন মত প্রকাশের স্বাধীনতা বুয়েটই বন্ধ রেখেছে। সেখানে নিষিদ্ধ রাজনীতির চাষাবাদ হচ্ছে। ছাত্র রাজনীতির নেতিবাচক দিক রয়েছে। এখানে র্যাগিং, ‘ভাই’ ও গেস্টরুম কালচার রয়েছে। এটি পরিবর্তনের উপায় আরো ভালো রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা, রাজনীতি বন্ধ করা নয়। বুয়েটে ছাত্র রাজনীতির কাঠামো কেমন হবে তা শিক্ষার্থীরাই নির্ধারণ করবে। তবে সেখানে রাজনীতি থাকতে হবে।

 

যারা রাজনীতির সঙ্গে অপরাধকে গুলিয়ে ফেলছেন, তারা হয় সরল, না হয় মতলববাজ, না হয় অন্য মতলববাজদের উদ্দেশ্য সাধন করছেন। একটি দেশের ভালো বা মন্দ সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতি। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, আমাদের দেশসহ অনেক দেশে এখন চলছে মন্দ রাজনীতির জোয়ার। মন্দ রাজনীতি প্রতিস্থাপন করতে হবে সুস্থ রাজনীতি দিয়ে। সেখানে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি অসুস্থ প্রবণতারই বহিঃপ্রকাশ।

Advertisement

 

আমরা মনে করি, ছাত্রলীগের সভাপতি কোনো অযৌক্তিক বক্তব্য দেননি, অন্যায্য দাবি তুলে ধরেননি। রাজনীতি করা না-করা যে কারো মৌলিক অধিকার। জোর করে এই অধিকার হরণ করা অন্যায়। ছাত্ররাজনীতির নামে যদি গুণ্ডামি, চাঁদাবাজি বা অন্য কোনো নীতিগর্হিত কাজ হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। ছাত্ররাজনীতিকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলা কোনো ভালো সমাধান নয়।

বুয়েটের বিষয়টি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকেও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্ব দিয়েই ভাবতে হবে। এটা বুঝতে হবে যে বুয়েটে যারা ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে কথা বলছে তারা গণতান্ত্রিক শক্তি নয়। এরা সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী। এদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া ঠিক হবে না। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমও বলেছেন, বুয়েটে যারা ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে কথা বলে তারা গণতান্ত্রিক শক্তি নয়। এরা সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী শক্তি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি কখনোই এ ধরনের কথা বলতে পারে না। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো বুয়েটেও গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ দিতে হবে। এই সুযোগকে যদি কেউ বাধাগ্রস্ত করে সেটি হবে অগণতান্ত্রিক। দেশের ছাত্র ও যুব সমাজ কখনোই তা মেনে নেবে না।

ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের নামে বুয়েটে ছাত্রদের ঐতিহ্যবাহী ও গৌরবান্বিত ভূমিকা একটি গোষ্ঠী অস্বীকার করছে। এই বুয়েটের বহু শিক্ষক ও ছাত্র মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে জীবন দিয়েছিলেন। সেই বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের নামে বাংলাদেশের রাজনৈতিক গগনে গণতান্ত্রিক শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অবমাননা করা হচ্ছে। এক দেশে দুই আইন চলতে পারে না। সংবিধান দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি করার অধিকার দিয়েছে।

বুয়েটের শিক্ষার্থীদের একটি অংশেরও দাবি, সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগকে ব্যবহার করে ‘নিষিদ্ধ সংগঠন’ ক্যাম্পাসে স্বার্থ হাসিল করছে। বুয়েটের ঘটনা যে সরকারের মনোযোগে আছে তা স্পষ্ট হয়েছে সরকারের দায়িত্বশীল দুইজন মন্ত্রীর বক্তব্যে। তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে- বুয়েটে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে যে আন্দোলন হচ্ছে, তার পেছনে জঙ্গিবাদী কিংবা উগ্রবাদী গোষ্ঠীর ইন্ধন থাকতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে এমন অভিযোগও রয়েছে। সরকার বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বুয়েটের ঘটনায় তদন্ত চলছে। আমরা খতিয়ে দেখছি। সেখানে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার নামে বুয়েটকে একটা অপরাজনীতি ও জঙ্গিবাদের কারখানায় পরিণত করা হবে, এটা যাতে না হয় আমরা তদন্ত করে দেখছি। এ রকম কিছু পাওয়া গেলে সরকারকে অ্যাকশনে যেতে হবে। তিনি বলেন, বুয়েটে সেদিন কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না। আর আমি রাজনীতি করি বলে বুয়েটে যেতে পারব না- এটা কোন ধরনের আইন? কোন ধরনের নিয়ম?

বুয়েট ইস্যুতে দীর্ঘদিন ধরে নানা ঘটনায় জঙ্গিবাদী বা উগ্রবাদী মানসিকতার আলোচনা বারবার আসছে জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলও বলেছেন, বুয়েটের চলমান আন্দোলনে পেছন থেকে কেউ ইন্ধন দিচ্ছে কিনা, পেছন থেকে কেউ জঙ্গিবাদী কিংবা উগ্রবাদী মানসিকতার কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছে কিনা, সেটা অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ এই আলোচনাটা বারবার আসছে।

তিনি বলেন, কিছুদিন আগেও অনেকে অভিযোগ করেছেন কিছু জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী গোপনে সেখানে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এমন একটি আলোচনা ও সমালোচনা ছিল। সে বিষয়টি আমরা আরো গভীরভাবে তদন্ত করব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কাজ করবে। সেটা শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য নয়, সব প্রতিষ্ঠানে। পেছন থেকে কেউ ইঙ্গিত দিচ্ছে কিনা, পেছন থেকে জঙ্গিবাদী ও উগ্রবাদী মানসিকতার কেউ ইঙ্গিত দিচ্ছে কিনা, সেটা অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে।

আমরা আশা করবো, বুয়েটের শিক্ষার্থীরা, যারা মেধাবী হিসেবে পরিচিত, তারাও কোনো মহলের প্ররোচনায় না মেতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজার রাখতে নিজেদের স্বাধীন বিচারবুদ্ধি কাজে লাগিয়ে কাজ করবেন।

ছাত্র আন্দোলন বা ছাত্ররাজনীতি আর ছাত্ররাজনীতির নামে অপরাধ সংঘটিত করা এক হতে পারে না। রাজনীতি অধিকার। অধিকার বন্ধ করা আর অপরাধ বন্ধের দাবি কোনোভাবেই এক হতে পারে না। যারা অপরাধ-সন্ত্রাস আর ছাত্ররাজনীতিকে সমার্থক করছে তাদের রাষ্ট্র ও ভবিষ্যৎ জ্ঞান দুটোই বিপদজনক।

যারা রাজনীতির সঙ্গে অপরাধকে গুলিয়ে ফেলছেন, তারা হয় সরল, না হয় মতলববাজ, না হয় অন্য মতলববাজদের উদ্দেশ্য সাধন করছেন। একটি দেশের ভালো বা মন্দ সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতি। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, আমাদের দেশসহ অনেক দেশে এখন চলছে মন্দ রাজনীতির জোয়ার। মন্দ রাজনীতি প্রতিস্থাপন করতে হবে সুস্থ রাজনীতি দিয়ে। সেখানে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি অসুস্থ প্রবণতারই বহিঃপ্রকাশ।

০১ এপ্রিল, ২০২৪লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও চেয়ারম্যান, বিএফডিআর।

এইচআর/জিকেএস