‘বড় আশা করে সংসার পেতেছিলাম। কিন্তু স্ত্রী ও তার স্বজনরা আমাকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলেছে। বিয়ের দেড় মাস পর আমার কাছে থাকা টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে পালিয়েছে তারা। এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন- একাধিক ব্যক্তির ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করে আলোচনায় আসা শাহজাহান ভূঁইয়া জল্লাদ শাহজাহান।
Advertisement
ডাকাতি, হত্যা ও অস্ত্র মামলায় দীর্ঘ ৪৪ বছর কারাবাসের পর গত বছরের ১৮ জুন মুক্তি পান জল্লাদ শাহজাহান। জেলখানায় তিনি একাধিক ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন। জেলখানা থেকে বের হয়ে চায়ের দোকান করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এর মধ্যে একদিন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থেকে কোনাখোলা এলাকায় যাওয়ার পথে অটোরিকশায় একটি ভ্যানিটি ব্যাগ পান। ব্যাগের ভেতরে একটি কাগজে গ্রামীণফোনের নম্বর লেখা ছিল।
প্রকৃত মালিককে ব্যাগ ফেরত দেওয়ার জন্য তিনি ওই নম্বরে ফোন করলে সাথী আক্তার ফাতেমা নামে এক নারী রিসিভ করেন এবং ব্যাগটি তার বলে জানান। এরপর সাথীর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে শাহজাহানের। একপর্যায়ে গত ২১ ডিসেম্বর শাহজাহান ও সাথীর বিয়ে হয়। বিয়ের পরই তাদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি শুরু হয়। এর মধ্যে শাহজাহানের কাছ থেকে স্বর্ণালঙ্কারসহ ১৩ লাখ টাকা নিয়ে যায় সাথী। শুধু টাকা নিয়ে ক্ষান্ত হয়নি সে। শাহজাহানের বিরুদ্ধে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি যৌতুক আইনে ঢাকার আদালতে একটি মামলা করে সে। মামলাটি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানাকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন আদালত।
অন্যদিকে, শাহজাহান বাদী হয়ে রোববার (৩১ মার্চ) সাথীসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগে মামলা করেন। আদালত মামলাটি তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেন।
Advertisement
আক্ষেপ করে জল্লাদ শাহজাহান বলেন, ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক সাথী আক্তারকে বিয়ে করি। দেড় মাসও সংসার করা হলো না। সাথী আমাকে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে। তাদের কাউকে এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোন ফোন নম্বরেও তাদের পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, বড় আশা করে সংসার পেতেছিলাম। কিন্তু স্ত্রী ও তার স্বজনরা বিয়ের নামে প্রতারণার ফাঁদ ফেলে। বিয়ের দেড় মাস পর আমার কাছ থেকে নেওয়া ১০ লাখ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে পালিয়ে যায়। এর কয়েক দিন পর আদালতে গিয়ে আমার নামে উল্টো যৌতুকের মামলা করে। আমি আইনজীবীর পরামর্শে স্ত্রীসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। ন্যায়বিচার চাই। আদালতে ন্যায়বিচার পাবো বলে আশা করি।
শাহজাহানের আইনজীবী মো. ওসমান গনি বলেন, প্রতারণার অভিযোগে জল্লাদ শাহজাহান তার স্ত্রী ও শাশুড়িসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। আদালত বাদীর জবানবন্দি রেকর্ড করেন। পরে মামলাটি পিবিআইকে তদন্ত করে আগামী ২৭ জুন প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।
আরও পড়ুন
Advertisement
এদিকে যৌতুকের মামলায় সাথী আক্তারের দেওয়া মোবাইল নম্বরে ফোন করলে তার মামা পরিচয়ে দ্বীন ইসলাম নামে এক ব্যক্তি রিসিভ করেন। তিনি বলেন, সাথী আগে যে বাসায় থাকত এখন সেখানে থাকে না। আমিও তাকে খুঁজে পাচ্ছি না। পেলে কথা বলিয়ে দেবো।
জেলখানা থেকে বের হয়ে প্রায় ১৮ লাখ টাকা সাহায্য পেয়েছেন শাহজাহানশাহজাহানের করা মামলা থেকে জানা যায়, ৪৪ বছর কারাবাসের পর গত বছরের ১৮ জুন মুক্তি পান। বাদীর আত্মীয়স্বজন বা আপনজন বলতে কেউ নেই, এমনকি বসতভিটাও ছিল না। যার কারণে অসহায় বাদী ঢাকার বাবুবাজারে একটি হোটেলে কিছুদিন অবস্থান করেন। কারাগারে থাকাবস্থায় পরিচিত রাকিব নামের একজনের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। পরে রাকিবের কাছে তিনি তার অসহায়ত্বের বিস্তারিত বলেন। পরে রাকিব তার অফিসে ১৫ দিনের মতো থাকার ব্যবস্থা করেন। পরে রাকিবের সহায়তায় বাদী দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে দুই রুমের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন এবং চায়ের দোকান করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
বাদী কারাগার থেকে বের হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে ৫ লাখ টাকা অনুদান পান। টাকা নরসিংদীর সোনালী ব্যাংক লিমিটেড পলাশ শাখা থেকে উত্তোলন করেন। এছাড়া জেলখানায় থাকাবস্থায় যাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাদের অনেকেই তাকে আর্থিকভাবে সহায়তা করেন। সবমিলিয়ে তিনি আর্থিকভাবে প্রায় ১৮ লাখ টাকা সহায়তা পেয়েছিলেন।
বিয়ের আগেই শাহজাহানের যাবতীয় কাজকর্ম করে দেওয়া শুরু করেন সাথী ও তার মামামলার অভিযোগে শাহজাহান উল্লেখ করেন, সুসম্পর্কের একপর্যায়ে বাসায় আসা-যাওয়া শুরু করে একে-অপরে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সাথীর মা শাহিনুর বেগম তার সাংসারিক প্রয়োজনে বাদীর কাছ থেকে ৭০ হাজার টাকা ঋণ নেন। পরে শাহজাহানের ভাড়াবাসার নিচতলায় তারা বাসা নেন। এরপর থেকে শাহজাহানের বাসার যাবতীয় কাজকর্ম ও রান্নাবান্না শুরু করেন তারা এবং বাদী তাদের দুজনের সব বাজার করে দেন। তারা দুজনই বাদীর সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেন, যা দেখে বাদী মুগ্ধ হন। এরপর তারা সাংসারিক বিভিন্ন সমস্যার কথা বলে বাদীর কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে আরও ৮৭ হাজার টাকা নেন।
বিয়ের সময় ১০ লাখ টাকা দাবি করেন সাথী ও তার মাসম্পর্কের একপর্যায়ে শাহজাহানকে তারা মেয়ের বিয়ের বিষয়ে প্রস্তাব দেন। এরপর গত বছরের ২১ ডিসেম্বর ইসলামী শরিয়াহ মতে বিয়ে করেন। বিয়ের পরে স্ত্রী ও শাশুড়ি শাহজাহানের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে অনুদান পাওয়া ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। কিন্তু বাদী প্রথমে টাকা দিতে রাজি না হলেও জোরাজুরিতে রাজি হন। তবে এজন্য তিনি স্ত্রীর কাছ থেকে একটা অঙ্গীকারনামা নেন। তাতে উল্লেখ ছিল- ‘আমি অঙ্গীকারদাতা আপনার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নিলাম। আমি যদি কোনো কারণে বিয়ে বলবৎ রাখতে অপারগ হই, তবে এককালীন সব টাকা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবো।’
অঙ্গীকারনামায় আরও উল্লেখ করা হয়, আমি অঙ্গীকার করছি যে, আমার স্বামী আগামী চার মাসের মধ্যে আমার নামে দুই শতাংশ ভূমি হেবা করে দিলে, আমি উক্ত জমি যথাযথ হেফাজত করবো। আপনি অঙ্গীকার গ্রহীতার অনুমতি ব্যতীত ওই জমি হস্তান্তর বা বিক্রয় করবো না। আমি যদি কোনো কারণে অঙ্গীকারকারীর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে ব্যর্থ হই, তবে আপনি অঙ্গীকারগ্রহীতা বরাবর ওই জমি ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবো। আমি আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমি স্ত্রী হিসেবে আপনার সব আদেশ নিষেধ মেনে চলবো। আপনার অবাধ্য হবো না।
আরও পড়ুন
৩২ বছর কারাভোগ শেষে মুক্তি পাচ্ছেন ‘জল্লাদ শাহজাহান’ আসছে জল্লাদ শাহজাহানের আত্মজীবনীআমি শুধু টাকার জন্য বিয়ে করেছিমামলার অভিযোগে শাহজাহান আরও উল্লেখ করেন, বিয়ের পর থেকে সাথী ও তার মা শাহজাহানের সঙ্গে কারণে-অকারণে ঝগড়া শুরু করেন। স্ত্রী সাথী বাদীর সব আদেশ-নিষেধ অমান্য করা শুরু করেন। সারাদিন মোবাইল নিয়ে টিকটক করেন এবং বিভিন্ন ছেলে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন, দেখা করেন। একপর্যায়ে বাদী শাহজাহান স্ত্রীকে সন্তান নেওয়ার জন্য বললে সে সন্তান নেবেন না জানান। বলেন, আমি সন্তানের জন্য তোকে বিয়ে করিনি, শুধু টাকা আত্মসাতের জন্য বিয়ে করেছি। তোর টাকা শেষ হয়ে গেলে তোর সাথে আর ঘর-সংসার করবো না।’
শাহজাহান চাহিদা মোতাবেক বিভিন্ন সময়ে সোনার কানের দুল, আংটিসহ মোট ৩ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, একটি ১২ হাজার টাকা দামের মোবাইল ফোন ও ২ লাখ ১২ হাজার টাকার জিনিসপত্র স্ত্রীকে দেন। আর শাশুড়ি মোট ১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা ঋণ হিসেবে নেন। সবমিলিয়ে স্ত্রী ও শাশুড়ির কাছে বাদী শাহজাহানের ১৩ লাখ ৬৯ হাজার টাকা পাওনা। কিন্তু আসামিরা অঙ্গীকারনামার ১০ লাখ টাকাসহ সব টাকা ফেরত দিতে অস্বীকার করে জানায় যে, ওই টাকার বিষয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলে পরিণাম ভালো হবে না। পরে তারা সব মালামাল নিয়ে পালিয়ে যায়। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৬, ৪২০, ৫০৬ ও ১০৯ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
এদিকে যৌতুকের অভিযোগে জল্লাদ শাহজাহানের স্ত্রী মোছা. সাথী আক্তার ফাতেমা আদালতে স্বামীকে অভিযুক্ত করে একটি মামলা করেন।
মামলার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, আসামি শাহজাহানের সঙ্গে গত বছরের ২১ ডিসেম্বর পাঁচ লাখ টাকা দেনমোহরানায় বিয়ে হয় সাথীর। বিয়ের সময় স্বামী শাহজাহানের সংসারে উপঢৌকন হিসেবে টিভি, ফ্রিজ, খাট উপহার দেন। যার মূল্য এক লাখ টাকা। এছাড়া নগদ ৫০ হাজার টাকা ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র দেন। বিয়ের পর বাদিনীর দাম্পত্য জীবন কয়েকদিন সুখেই কাটে। এর কিছুদিন পর সংসারে অশান্তি শুরু হয়। কারণে-অকারণে আসামি শাহজাহান বাদিনীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন শুরু করেন।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ১২ ফেব্রুয়ারি আসামি শাহজাহান বাদিনীর কাছ ৩ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেন। বাদিনী যৌতুকের টাকা দিতে অস্বীকার করলে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেন এবং টাকা না দিলে খুন করে ফেলবেন বলে উদ্যত হলে বাদিনী ভয়ে চিৎকার করলে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে এলে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন আসামি। মামলায় ২০১৮ সনের যৌতুক নিরোধ আইনের ৩ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
জেএ/এমএএইচ/এমএস