মতামত

সাপের কামড়ে মৃত্যু ঠেকাতে রোগী ও স্বজনদের করণীয়

আমাদের দেশের বেশির ভাগ সাপ বিষহীন। অথচ সাপের কামড়ে প্রতি বছর দেশে প্রায় ৭ হাজার ৫০০ মানুষ মারা যায়। সংখ্যাটা নেহায়েত কম নয়। সাপের কামড়ে এতো মানুষ মারা যাওয়ার কারণ সাপের বিষ নয়, রোগী ও স্বজনদের অসচেতনতা। সাপে কামড়ালে কি করতে হবে সে বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞান না থাকার কারণে অধিকাংশ সাপে কাটা রোগী মারা যায়।

Advertisement

একটি ঘটনা বলছি তাহলে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে। ঘটনাটি ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসের। চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি মাদ্রাসার ছাত্রাবাসে ছাত্র ও শিক্ষক (হুজুর) ঘুমিয়েছিলেন। রাত ২টার দিকে একজনের ঘুম ভেঙ্গে যায়। তিনি মনে করেন তাঁকে কিছু একটা গলার পাশে কামড় দিয়েছে। তিনি আলো জ্বালান এবং অন্যদের ডাকেন। সবাই ওঠে দেখেন একটি সাপ ঘর থেকে জানালা দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। হইচই পড়ে যায়।

এমন সময় ওই রুমের অন্য একজনেরও খারাপ লাগা শুরু হয় এবং তার শরীরেও সাপের কামড়ের দাগ দেখা যায়। তাদের দুইজনকে ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ওঝা রোগীদের দেখে বলেন, বিষধর সাপ কামড় দিয়েছে, আমি চিকিৎসা দিতে পারবো না, আপানারা তাদের আরকেজন ওঝার কাছে নিয়ে যান। এরপর দ্বিতীয় ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া হলে ওই ওঝা ঝাড়ফুঁক করেন এবং রোগীদের বলেন, দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু এরই মধ্যে রোগীদের অবস্থা খারাপ হওয়া শুরু হয়। রোগীরা তৃতীয় আরেকজন ওঝার কাছে যান।

তৃতীয় ওঝা রোগীদের দেখে বিভিন্ন রকম ঝাড়ফুঁক করেন এবং নিশ্চিত করেন কোন সমস্যা হবে না। তাদের বাড়ি যেতে বলেন। এরপর সকাল হয়ে যায়। রোগীরা সুস্থ বোধ না করায় বাড়ি যেতে ভয় পাচ্ছিলেন। দ্রুত দুজনের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। ততোক্ষণে তাদের হুঁশ হয়, সকাল ৯টায় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই একজন রোগী মারা যান।

Advertisement

দ্বিতীয়জন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পৌঁছালে কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা করে দেখেন রোগীর শরীরে বিষক্রিয়া হয়েছে এবং রোগীর শ্বাস-তন্ত্র কাজ করছে না। রোগীর অনেক শাস-কষ্ট হচ্ছিল। রোগীকে দ্রুত লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার পরামর্শ দেন। রোগীকে অক্সিজেন দিয়ে দ্রুত রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন তিনি। কিন্তু রোগী রাজশাহী মেডিকেলে পৌঁছানোর আগে পথেই মারা যান।

ঘটনাটি বলার কারণ হলো-এই দুজন মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী রোগী ও তার স্বজনদের অসচেতনতা। সাপে কামড়ানোর পর ৭ ঘণ্টারও বেশি সময় এই দুজন রোগী সুস্থ ছিলেন এবং হাসপাতালে না গিয়ে তিনজন ওঝার পিছনে ঘুরে সময় নষ্ট করেছেন। তারা ঠিকই হাসপাতালে গেছেন কিন্তু শেষ সময়ে। ততোক্ষণে বিষ তাদের শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। সাপ যখন তাদের কামড় দিয়েছিল ঠিক তখনি তারা যদি ওঝার কাছে না গিয়ে হাসপাতালে আসতেন তাহলে এ দুজনকে হয়তো বাঁচানো যেতো।

সাপের কামড়ে যারা মারা যান তারা সাধারণত কর্মক্ষম এবং পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি হয়ে থাকেন। একটু সচেতন হলে এসব মৃত্যু আমরা ঠেকাতে পারি।

সাপ কামড়ানোর ঘটনাগুলো যেমন হয়১. মাঠে মাছ ধরতে গিয়ে সাপে কামড় দেয়।২. বর্ষার সময় চারিদিকে যখন পানি থাকে তখন সাপ শুকনো জায়গার জন্য বাসার ভেতরে আশ্রয় নেয়। সাধারনত খড়ি রাখার জায়গায়, বিছানা, রান্না ঘর, আলনা, খড়ের গাদা ইত্যাদিতে আশ্রয় নেয়। এসব জায়গায় অন্ধকারে/শব্দহীনভাবে গেলে সাপ কামড়ানোর ঝুঁকি অনেক থাকে।৩. রাতের বেলা অন্ধকারে রাস্তায় চলার সময় সাপ কামড়ায়। কারণ সাপ সাধারণত রাতের বেশি চলাচল করে।৪. মুরগী বা হাঁসের ঘরে সাপ ডিম বা মুরগীর বাচ্চা খেতে আসে। তখন সেখানে কোনো মানুষ গেলে সাপ কামড় দেয়।৫. গরমের সময় বারান্দায় বা উঠানে ঘুমানোর সময় সাপ মানুষকে কামড়ায়।

Advertisement

সাপ কামড়ালে করণীয়১. আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। কারণ আমাদের দেশে বিষাক্ত সাপের সংখ্যা কম। আর বিষাক্ত সাপ কামড়ালেও শরীরে বিষক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ৫০ ভাগ।২. যে জায়গায় সাপ কামড় দিয়েছে সে জায়গাটা নাড়ানো যাবে না। পাতলা গামছা বা শাড়ির কাটা অংশ দিয়ে লুস করে বেঁধে যেতে পারে। কামড়ানো স্থান নড়াচড়া করলে বিষ দ্রুত শরীরে ছড়িয়ে পড়বে।৩. রোগীকে ওঝার কাছে নেওয়া যাবে না, ঝাড়ফুক করা যাবে না, কবিরাজি চিকিৎসা করানো যাবে না। সাপ কাটার জায়গা ব্লেড দিয়ে কেটে ফেলা যাবে না।৪. রোগীকে যতো দ্রুত সম্ভব হাসাপাতালে নিতে হবে। হাসপাতালে নেওয়ার সময় মোবাইলে বা যে কোনো মাধ্যমে খোঁজ নিতে হবে ওই হাঁসপাতালে সাপের বিষ নিষ্ক্রিয় করার ওষুধ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে কিনা। যে হাসপাতালে এই ওষুধ আছে সেই হাসপাতালে যেতে হবে তাহলে সময় নষ্ট হবে না, রোগী দ্রুত চিকিৎসা পাবে।৫. রোগীকে সাপ কামড়ানোর সময় থেকে ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কারণ সাধারনত সাপ কামড়ানোর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শরীরে বিষক্রিয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে বিষক্রিয়ার কোন লক্ষণ না হলে আর ভয়ের কোন কারণ নেই।

ওঝার ঝারফুঁকে কিছু রোগী ভালো হয় যে কারণে-

আগেই বলেছি, আমাদের দেশের বেশির ভাগ সাপ হলো অবিষাক্ত। তাই যেসব মানুষকে অবিষাক্ত সাপ কামড় দেয় অথবা বিষাক্ত সাপ কামড় দিয়েছে কিন্ত শরীরে সাপের বিষক্রিয়া হয় নাই, তাদের কোনো চিকিৎসা দরকার হয় না। অর্থ্যাৎ তারা এমনি ভালো হয়ে যান। এসব রোগী এমনি সুস্থ হয় কিন্তু নাম হয় কবিরাজের ঝাড়ফুঁকের। যেসব সাপে কাটা রোগীর শরীরে বিষক্রিয়া হয়, তাদের বিষ নিষ্ক্রিয় করার ওষুধ না দিলে মৃত্যু অবধারিত। তাই সাপে কামড় দিলে রোগী ও স্বজনদের প্রথম কাজ দ্রুত নিকটস্থ হাতপাতালে যাওয়া। এই একটি সচেতনতাই সাপে কামড়ানো অনেক রোগীকে বাঁচাতে পারে। তাই আমাদের সকলের এ বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, প্রাইম মেডিকেল কলেজপ্রতিষ্ঠাতা- ডাক্তারখানা (জিপি সেন্টার)।

এইচআর/এমএস