রাজনীতি

ফেসবুক পেজের দখল নিয়ে দ্বন্দ্বে ঢাবির সাবেক ছাত্র অধিকারের নেতারা

ছাত্র অধিকার পরিষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ফেসবুক পেজের নাম পরিবর্তন করে বানানো হয়েছে মিডিয়া পেজ। কাজটি করেছেন সাবেক ছাত্র অধিকার পরিষদের একাংশের নেতাকর্মীরা। সংগঠনটির আরেক অংশ একে বলছে ‘দখল’। এ নিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছেন সংগঠনটির ঢাবি শাখার সাবেক নেতাকর্মীরা। এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে দোষারোপ করে ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছে। ব্যক্তিগত নানান বিষয়ে তুলছেন অভিযোগ।

Advertisement

সার্বিক বিষয়ে একপক্ষ বলছে, পেজের সব কন্টেন্ট মুছে ফেলা তাদের আন্দোলনের ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা। আরেক পক্ষ বলছে, ঢাবিতে ছাত্র অধিকার পরিষদ এখন নেই। ফলে এর পেজও থাকতে পারে না।

গত বছরের ২৩ জুলাই ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে লেজুড়বৃত্তি, অনিয়মসহ বেশ কিছু অভিযোগ এনে একযোগে পদত্যাগ করেন সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতাকর্মীরা। পরবর্তীসময়ে তাদের কয়েকজন মিলে একই বছরের ৪ অক্টোবর ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি’ নামে নতুন সংগঠন করেন। এর আগে পর্যন্ত ঢাবি শাখা ছাত্র অধিকার পরিষদের ‘ছাত্র অধিকার পরিষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে একটি ফেসবুক পেজ ছিল যার অনুসারী ছিল ২ লাখ ৫০ হাজার। এর মাধ্যমে তারা তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়ন, শিক্ষার্থী নির্যাতনের ডকুমেন্টেশনসহ বিভিন্ন কাজ করতেন। সম্প্রতি ওই পেজটির নাম পরিবর্তন করে করা হয়েছে ‘সার্বক্ষণিক’। এ নিয়ে এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের বিরুদ্ধে সমালোচনা করতে গিয়ে নিয়ে আসছেন বিভিন্ন ব্যক্তিগত বিষয়। করছেন পাল্টাপাল্টি অভিযোগ।

এ নিয়ে ঢাবি ছাত্র অধিকার পরিষদের সাবেক নেতা সালেহ উদ্দিন সিফাত অভিযোগ করেন, ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পেজটি দখল করে ব্যক্তিগত মিডিয়া পেজে পরিণত করা হয়েছে। কাজটি করেছেন সংগঠনের ঢাবির সাবেক নেতা আসিফ মাহমুদ ও আহনাফ সাঈদ খান। তাদের সমর্থন দিচ্ছেন এবং পৃষ্ঠপোষকতা করছেন ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন। যদিও এটা অনেকের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল। আমাদের কয়েকজনের কাছে প্রত্যাশিতই ছিল। ঢাবির সাবেক সাহিত্য সম্পাদক জাহিদ ঘটনার দিন রাতে আখতার হোসেনকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি উল্টো জাহিদকে চার্জ করেন এবং বোঝান যে, ক্যাম্পাসে যেহেতু পরিষদের কোনো উত্তরসূরি নেই, সেহেতু পেজটি মিডিয়ায় পরিণত করা সমস্যা নয়।

Advertisement

আরও পড়ুন

ছাত্র অধিকার পরিষদ সভাপতি বিন ইয়ামিন রিমান্ডে একযোগে পদত্যাগ করলেন ঢাবি ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতারা

সিফাত বলেন, আমরা পরবর্তী সময়ে পেজটি পূর্বাবস্থায় ফেরত দেওয়ার জন্য নানান ভাবে আহ্বান জানাই। কিন্তু এতে তারা থোড়াই কেয়ার করেন। আমি বর্তমানে কোনো রাজনীতির সঙ্গে নেই, কেবল প্র্যাকটিসেই (আইন) সময় দিচ্ছি। যেহেতু আখতার হোসেন এবং আসিফ মাহমুদ দুজনই ছাত্রশক্তি নামে একটি নতুন ছাত্র সংগঠনের যথাক্রমে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও ঢাবি সভাপতি। ফলে আমি ও আকরাম হোসাইন বিষয়টি ছাত্রশক্তির সেক্রেটারিকে অবহিত করি। তিনিও একটি সংগঠনের পেজ ব্যক্তিগত মিডিয়ায় পরিণত করাকে অন্যায্য মনে করেন এবং বিষয়টি নিয়ে অভিযুক্তদের সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানান। তবে সে ‘কথা বলার’ ফলাফল আমরা এখনো দেখছি না।

তিনি বলেন, আমি ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাবির সদস্য ছিলাম। সংগঠন ছেড়েছি, কিন্তু তার অর্থ অতীতের সাংগঠনিক কার্যক্রমকে অসম্মান করা নয়। অন্যদের সাংগঠনিক কার্যক্রম বা এক্টিভিজমকে ব্যক্তিস্বার্থে মুছে দেওয়া তো দূরের কথা! একটি সংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তরসূরি থাকুক বা না থাকুক, সেটা কোনোভাবেই সংগঠনটির সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেল থেকে সব ডকুমেন্টস মুছে দিয়ে নিজস্বার্থে ব্যবহার করাকে জাস্টিফাই করে না।

পেজের কর্মকাণ্ড নিয়ে সিফাত বলেন, অভিযুক্তদের এ ধরনের যুক্তি চূড়ান্তভাবে অযৌক্তিক। এ পেজ থেকে আমরা গেস্টরুম নির্যাতকদের নাম, ঠিকানা, হলের নামসহ পোস্ট করতাম। ফলে তারা কেবল একটা সংগঠনের পেজকেই মুছে দেননি, দীর্ঘ চার বছরের রাজনৈতিক ফুটপ্রিন্ট, এক্টিভিজমকে দর্পভরে মুছেছেন। অথচ এ ব্যাপারে কারও সঙ্গে কোনো পরামর্শ করেননি। তারা চাইলে পরিষদের কাছে পেজটি হস্তান্তর অথবা পেজটি ইনট্যাক্ট আর্কাইভ হিসেবে রেখে দিতে পারতেন। কিন্তু তারা করলেন ঠিক উল্টো।

Advertisement

অভিযোগের ব্যাপারে আসিফ মাহমুদ বলেন, পরিষদ ডেড (মৃত) ইস্যু। গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন এবং নীতিগত অবস্থান থেকে বিচ্যুত হওয়ায় সর্বশেষ ঢাবি কমিটির সবাই পদত্যাগের মাধ্যমে পরিষদের সমাপ্তি ঘোষণা করি। পরিষদ বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। ঢাবি পরিষদের নামে চলা পেজটি পরিষদের কার্যপরিধির অনলাইন সংস্করণ ছিল। বাস্তবে পরিষদ না থাকায় অনলাইনে এর কোনো কার্যক্রমও চলার বাস্তবতা নেই। স্মৃতি সংরক্ষণ এর বাইপ্রোডাক্ট মাত্র। মূল কাজ ছিল পরিষদের আপডেট দেওয়া। বিস্ময়করভাবে এতদিন পরে এসে এ বিষয়ে দু-একজনকে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে, যারা সর্বশেষ ঢাবি পরিষদের সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিল না। সর্বশেষ কমিটিতে পদের আকাঙ্ক্ষা এবং না পাওয়ার ক্ষোভ থেকেই দুরভিসন্ধিমূলক অনেক কথা ছড়ানোর চেষ্টা অনেক আগে থেকেই ছিল। স্মৃতি হাতিয়ার করে তাদের আলাপও এরই অংশ।

এ নিয়ে কথা বলতে চাইলে আহনাফ সাঈদ খান ফোন রিসিভ করেননি। তবে শনিবার (৩০ মার্চ) একটি ফেসবুক পোস্টে সালেহ উদ্দিন সিফাতের বিরুদ্ধে উল্টো পরিষদের একটি সহযোগী সংস্থা কুক্ষিগত করে রাখা ও ছাত্রলীগের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ তোলেন আহনাফ সাঈদ খান।

তিনি লিখেছেন, যে সংস্থার হয়ে কাজ করতে গিয়ে, যে সংগঠনের হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিলাম, সন্ত্রাসীদের আক্রমণের শিকার হয়ে ব্রেইন স্ট্রোকের আশঙ্কায় পড়েছিলাম, যে আঘাতের যন্ত্রণায় আজও রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না, সে সংস্থা একজন সম্পূর্ণ ব্যক্তি স্বার্থে কুক্ষিগত করে রেখেছে।

আরও পড়ুন

টিএসসিতে ছাত্রলীগ-ছাত্র অধিকার পরিষদের সংঘর্ষ ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি ও তার বাবাকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ

‘আর্তমানবতার স্বার্থে, মানবিক অধিকার রক্ষার স্বার্থে, ছাত্র অধিকার পরিষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছায়া সংগঠন হিসেবে SAT-Students Against Torture প্রতিষ্ঠা করা হয়। অথচ কিছুদিন পরই এটি সালেহ উদ্দিন সিফাতের পকেটবন্দি হয়। সারাদিন ফ্যাসিবাদের তসবি জপলেও ভেতরে ভেতরে প্রতি প্রোগ্রামের আগে ছাত্রলীগের সঙ্গে কানেকশন মেন্টেইন করা সালেহ উদ্দিন সিফাত নিজ সংগঠনেই ছিল গণতন্ত্রবিরোধী। ২০২৩ সালে ঢাবি শাখার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে কাঙ্ক্ষিত পদে নির্বাচিত হতে পারার ব্যাপারে সন্দিহান থাকায় সে নির্বাচন বানচালে হেন কোনো অপচেষ্টা নেই যা সে করেনি।’

তিনি আরও লিখেছেন, এমনকি সিফাত অ্যান্ড টু আদার্স গং নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে নির্বাচনের ব্যালট চুরি করে। নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করলে সিফাত আমাকে তার প্যানেল থেকে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচন করার আহ্বান জানালেও সে আহ্বানে আমি সাড়া দেইনি। পরবর্তীসময়ে সে নিজের পছন্দ অনুযায়ী শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিজের পাশে না পাওয়ায় নিজেকে সরাসরি সভাপতি হিসেবে দেখতে চেয়ে সংগঠনের সাবেকদের সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করে, অতঃপর ব্যর্থ হয়। রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলায় সম্মুখে না এসে, প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের আদতে ঘৃণ্য কূটচালে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়ে পরিষদের রানিং ঢাবি কমিটি থাকা অবস্থায় স্যাটকে তার পকেটবন্দি করে। অথচ স্যাট গঠনের সময় কথা ছিল ঢাবি পরিষদের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং স্যাটের গভর্নিং বডি স্যাটের সব নীতি নির্ধারণ করবে।

অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে আখতার হোসেন বলেন, আমি মনে করি, নীতিগতভাবে পরিষদ আর এক্সিস্ট করে না। নীতিগতভাবে যে পরিষদ এক্সিস্ট-ই করে না, তার নামে আর কোনো কিছু কন্টিনিউ হবে, এটা অবৈধ। এখনো যারা পরিষদের নামে অনেক বিষয় চালাচ্ছেন, পরিষদের নামে যা কিছু হচ্ছে সেসব কিছুও অবৈধ। সে জায়গা থেকে আমি মনে করি, যারা সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটিতে ছিল, তারা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত ছিল।

তিনি বলেন, এখন যেটি চলছে সেটি জোরপূর্বক কিছু লোকের সম্মিলন মাত্র। তাও যদি বলি, সেখানেও দ্বিধাবিভক্তি রয়েছে। এখানে আমার নাম জড়িয়ে যদি কেউ বক্তব্য দেয় তাহলে সেটি পরিষদের পদ নির্বাচনের সময় অযোগ্যতার কারণে পদে আসতে না পারার ক্ষোভ থেকে এটি করেছেন।

এ ব্যাপারে দলের অবস্থান জানতে চাইলে ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, প্রথমত, ছাত্র অধিকার পরিষদ নেই, এটা অবাস্তব একটা কথা। দ্বিতীয়ত আমাদের পেজটি নতুন নয়। এটি ডাকসু নির্বাচনের পর থেকেই ছিল। এ পেজে আমাদের সবারই কন্ট্রিবিউশন আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যত আন্দোলন সংগ্রাম, ছাত্র আন্দোলনের স্মৃতি রয়েছে সেসব কিছুর রাজনৈতিক স্মৃতি এ পেজটি বহন করছিল। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পেজটি গুরুত্ব বহন করছিল। হঠাৎ করে পেজের সবকিছু নাই করে দিয়ে পেজের নাম পরিবর্তন রাজনৈতিক ইতিহাস মুছে ফেলার একটা চেষ্টা। অতীতের এ আন্দোলনের স্মৃতিগুলোই ভবিষ্যৎ আন্দোলনের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। এ ইতিহাস মুছে ফেলার জন্য তাদের দিয়ে কোনো একটি মহল কাজ করাচ্ছে।

হাসান আলী/এমএইচআর/এসএইচএস/জেআইএম