ফিচার

তারুণ্যের চোখে স্বাধীনতা: ছবিতে বলা গল্প

ফারজানা অনন্যা

Advertisement

‘স্বাধীনতা তুমি/ বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর/ শাণিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ।/ স্বাধীনতা তুমি/ চা-খানায় আর মাঠে-ময়দানে ঝোড়ো সংলাপ।/ স্বাধীনতা তুমি/ কালবোশেখীর দিগন্তজোড়া মত্ত ঝাপটা।’ (স্বাধীনতা তুমি, শামসুর রাহমান) তপ্ত ঝাঁঝালো দুপুরে ক্লান্তি মুছে কবি শামসুর রাহমানের কবিতার এই পঙ্ক্তিমালাকে কণ্ঠে ও হৃদয়ে ধারণ করেছিল গ্রীন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীরা! স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে তরুণ শিক্ষার্থীদের মাঝে স্বাধীনতার চেতনাকে আরও সজীব ও জীবন্ত করে তোলার অভিপ্রায়ে আয়োজন করা হয় ‘স্বাধীনতার ধারণা, প্রত্যাশা, প্রাপ্তি ও অর্জন বিষয়ক আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতা’।

দুপুর ১টার দিকে প্রদর্শনীটি উন্মুক্ত করা হয় সাধারণ শিক্ষার্থীসহ সবার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. খাজা ইফতেখার উদ্দিন আহমেদের পৃষ্ঠপোষকতা এবং ভাষা ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্রের পরিচালক ড. সিরাজুম মুনিরা ও বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ের শিক্ষকদের উদ্যোগে এ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। মূল প্রতিপাদ্য ছিলো ‘তারুণ্যের চোখে স্বাধীনতা: ছবিতে বলা গল্প’। আমাদের চারপাশে স্বাধীনতার যে অসংখ্য উপাদান ছড়ানো, প্রতিদিন স্বাধীনতার অসংখ্য সুবিধাপ্রাপ্তির দ্বারা আমাদের এই জীবন নির্বাহ কিংবা স্বাধীনতার ৫৪ বছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে অর্জন-প্রাপ্তির নিকেষ—তারুণ্যের চেতনায় আলোকচিত্রের গল্পে গল্পে উপলব্ধি করা।

আর্ট পেপারের ওপর শিক্ষার্থীরা তাদের যাপিত জীবনের স্থিরচিত্রের দ্বারা উপস্থাপন করেছে স্বাধীনতার নানা অনুষঙ্গ। প্রতিটি দলে পাঁচজন সদস্য তাদের নির্বাচিত দুটি করে আলোকচিত্র জমা দিতে পেরেছেন। প্রতিটি দেয়ালিকাতে দশ থেকে বারোটি করে আলোকচিত্র ছিল। অনুষ্ঠানটিতে প্রায় শতাধিক দল অংশগ্রহণ করেছে। অসংখ্য দেয়ালিকায় ২১ মার্চ সকাল থেকেই রঙিন ছিল ইউনিভার্সিটির প্রশাসনিক ভবনের নিচতলা।

Advertisement

যাপিত জীবনের প্রতিটি সাধারণ উপাদানকে শিক্ষার্থীরা কতটা সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে স্বাধীনতার চেতনার সাথে সংযুক্ত করেছে, তা আমাকে চমৎকৃত করেছে। যেমন সিএসই বিভাগের এক শিক্ষার্থী তার দেয়ালিকাতে রেখেছিলেন আসাদ গেটের ছবি, ছিল জনারণ্য এক রাস্তায় এক ছোট্ট শিশুর চঞ্চল পদক্ষেপের আলোকচিত্র। আলোকচিত্রের বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যা তার কাছে জানতে চাইলে সাজ্জাদ মাহমুদ নামের ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘যখন আমাদের জানানো হয়েছিল একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে এবং যেখানে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধি আলোকচিত্রের দ্বারা উপস্থাপিত করতে হবে। আমার সহপাঠীরা অনেকেই তখন বুঝতে পারছিল না মুক্তিযুদ্ধের ছবি এই সময়ে আমরা কীভাবে পেতে পারি! কিন্তু আমার মোটেও মনে হয়নি এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য আমাকে জাদুঘরে বা ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে গিয়ে ছবি তুলতে হবে। আমার কাছে এই যে সবুজ ঘাসের বুকে ফোটা লাল জবা, এটাও একটা স্বাধীনতার প্রতীক। আমাদের স্বাধীন পতাকার রং! আসাদ গেট ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং ছাত্র আন্দোলনকে নির্দেশ করে। প্রায়ই এই রাস্তা দিয়ে আমাকে বাসে যাতায়াত করতে হয়। প্রতিদিনই এখান থেকে আসার সময় আমার মনে এক অন্যরকম শক্তি কাজ করে। এক প্রতিবাদী সত্তার নামে এই রাস্তার নাম। স্বাধীনতার চেতনা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে আমাদের চলার পথে। আমার দেয়ালিকাতে এই যে ছোট্ট শিশুটি নির্ভয়ে রাস্তায় হাঁটছে। এটাও এক ধরনের স্বাধীনতার অর্থ বহন করছে। হুমায়ূন আহমেদের ‘অনিল বাগচীর একদিন’ উপন্যাসটিতে সম্ভবত পড়েছিলাম, যুদ্ধ চলাকালীন প্রায় নয় মাস রাস্তায় ছোট্ট বাচ্চাদের তেমন দেখা যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফিরতে হুট করে এই বাচ্চাটাকে দেখে মনে হলো এর চলার মাঝেই এর অন্যরকম নির্ভীকতা কাজ করছে। সে স্বাধীন দেশের নাগরিক। সে অনুভূতি থেকেই এ ছবিটি তোলা।’

আরও পড়ুন

২৫ মার্চ, বাঙালির ইতিহাসের কালো অধ্যায়  গণহত্যা-মুক্তিযুদ্ধের নীরব সাক্ষী জবির গুচ্ছ ভাস্কর্য 

সমাজবিজ্ঞান বিভাগের মেহেদি হাসান নামের এক শিক্ষার্থীর দেয়ালিকায় চোখ আটকে গেল। পোস্টারজুড়ে এক রিকশাশ্রমিকের প্রাণখোলা হাসি। এই আলোকচিত্রের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘এই মানুষটির কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম, মামা, ‘স্বাধীনতা কী?’ উনি প্রথমে বুঝতে পারেননি। পরে বললেন, ‘মামা সারাদিন রিকশ্যা খাটনের পর এই যে বাংলায় গলা খুইল্লা গান গাই। এই যে ভাতের লগে ডাইল মিশায়া মাছ দিয়া খাই—এই অধিকারটাই আমার কাছে স্বাধীনতা। উর্দুতে কথা কইয়া, রুটি-গোশত খাইয়া আর পাঞ্জাবি পইরা রিকশা চালানো আমার দ্বারা হইতো না।’ আমার কাছে মনে হয়ে নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে পূর্ণ বাঙালি হিসেবে এই মানুষটা যে তার আচার-আচরণ ও জীবন-যাপনের স্বাধীনতা পাচ্ছেন, প্রাণখুলে হাসতে পারছেন—এটাই স্বাধীনতা। এর থেকে স্বাধীনতার অর্থবহ কোনো প্রতীক আমার কাছে নেই।’

আলোকচিত্র প্রদর্শনীর পাশাপাশি ছিল কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতা। সেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের স্বরচিত এবং মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিষয়ক আবৃত্তির দ্বারা পুরো সময়টিকে দর্শনার্থীদের কাছে করে তুলেছে উপভোগ্য। অনুষ্ঠানটি পরিদর্শন করেন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. খাজা ইফতেখার উদ্দিন আহমেদ, রেজিস্ট্রার ক্যাপ্টেন (নৌবাহিনী) শেখ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন (এলপিআর) এবং বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের ডীন অধ্যাপক ড. মো. সাইফুল আজাদ, বিভিন্ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, অসংখ্য শিক্ষক এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা। প্রতিযোগিতায় অংশ্রগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা ভিসিকে তাদের আলোকচিত্রগুলো ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। সব বিভাগের শিক্ষার্থী এসে দেয়ালিকাগুলো উচ্ছ্বাস ভরে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। প্রতিযোগিতার প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তিনটি গ্রুপের জন্য পুরস্কার হিসেবে রাখা হয়েছে বিপুল পরিমাণ বই এবং সেরা দশটি গ্রুপকে সনদ প্রদান করা হয়।

Advertisement

ড. সিরাজুম মুনিরা বলেন, ‘ভাষা ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্রের আমরা সব শিক্ষক বদ্ধপরিকর, তরুণ শক্তি অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের তাদের শেকড় এবং আত্মপরিচয় সম্পর্কে জানতে সাহায্য করতে। আমাদের দেশের তরুণদের মধ্যে আমি প্রায়ই দেখতে পাই নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি কিংবা নিজ জাতির সংগ্রাম সম্পর্কে এক ধরনের উন্নাসিক ধারণা তারা পোষণ করে। আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সে ধরনের ধারণা যেন না থাকে। সে উদ্দেশ্যে প্রায়ই নানা সাংস্কৃতিক ও আত্মপরিচয়মূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কিছুদিন আগেই আমরা ‘আঞ্চলিক ভাষার লড়াই: আমার জেলাই সেরা’ শিরোনামে প্রতিযোগিতা এবং ‘বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য প্রদর্শনী’ শিরোনামে দুটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। তরুণরা যেন মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি স্তরকে জানতে ও উপলব্ধি করতে পারে, সে উদ্দেশ্যে এবারের অনুষ্ঠানের আয়োজন। প্রতি বছরই নতুন কিছু করার প্রচেষ্টা থাকে আমাদের।’

লেখক: প্রভাষক, ভাষা ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র, গ্রীন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।

এসইউ/জিকেএস