‘অসাম্প্রদায়িক’ এবং ‘সাম্প্রদায়িক’ শব্দটি বিংশশতাব্দীতে এসে বহুল প্রচলিত শব্দ হিসেবে প্রচারিত। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বা পরবর্তীতে এ শব্দ দুটির সাথে সাধারণ মানুষের এত বেশি সখ্য ছিল না। মানুষ খুব বেশি ধর্ম ভীরু ছিল তখনকার দিনে। ধর্ম পালন করা হতো ঘরে ঘরে। তখন মানুষ অনুশাসিত হতো ধর্ম এবং সামাজিক আচার-ব্যবহারের অনুশাসনে।
Advertisement
সমাজের মানুষ শিক্ষিত ছিল কম, কিন্তু শিক্ষা ছিল ব্যাপক। প্রতিটি বাড়িতে একজন করে মোড়ল বা মাতুব্বর বা অভিভাবক থাকতেন। পরিবারের বাইরে কোনো শাসন, পরামর্শ বা উপদেশ নিতে যেমন তাঁর কাছে যেত। তেমনি তিনিও বাড়ির সকল পরিবারের সদস্যদের জন্য একটি অলিখিত নিয়ম জারি করে দিতেন। ঠিক তেমনি বাড়ির বাইরে গ্রামে থাকতেন গ্রাম প্রধান বা চেয়ারম্যান।
আদালতের আইন বা সংবিধানিক আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা কম ছিল। মুখে মুখে প্রচলিত আইন এবং আদর্শ নিয়ে বেড়ে উঠতো। সমাজে-সংসারে-রাষ্ট্রের অধিকার সম্পর্কে কম জানা মানুষগুলো খুব কমই অন্যের অধিকার কেড়ে নিয়েছে তখন। নারী-পুরুষ তার নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। তবে সংসারের সকল সদস্যদের প্রতি কর্তব্যে ছিল ষোল আনা। ঠিক তেমনি প্রতিবেশিদের সঙ্গে সমোঝোতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ছিল অনেক।
ধর্মীয় অনুশাসনে বেড়ে ওঠা বাড়ির বয়ঃজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির কঠোর নিয়মে পরিবারে বড় হতে থাকতো ছোটরা। বাড়ির ছাত্র-ছাত্রীদের বন্ধু-বান্ধবী বাড়িতে এলে আপ্যায়নে ত্রুটি হতো না। ধর্মীয় গোড়ামি ছিল তবে ভেদাভেদ ছিল না। অন্য ধর্মের বন্ধু-বান্ধবীরা বাড়িতে এলে রান্না ঘর এবং ঠাকুর ঘরে প্রবেশে ছিল নিষিদ্ধ। তাই বলে ঠাকুরের প্রসাদ এবং সুস্বাদু রান্না করা খাবারে কোনো নিষেধ ছিল না। অনেক বাড়িতে ভিন্ন ধর্মের মানুষ বাড়িতে প্রবশ করলে গঙ্গা জল ছিটিয়ে পবিত্র করা হতো। তাই বলে বাড়িতে আসা নিষিদ্ধ ছিল না।
Advertisement
ঠিক তেমনি বাড়িতে মুরুব্বিরা নামাজে দাঁড়ালে সেখানে যাওয়া নিষেধ ছিল। এমনকি কথা বলাও নিষেধ ছিল। তবে নামাজ শেষে মুরুব্বিরা কাছে এসে দোয়া পড়ে মাথায় ফুঁ দিতে কোন নিষেধ ছিল না। শুক্রবারে কারো বাড়িতে গেলে বাড়ির পুরুষরা বাড়ি ফিরতেন জুম্মার জিলিপি হাতে। সেখান থেকে জিলিপি হাতে দিতেন হাসি মুখে। এছাড়া সবেবরাতের বিকেলে চালের রুটি, মুরগীর মাংস এবং হরেক রকমের হালুয়া খাওয়ার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়ার সুযোগ ছিল না। প্রতিবছর রোজার এক মাস স্কুল ছুটি থাকতো। বন্ধুরা বাড়িতে এলে তাদের নিয়ে ইফতারি হতো না এমন ঘটনা বিরল। এছাড়াও পাড়া-প্রতিবেশির বাড়ি বাহারী ইফতারি পাঠানোর রেওয়াজ ছিল। হোক সে নিজ ধর্ম বা ভিন্ন ধর্মের মানুষ। তাই বলে লুকিয়ে নিষিদ্ধ খাবার খাইয়ে জাত খোয়ানোর বাহাদুরি ছিল না।
দিন অনেক বদলে গেছে। জানিনা কি করে বর্তমান সময়ে শিশু বয়স থেকে মানুষের মধ্যে ধর্মের অস্পৃশ্যতা পোক্ত হয়ে যাচ্ছে। নিজ ধর্মের মানুষ ছাড়া আপন হয় না এবিষয়ে খুব বেশি জ্ঞান বেড়েছে। এমনকি নিজ ধর্ম নিয়ে খুব বেশি সচেতনতাও বেড়েছে। ধর্ম পালনে নতুন নতুন ফতোয়া যেমন বেড়েছে, তেমনি ধর্ম অবমাননা বিষয়েও বেশ মনোযাগী হয়ে উঠেছে বর্তমান প্রজন্ম। এরা নিজ নিজ অধিকার সম্পর্কে যত বেশি সচেতন হচ্ছে, তত বেশি কর্তব্যশূন্য হয়ে পড়ছে।
বড়দের সম্মান করা এবং ছোটদের স্নেহ করা এখন অতীত ঘটনা। বর্তমান প্রজন্ম অধিকাংশই মৌলিক পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। পরিবারের প্রধান এবং আর্থিক উৎসদাতা বাবা-মা ছাড়া আর কাউকে স্বীকার করে না। পরিবারের বাইরে কারো কোন উপদেশ বা কর্তব্য নিয়ে কথা বলতে গেলে তাদের চোখে বিস্ময়। বিষয়টা এমন যেন, তোমার খাই না পরি, তুমি বলার কে? এই বাক্যটি যেদিন থেকে এদের মাথায় ঢুকে গেছে সেদিন থেকে সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং নৈতিকতার অবক্ষয় শুরু হয়েছে।
বাড়ির বড়রা বা অভিভাবকদের সামনে সাহস ছিল না অন্যায় করার। অনেক সময় এমন হয়েছে বাবা-মাকে না জানিয়ে অন্য কেউ শাসন করতে পারতো। সে বিষয়টি জেনে বাবা-মা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতেন। এটা একধরনের ভালবাসা বা অধিকার বলে মনে করতেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে বাড়ির অন্য কেউ তো দূরের কথা পরিবারের আপন কাকা, মামা পর্যন্ত শাসনের ক্ষমতা রাখে না। এমনকি স্কুলের শিক্ষকেরও সেই অধিকার নেই। নিজ ধর্মের হলে বলা হয় সামাজিক শত্রুতা, অন্য ধর্মের শিক্ষক হলে, বলবে সাম্প্রদায়িক শত্রুতা থেকে এ কাজ করেছে।
Advertisement
এছাড়া রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের প্রতি তীব্র ঘৃণা এবং ক্ষোভ প্রকাশ। প্রতিবছর পূজা এলে ঘুরে ফিরে কমন সংবাদ প্রকাশ হতে দেখা যায়, প্রতীমা ভাঙ্গচুর, মন্দির নির্মাণে বাধা দেয়া এমনকি পূজা করার জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া। প্রতিটি পূজার জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট তিথি, নক্ষত্র। পূজা তো কখনো নির্দিষ্ট সময়ে হতে পারে না। সেই অসহনীয় কাজটাই করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
কয়েকবছর ধরে খুব বেশি দেখা যাচ্ছে, রোজা এলে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা স্ট্যাটাস লিখছেন রোজা ছিলাম, রোজা শেষে ইফতারী করলাম। রোজা রাখা মানে না খেয়ে থাকা নয়। রোজা রাখতে হলে তারাবী পড়তে হয়। তারাবী নামাজে প্রতিজ্ঞা করা হয় পরদিন সততার সাথে সংযম পালন করা হবে। আবার স্বরস্বতী পূজা বা দুর্গা পূজার সময় অনেক ভিন্নধর্মাবলম্বীরা শাঁখা-সিঁদুর পরে লাল-সাদা শাড়ী পরে মন্দিরে গিয়ে ছবি তোলে। অনেকে পূজাও করে। আমার দুটোতেই আপত্তি আছে।
কেউ যদি মনে করেন ধর্ম বদলে ফেললে মানুষ তার ভেতরের সৌন্দর্য বদলে ফেলতে পারে। তাহলে তা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। মানবিক গুণাবলী প্রকাশ করতে ধর্মের প্রয়োজন হয় না। বরং আপনার মানবিক সৌন্দর্য আপনার ধর্মকে মহিমান্বিত করে। অন্যের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং শ্রদ্ধা বাড়িয়ে দেয়। নিজের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন, তবেই অন্যরা আপনার ধর্মকে শ্রদ্ধা করবে। এবং আপনিও ঠিক অন্য ধর্মকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতে পারবেন।
মন্দিরে যেতে যেমন হিন্দু সাজতে হয় না, তেমনি ইফতারি খেতে রোজা রাখতে হয় না। নিজে যে ধর্ম পালন করছেন সেখানেও যা যা বলা হয়েছে, অন্যরা যে ধর্ম পালন করছে সেখানেও একই কথা বলা হয়েছে। মূল বিষয় সততা। অনেকে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে, অন্য ধর্ম গ্রহণ করে। এতে তার মহিমা কি? যদি আপনি সত্যি ধর্ম পালন করতে চান তাহলে কোন ধর্মই ত্যাগ বা গ্রহন করার প্রয়োজনীয়তা পড়ে না। ধর্ম আপনার নিজের মধ্যে প্রথমে ধারণ করতে হবে।
আমি নাস্তিক নই। তবে ধর্মীয় গোড়ামীও নেই। যারা ধর্ম ত্যাগ করার কথা বলেন, তারা প্রকৃত পক্ষে আত্মতৃপ্ত নয়। যে বা যিনি আত্মতৃপ্ত নয়, তিনি কোন কিছুতেই তৃপ্ত হবেন না, ধর্মেই হোক বা কর্মেই হোক। যে ব্যক্তি প্রকৃত ধার্মীক তিনি কখনোই নিজের ধর্মকে মহান এবং অন্য ধর্মকে হেয় করে কথা বলবে না। প্রথমে নিজ ধর্মকে ভালবাসতে শিখুন, তবেই না অন্য ধর্মের প্রতি ভালবাসা, শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা আসবে। আবার অনেকে নিজ ধর্মকে ছোট করে অন্য ধর্মকে মহান বলে নিজেকে সমাজের চোখে অসাম্প্রদায়িক হওয়ার মিথ্যা চেষ্টা করেন। শুধু ধর্মই নয়, কোনো কিছু বা কোনো ব্যক্তিকে ছোট করে নিজেকে কখনোই মহান হওয়া যায় না।
গত কয়েকদিন আগে বেইলীরোড ট্রাজেডিতে জানা যায় বৃষ্টি খাতুন নামে এক মুসলিম নারী অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামে রাজধানীতে বসবাস শুরু করেন। তিনি নিজেকে অনাথ পরিচয়ে সকল ধরনের সুযোগ নিয়েছেন। মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে সমালোচনা করা ঠিক নয়। তবে সমাজের অন্য সকলের সুবিধার্থে বা জানার সুবিধার্থে বলতেই হচ্ছে। এক মনোস্তত্ত্ববিদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ছোটবেলায় হিন্দু শিক্ষকের কাছে প্রভাবিত হয়েছেন। অথচ এই একই শিক্ষকের কাছে মেয়েটির বাবা-মা এবং অন্য দুইবোন পড়ালেখা করেছেন। শুধু তাই নয় ওই গ্রামের বোধ করি অধিকাংশ মানুষ পড়েছেন। মেয়েটির ব্যক্তিগত কর্মফলের দায় হিন্দু শিক্ষককে দেয়া হচ্ছে। সকল নিউজ এবং তথ্য-উপাথ্যের ভিত্তিতে বলা যায় মেয়েটি ধর্মের প্রতি ভালবেসে নয়, সুবিধাভোগের জন্য এই ধর্ম পরিবর্তন এবং নিজের বাবা-মা, পরিবারকে অস্বীকার করেছেন। ধর্মকে আশ্রয় করে সুবিধা ভোগ না করে ধর্মতে আশ্রিত হয়ে নিজেকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখাই হচ্ছে ধার্মিকের লক্ষ্য।
ধর্মের আলাদা কোনো সঙ্গা নেই। ধর্ম মূলত তিনটি স্বম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে। সত্য, প্রেম এবং ক্ষমা এই তিনটি বিষয়ে যিনি মেনে চলেন তিনি ধার্মিক। যুগে যুগ যারা আমাদের বিজ্ঞানের আলো দেখিয়েছেন তারা কেউই নাস্তিক ছিলেন না। প্রতিটি সাফল্যের পর তারা সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। অথচ সেই বিজ্ঞানের সুফল যারা ভোগ করছেন তারা সৃষ্টিকর্তাকে মানেন না। আধুনিকতার এ এক জটিল রহস্য।
অধিকাংশ আধুনিক মানুষ মনে করে ধর্ম বলে কিছুই নাই। মানুষ বিভিন্ন বর্ণ, অবয়ব কাঠামো নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। আমরা চাইলেই সেগুলো অস্বীকার করতে পারি না। তবে সেগুলো সমতা এসেছে কার কর্মের মাধ্যমে। দেখতে কুৎসিত কোন ব্যক্তি অনেক গুনীব্যক্তি হতে পারেন। আবার অপূর্ব সৌন্দর্যের অধিকারী কেউ মূর্খ হতে পারেন। ঠিক তেমনি জন্মের পরে পরিবার বা মা-বাবার কাছ থেকে মানুষ কোনো এক ধর্ম পেয়ে থাকেন।
কেউ যদি মনে করেন ধর্ম বদলে ফেললে মানুষ তার ভেতরের সৌন্দর্য বদলে ফেলতে পারে। তাহলে তা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। মানবিক গুণাবলী প্রকাশ করতে ধর্মের প্রয়োজন হয় না। বরং আপনার মানবিক সৌন্দর্য আপনার ধর্মকে মহিমান্বিত করে। অন্যের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং শ্রদ্ধা বাড়িয়ে দেয়। নিজের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন, তবেই অন্যরা আপনার ধর্মকে শ্রদ্ধা করবে। এবং আপনিও ঠিক অন্য ধর্মকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতে পারবেন।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/জিকেএস