জাতীয়

দৃশ্যদূষণে শ্রীহীন রাজধানী

ঠিক কবে আকাশ দেখেছেন, এমন প্রশ্নে রাজধানীবাসীর অনেকেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যান। কেউ কেউ বলবেন আকাশ দেখার সুযোগ কোথায়? বাস্তবতাও তাই। এক ভবনের গা ঘেঁষে আরেক ভবন গড়ে ওঠায় খোলা আকাশের দেখা পান না ফ্ল্যাট বাসার বাসিন্দারা। বাইরে বের হলেই তারের জঞ্জাল আর বিলবোর্ড-দেওয়ালের দৃষ্টিকটু বিজ্ঞাপনের ভিড়ে উপরে তাকানো দায়।

Advertisement

মূলত বায়ুদূষণ, শব্দদূষণের মতো রাজধানী ও বড় শহরগুলোর নাগরিকদের ভোগান্তির অন্যতম কারণ দৃশ্যদূষণ। বর্তমানে মানুষ এ দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে অবগত না থাকলেও প্রতিনিয়ত শিকার এ দূষণের। শহরের রাস্তায় ঝোলানো তারের জঞ্জাল, বিলবোর্ডের রঙিন আলো আর দেওয়ালে থাকা দৃষ্টিকটু পোস্টার দৃশ্যদূষণের অন্যতম কারণ। এ দূষণের প্রভাবে একদিকে দেখা দিচ্ছে চোখের সমস্যা, অন্যদিকে মানসিক সমস্যার শিকার হচ্ছে নগরবাসী।

 

মানুষ সাধারণত গাছপালা, পাহাড়-সমুদ্র, আকাশ-নক্ষত্রের দিকে দীর্ঘসময় তাকিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু শহরে সেই অবস্থা নেই। বিশেষ করে ঢাকায় বিজ্ঞাপন ও পোস্টারিংয়ে কোনো নিয়মের বালাই নেই। যত্রতত্র বিলবোর্ড নগরীর সৌন্দর্য নষ্ট করছে। এসব দৃশ্যই এখন দূষণে পরিণত হয়েছে।

 

রাজধানীর প্রায় সব রাস্তাঘাট ছেয়ে আছে বিলবোর্ড, দৃষ্টিকটু ব্যানার-পোস্টার-প্ল্যাকার্ড আর দেওয়াল লিখনে। একই সঙ্গে বিদ্যুতের পিলারে তারের জঞ্জাল। সরকারি হোক বা বেসরকারি- কোনো স্থাপনা বাদ নেই এসব থেকে। এর সঙ্গে রয়েছে নামে-বেনামে রাজনৈতিক নেতাদের ছবি সম্বলিত পোস্টার।

Advertisement

পরিবেশবিদরা বলছেন, প্রকৃতির বাইরে কোনো কিছুই আমাদের মস্তিষ্ক গ্রহণ করতে চায় না। মানুষ সাধারণত গাছপালা, পাহাড়-সমুদ্র, আকাশ-নক্ষত্রের দিকে দীর্ঘসময় তাকিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু শহরে সেই অবস্থা নেই। বিশেষ করে ঢাকায় বিজ্ঞাপন, পোস্টারিংয়ে কোনো নিয়মের বালাই নেই। যত্রতত্র বিলবোর্ড নগরীর সৌন্দর্য নষ্ট করছে। পথচারীরা এসবের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না। এসব দৃশ্যই এখন দূষণে পরিণত হয়েছে। এ দূষণ থেকে বাঁচতে শহরের সৌন্দর্যবর্ধন ও সবুজায়নে গুরুত্ব দিচ্ছেন পরিবেশবিদরা।

এ বিষয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাধারণ সম্পাদক মেজবাহ উদ্দীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘পৃথিবীর বহু দেশে বিলবোর্ড-ব্যানারে বিজ্ঞাপনের প্রচলন আছে। কিন্তু আমাদের দেশে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে রাস্তাঘাটে, দেওয়ালে অযাচিত বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। ফলে কেউ রাস্তায় বের হলেই উঁচু ভবনের ভিড়ে এসব দেখতে হচ্ছে। আমাদের শহরেও সুন্দর সুন্দর অনেক স্থাপনা আছে, তবে বড় বড় বিলবোর্ড, বিজ্ঞাপন আর ব্যানার-পোস্টারের ভিড়ে সেগুলো আমরা দেখতে পাই না।’

আরও পড়ুন

রাজধানীতে ‘তারের জট’, বিদ্যুৎ-ব্রডব্যান্ডকে সমন্বয়ের দাবি  প্রকল্পে ধীরগতি, ঢাকায় বিদ্যুতের তারের জঞ্জাল নিরসন কতদূর?  তারের জঞ্জালে ম্লান হওয়া সৌন্দর্য ফেরাতে চান চসিক মেয়র 

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, যত্রতত্র বিলবোর্ড, রাস্তার পাশে পিলারে তারের জঞ্জাল, দেওয়ালে দেওয়ালে দৃষ্টিকটু পোস্টার, এমনকি গণপরিবহনও ঢেকেছে বিজ্ঞাপনে। রাজধানীর কারওয়ান বাজার, বিজয় সরণি, সায়েন্সল্যাব, ফার্মগেটসহ বিভিন্ন এলাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়কের পাশে বিলবোর্ডে দেখা যায় সরকারি বেসরকারি সংস্থার বিজ্ঞাপন।

Advertisement

এছাড়া লোকাল বাস থেকে শুরু করে বাসাবাড়ি, অফিসের দেওয়াল ছেয়ে আছে অশ্লীল ভাষা ও অঙ্গভঙ্গি সম্বলিত হারবাল এবং কবিরাজি পণ্যের বিজ্ঞাপনে। এসব দৃশ্য দেখে দেখে বিরক্ত নগরবাসী। এর ক্ষতিকর প্রভাব না জানলেও এসব বিষয়ে রয়েছে সবারই অভিযোগ।

রাজধানীর মালিবাগে কথা হয় একটি এনজিও সংস্থা অ্যাডভোকেসি অফিসার রবিউল আলমের সঙ্গে। জাগো নিউজকে রবিউল বলেন, ‘রাস্তায় বের হলে এখন যানজটের পাশাপাশি পোস্টার আর বিজ্ঞাপন দেখতে দেখতে ক্লান্ত। নগরীর সৌন্দর্য চোখে পড়ছে না। বাচ্চাদের নিয়ে বের হলে তারা দেওয়ালে, পিলারে লাগানো দৃষ্টিকটু বিজ্ঞাপন, পোস্টার দেখছে-পড়ছে। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে এসব বিজ্ঞাপনে জেনে না জেনে অপরাধে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এ অবস্থায় জনগণকে সচেতন করার পাশাপাশি এসব ব্যানার-পোস্টার উচ্ছেদে প্রশাসনকে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে।’

 

দৃশ্যদূষণ সম্পর্কে জনগণের জ্ঞান খুবই কম, একই সঙ্গে রয়েছে জনসচেনতার অভাব। প্রায় ৯৫ শতাংশ নগরবাসীর এ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। বিলবোর্ড, বিদ্যুতের খুঁটিতে তারের জঞ্জাল, বিদ্যুৎ বিতরণ নেটওয়ার্ক, কুয়াশা ও গ্রাফিতি ভিজ্যুয়াল পলিউশনের উদাহরণ।

 

বিলবোর্ডের রঙিন আলোয় গাড়ি চালকরা সমস্যায় পড়ছেন বলে জানান পাঠাও রাইডার মৃদুল। রাজধানীর কারওয়ান বাজার মোড়ে কথা হয় মৃদুলের সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘এই মোড়ে এলে চারপাশ থেকে আলোর ঝলকানি চোখে এসে পড়ে। এরপর হঠাৎ তীব্র আলো নিভে যাওয়ার পর অন্ধকারে সবকিছু গুলিয়ে ফেলি মাঝেমধ্যে। এতে চোখের সমস্যা হওয়ার পাশাপাশি দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দৃশ্যদূষণ সম্পর্কে জনগণের জ্ঞান খুবই কম, একই সঙ্গে রয়েছে জনসচেনতার অভাব। প্রায় ৯৫ শতাংশ নগরবাসীর এ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। বিলবোর্ড, বিদ্যুতের খুঁটিতে তারের জঞ্জাল, বিদ্যুৎ বিতরণ নেটওয়ার্ক, কুয়াশা ও গ্রাফিতি ভিজ্যুয়াল পলিউশনের উদাহরণ। জনগণকে সৌন্দর্য উপভোগে বাধা দেয় এগুলো। ভিজ্যুয়াল পলিউশনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও আবাসভূমি নষ্ট হওয়ার কারণে বাস্তুসংস্থানের ক্ষতি হচ্ছে। এতে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে নগরবাসী।

পরিবেশ এবং সমাজ উন্নয়ন সংস্থা- এসডোর করা ‘ভিজ্যুয়াল পলিউশন ইন দ্য সিটি অব ঢাকা অ্যা পাবলিক হেলথ, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ট্রাফিক ডিসট্রাকশন’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ভিজ্যুয়াল পলিউশনের কারণে ২৪ শতাংশ মানুষ চোখের সমস্যায় ভুগছে, যার মধ্যে শিশুরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। ভিজ্যুয়াল পলিউশনের কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ৪০ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৯ সালে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ২২৭ জন, যা বেড়ে ২০২২ সালে হয়েছে ৮ হাজার ৮০০ জন। ভিজ্যুয়াল পলিউশনকে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ওভারটেকিং, বেপরোয়া ও মাতাল হয়ে গাড়ি চালানো।

দৃষ্টিনন্দন গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে ঢাকার ফ্লাইওভারগুলোতে

এসডোর মহাসচিব এবং স্টাডি টিম লিডার ড. শাহরিয়ার হোসেন জানান, ভিজ্যুয়াল পলিউশনের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে বিলবোর্ড, তার ও বিদ্যুতের খুঁটি, কুয়াশা, অতিরিক্ত ট্রাফিক সাইন, আবর্জনা বা আবর্জনার স্তূপ, শহুরে গ্রাফিতি, অতিরিক্ত আলো বা নিয়ন সাইন দূষণ, ডিজিটাল বিলবোর্ড ইত্যাদি, যা সাধারণ জনগণের পরিবেশগত সমস্যা সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচয়স্বরূপ।

তবে বিলবোর্ড, পোস্টারের বিজ্ঞাপন উচ্ছেদ অভিযান চলমান থাকলেও সেটি কমছে না বলে জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কাইজার মো. ফারাবি। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘অবৈধ পোস্টার, ব্যানার, বিলবোর্ডের বিপক্ষে প্রায়ই আমরা উচ্ছেদ অভিযান চালাই। আমাদের দুজন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়মিত অভিযানে যাচ্ছেন। ঢাকায় আইনের এত ব্যত্যয় হচ্ছে যে সবাইকে শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। একদিন অভিযান চললে এক সপ্তাহ পর আগের মতো হয়ে যায়। এক্ষেত্রে দরকার সমন্বিত প্রচেষ্টা। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সবাইকেই আইন মানতে হবে।’

আরও পড়ুন

পোস্টারে শ্রীহীন নগরের দেওয়াল  উড়ালসড়কের খুঁটিতে পোস্টার লাগানো বন্ধে দৃষ্টিনন্দন গ্রাফিতি  এবার মহাখালী ফ্লাইওভারে নজরকাড়া গ্রাফিতি 

দেওয়ালে পোস্টার লাগানো বন্ধে বিভিন্ন সময়ে সংবাদপত্রে গণবিজ্ঞপ্তি দিচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। গণবিজ্ঞপ্তিতে নগর কর্তৃপক্ষ বলছে, দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো নিয়ন্ত্রণে আইন রয়েছে। দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১২ অনুসরণের জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানান। কেউ বিধি লঙ্ঘন করলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হচ্ছে।

 

শহরের বিভিন্ন জায়গায় পরিকল্পনা ছাড়াই বিলবোর্ড লাগানো হচ্ছে, এগুলোতে জ্বলছে নানান রঙের আলো। এসব আলো সরাসরি সড়কের পথচারী ও গাড়িচালকদের চোখে পড়ে, রিফ্লেকশন হয়। ফলে খুব সহজে এটা গাড়িচালকদের সমস্যা তৈরি করতে পারে।

 

এসব দৃশ্যদূষণ বন্ধে নগর কর্তৃপক্ষের উল্লেখযোগ্য কাজ না থাকলেও সৌন্দর্যবর্ধনে গুরুত্ব দিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভারের পিলারে আঁকা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন গ্রাফিতি। গত বছরের ১০ এপ্রিল দৃষ্টিনন্দন এসব চিত্রকর্মের উদ্বোধনকালে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, শহরে যত্রতত্র পোস্টার লাগিয়ে আমরা নিজেরাই দৃশ্যদূষণ করছি। এতে আমাদের দৃষ্টির সমস্যা হচ্ছে। আমরা সিটি করপোরেশন থেকে পোস্টার-ব্যানারে ভরা অসুন্দর পিলার দৃষ্টিনন্দন করার উদ্যোগ নিয়েছি।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক ও স্থাপত্য পরিবেশবিদ সজল চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘দৃশ্যদূষণ এখন চরম পর্যায়ে চলে গেছে। তবে দৃশ্যদূষণ ও আলোক দূষণ নিয়ে আমাদের দেশে তেমন কোনো ধারণা নেই। শহরের বিভিন্ন জায়গায় পরিকল্পনা ছাড়াই বিলবোর্ড লাগানো হচ্ছে, এগুলোতে জ্বলছে বিভিন্ন রঙের আলো। এসব আলো সরাসরি সড়কের পথচারী ও গাড়িচালকদের চোখে পড়ে, রিফ্লেকশন হয়। ফলে খুব সহজে এটা গাড়িচালকদের সমস্যা তৈরি করতে পারে। আবার এসব বিলবোর্ডে সবসময় বিভিন্ন বিজ্ঞাপন চলে, অনেক সময় রাস্তায় গাড়িচালকরা সেদিকে তাকিয়ে থাকার কারণে তাদের মনোযোগ নষ্ট হয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। যত্রতত্র এসব বিলবোর্ডের আলো মানসিক সমস্যা তৈরি করছে, আমাদের মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলছে। এমনকি আমাদের হরমোন নিঃসরণ ব্যাহত হচ্ছে।

দৃশ্যদূষণের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডা. সৈয়দ ওয়াদুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘সহজাতভাবেই আমরা খোলা আকাশ দেখতে চাই। চোখ ও মস্তিষ্কের সুস্থতার জন্য সবুজ দেখার পরামর্শ দেই আমরা। কিন্তু শহরের এমন পরিস্থিতি, যেদিকে তাকাই উঁচু ভবন, যত্রতত্র দেওয়াল লিখন, অযাচিত পোস্টার। মানুষ বেশিক্ষণ এসবের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে না। এক্ষেত্রে প্রতিদিন পার্ক, খোলা জায়গায় হাঁটাচলা করা জরুরি।’

আরএএস/কেএসআর/জিকেএস