শিক্ষা

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট, বেসরকারিতে ভরসা খণ্ডকালীন

দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্যমতে, বর্তমানে ৫৩টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। পাশাপাশি ১১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে।

Advertisement

দেশে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান বাড়লেও শিক্ষা ও গবেষণার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে। খোদ ১৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক নেই। শিক্ষক সংকটে ভুগছে এমন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪২টি। প্রথম সারির পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মানছে না শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আন্তর্জাতিক মানদণ্ড।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ৪৯তম বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। তবে সেখানে ১১টি সরকারি ও ১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কোনো তথ্যই প্রকাশ করেনি ইউজিসি।

আমাদের বেশ কিছু বিভাগে শিক্ষক সংকট রয়েছে। সংকট নিরসনে শূন্যপদ অনুযায়ী নিয়োগের চেষ্টা চলছে। দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।- বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশীদ

Advertisement

উচ্চশিক্ষার তদারককারী প্রতিষ্ঠানটি বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মান হলো ন্যূনতম প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন করে শিক্ষক থাকতে হবে। অর্থাৎ শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত হতে হবে ১:২০ বা তার কম।

শিক্ষক সংকটে ১৬ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ইউজিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বিভিন্ন কলেজ ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণকারী তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ও রয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতের আন্তর্জাতিক মান নেই। ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই প্রতিবেদনে।

বাকি ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে সবচেয়ে পিছিয়ে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি ৩৮ জন শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে একজন শিক্ষক। দ্বিতীয় অবস্থানে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৩৭। এরপরই রয়েছে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৩৫।

এছাড়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৩৪, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ১:২৯, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ১:২৪, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ১:২৬, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ১:২৪, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ১:২৩, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস ১:২২, গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১.৩৪, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় ১:২১, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় ১:৩২, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি ১:২৪।

Advertisement

তথ্য নেই যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনার শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পিরোজপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যা ও অনুপাত সংক্রান্ত কোনো তথ্যই নেই ইউজিসির কাছে।

আরও পড়ুন

‘গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই এখন নৈতিকতা বিবর্জিত’ ‘পরীক্ষা’ ফিরলেও থাকছে না নম্বর, প্রশ্নপত্র হবে নতুন ধাঁচে সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থায় কোথায় যেন ভুল থেকে যাচ্ছে

জানতে চাইলে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের বেশ কিছু বিভাগে শিক্ষক সংকট রয়েছে। সংকট নিরসনে শূন্যপদ অনুযায়ী নিয়োগের চেষ্টা চলছে। দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।’

বেসরকারিতে ভরসা খণ্ডকালীন শিক্ষকশিক্ষার্থীর অনুপাতে দেশের ৪২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নেই। এছাড়া ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যা জানেই না ইউজিসি। পাশাপাশি প্রায় সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত শিক্ষকের চেয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকই বেশি। ৪৯তম বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে এমন চিত্র দেখা যায়।

শিক্ষক সংকট থাকতে পারে। সেটা কাটিয়ে ওঠা দরকার। তারচেয়েও বেশি দরকার দক্ষ, যোগ্য ও মানবিক গুণাবলির শিক্ষক। তেমন শিক্ষক তরুণদের মধ্য থেকে কতজন উঠে আসছেন, সেটা দেখা জরুরি। রাজনৈতিক নেতৃত্বের বলয়ে এখন শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে। কোন মাপকাঠিতে তাদের নিয়োগ করছি, সেটা নিয়োগ বোর্ডের সদস্যরাও অনেক সময় জানেন না। সেজন্য আমি বলবো- সংকট কাটাতে শিক্ষক নিয়োগ তো করতেই হবে, পাশাপাশি নিয়োগ প্রক্রিয়া নতুন রূপে ঢেলে সাজাতে হবে।- ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, নামি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে স্থায়ী অধ্যাপক ৪৮ জন। আর খণ্ডকালীন ৭৪ জন। সহযোগী অধ্যাপক পদে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ীভাবে কর্মরত ৬৭ জন। আর খণ্ডকালীন ২৩ জন। একইভাবে সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক পদেও খণ্ডকালীন শিক্ষক রয়েছেন।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ভালো অবস্থানে থাকা ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটিরও একই অবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অধ্যাপক পদে স্থায়ী শিক্ষকের চেয়ে তিনগুণ খণ্ডকালীন। স্থায়ী অধ্যাপক ২৭ জন আর খণ্ডকালীন ৮২ জন। সহযোগী অধ্যাপক পদে স্থায়ী ৩২ জন এবং খণ্ডকালীন ৪৬ জন, সহকারী অধ্যাপক পদে স্থায়ী ৩২ এবং খণ্ডকালীন ৫৪ জন, প্রভাষক পদে স্থায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত ১২৮ জন এবং খণ্ডকালীন ১৩৪ জন। একই অবস্থা ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, স্টামফোর্ড, প্রাইম ইউনিভার্সিটি, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়েও।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে সবচেয়ে পিছিয়ে আরটিএম আল-কবির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি। প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৩৯। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে এন পি আই ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। তাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৩৮। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। নামি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ২২ হাজার ৭৪৫ জন। এর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন ৬১৩ জন। সেই হিসাবে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৩৭।

জানতে চাইলে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘নর্থ সাউথ অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিভিন্ন কারণে অনেক সময় তাতে ছেদ পড়ে। আর ইউজিসি ২০২২ সালের তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন করেছে। বর্তমানে আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত বেশ এগিয়েছে। আগামীতে আরও ভালো অবস্থায় নিয়ে যেতে চেষ্টা করা হবে। পাশাপাশি খণ্ডকালীনের চেয়ে স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগেও মনোযোগ দিয়েছি আমরা।’

‘খণ্ডকালীন শিক্ষকে ব্যবসা হয়, শিক্ষা-গবেষণা হয় না’ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষক সংকট থাকতে পারে। সেটা কাটিয়ে ওঠা দরকার। তারচেয়েও বেশি দরকার দক্ষ, যোগ্য ও মানবিক গুণাবলির শিক্ষক। তেমন শিক্ষক তরুণদের মধ্য থেকে কতজন উঠে আসছেন, সেটা দেখা জরুরি। রাজনৈতিক নেতৃত্বের বলয়ে এখন শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে। কোন মাপকাঠিতে তাদের নিয়োগ করছি, সেটা নিয়োগ বোর্ডের সদস্যরাও অনেক সময় জানেন না। সেজন্য আমি বলবো- সংকট কাটাতে শিক্ষক নিয়োগ তো করতেই হবে, পাশাপাশি নিয়োগ প্রক্রিয়া নতুন রূপে ঢেলে সাজাতে হবে।’

খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে সার্টিফিকেট ব্যবসা হয়, শিক্ষা-গবেষণা যথাযথ হয় না বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভ্রাম্যমাণ লেকচারার আছে, থাকবেন; সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আপনি একটা বিশ্ববিদ্যালয় খুলবেন, সেখানে এখান থেকে একজন, সেখান থেকে একজন শিক্ষক এনে ক্লাস নেওয়াবেন। আজ একজন এলো, তো কাল আরেকজন। মানদণ্ড বজায় রেখে এভাবে শিক্ষার্থীদের পড়ানোটা সম্ভব নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অবশ্যই স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগে নজর দিতে হবে। তাতে শিক্ষা-গবেষণার মান বাড়বে।’

এএএইচ/এএসএ/এএসএম