গণহত্যা-মুক্তিযুদ্ধের নীরব সাক্ষী জবির গুচ্ছ ভাস্কর্য

মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যার নীরব সাক্ষী হয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) ক্যাম্পাসে আজও দাঁড়িয়ে আছে দেশের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্য ‘৭১ এর গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি’। ওইদিন রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের স্মৃতিতে এই ভাষ্কর্যটি নির্মাণ করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী আলবদর-রাজাকার লাখ লাখ বাঙালিকে হত্যা করে। এ গণহত্যার স্মারক হিসেবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নির্মাণ করা হয় এই ভাস্কর্য।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে একটু ভেতরে ঢুকলেই এ ভাস্কর্যটি দেখা যায়। ক্যাম্পাসের শান্ত চত্বরের পাশে ভাস্কর্য চত্বরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভাস্কর্যটি। এটি তৈরি করেছেন খ্যাতনামা শিল্পী ভাস্কর রাসা। সম্প্রতি নতুন রং করে ভাস্কর্যটির সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাধারণ মানুষদের ধরে এনে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) ভেতরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে হত্যা করত পাক হানাদার বাহিনী। হত্যার পর লাশগুলোকে গণকবর দেওয়া হয় এখানে। সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের স্মারক হিসেবে গণকবরের ওপর এ ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়।

আরও পড়ুন

২৫ মার্চ, বাঙালির ইতিহাসের কালো অধ্যায়

এ ভাস্কর্যে মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যা ও যুদ্ধের প্রস্তুতির দুটি চিত্র উপস্থাপন করেছেন রাসা। ১৯৮৮ সালে শুরু হওয়া এ ভাস্কর্যের নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৯১ সালে। ২০০৮ সালের ৩১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের ততকালীন উপাচার্য প্রয়াত অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম খান এটি উদ্বোধন করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে একটু এগিয়ে গেলে নতুন ভবনের সামনে স্থাপিত এ ভাস্কর্যটি চোখে পড়ে। এর একটি অংশে সবচেয়ে বেদনাদায়ক স্মৃতি হিসেবে ২৫ মার্চের কালরাতকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

১৯৮৮ সালে এ ভাস্কর্যের কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ১৯৯১ সালে। ২০০৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করা হয়। ৩ বছরে কাজ শেষ হলেও এর উদ্বোধন হতে সময় নেয় ২০ বছর। ভাস্কর্যটি দুটি অংশে বিভক্ত। এর এক অংশে রয়েছে সর্বস্তরের মানুষের অংশ নেওয়া মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি আর অপর অংশে রয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম গণহত্যার চিত্র।

ভাস্কর্যটি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকলেও এখনো পূর্ণাঙ্গ নয়। ভাস্কর রাসা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে পাঁচটি ভাগে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। এগুলো হলো একাত্তরের গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি, ঘাতক, মুক্তিযদ্ধাদের আক্রমণ ও বিজয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্যে পাঁচটি থিমের দুটি তুলে ধরা হয়েছে। এখনো তিনটি বাকি। এগুলো হচ্ছে ঘাতক, মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ ও বিজয়। শিক্ষার্থীদের আশা, প্রশাসনের সহায়তায় অতি দ্রুত এর নির্মাণ শেষ হবে।

ভাস্কর্যটির মাধ্যমে গণমানুষের মুক্তিযুদ্ধ এবং তৎকালীন প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে। ভাস্কর্যে সবচেয়ে বেদনাদায়ক জায়গা হিসেবে ২৫ মার্চের কালো রাতকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ অংশে দেখানো হয়েছে, এই রাতে ইয়াহিয়া খান মাতাল অবস্থায় আছেন, পাকিস্তানি হানাদাররা হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, অন্তঃসত্ত্বা নারীকে অত্যাচার করে হত্যা করা হচ্ছে, মরদেহ ফেলে রাখা হচ্ছে যেখানে সেখানে।

ভাস্কর্যের অংশ হিসেবে রয়েছে একটি পাতাশূন্য বৃক্ষ। তার ওপর একটি শকুন বসে আছে। এ হচ্ছে শ্মশান হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের প্রতীক। অপর অংশে রয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির চিত্র। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা অনুযায়ী বাংলার কামার, কুমার, জেলে, কৃষিজীবী মানুষ যার যা কিছু ছিল দা, বটি, খুন্তি, বর্শা নিয়ে যুদ্ধের অংশ নিতে মুখিয়ে আছে মুক্তিকামী মানুষ। এখানে সে সময়ের বাংলাদেশকে তুলে ধরা হয়েছে।

আরও পড়ুন

জাতির জনকের ঐতিহাসিক ভাষণ ও আমাদের স্বাধীনতা

পরের অংশে দেখা যায়, সবাই আধুনিক অস্ত্র নিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। যুদ্ধে নামার পর যখন যোদ্ধারা বুঝতে পারেন-পুরোনো পদ্ধতি দিয়ে তাদের সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব নয়, তখন সবাই প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেন। যেখানে রয়েছেন সব বয়সী নারী-পুরুষ। পরিপূর্ণ যুদ্ধের জন্য গেরিলা কৌশল, মাঝারি আকারের অস্ত্রের ব্যবহার শিখছেন তারা।

ভাস্কর্যের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন প্রশিক্ষণ নেওয়া সাহসী এক কৃষকের ছেলে। তার চোখে যুদ্ধজয়ের নেশা। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিতে সবার চোখে প্রতিশোধস্পৃহার ছাপ রয়েছে। এছাড়া সবার মাথা সোজা, মুখ লাল বর্ণের। সবার চোখে প্রতিশোধ স্পৃহার ছাপ। আবার অন্যদিকে গণহত্যার দৃশ্যের রং ধূসর, কারণ এটি আমাদের বেদনাদায়ক স্মৃতি।

ভাস্কর্যের নিচে রয়েছে পানি, যা দিয়ে নদীমাতৃক বাংলাদেশকে বোঝানো হয়েছে। আর পানির ভেতরে রয়েছে বাংলা বর্ণমালা, যা দিয়ে ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে তুলে ধরা হয়েছে। এতে বোঝানো হয়েছে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সফলতায় বাংলার মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার ভাবনা আসে। বাংলার মাটি, মানুষ আর ভাষা একাকার হয়ে আছে এ ভাস্কর্যে।

বর্তমানে ভাস্কর্যটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শোভাবর্ধনের অদ্বিতীয় শিল্পকর্ম। এর চারদিকে আছে পানির ফোয়ারা। ফোয়ারাগুলো ছাড়লে নয়নাভিরাম দৃশ্যের অবতারণা হয়। রাতে রঙিন বাতির আলোয় এটি যেন আরও মনোমুগ্ধকর হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষা এবং নতুন প্রজন্মের সামনে ইতিহাসের নির্মম অধ্যায় তুলে ধরতে এ ভাস্কর্যটি এখনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

লেখক: শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

কেএসকে/এএসএম