ফিচার

২৫ মার্চ, বাঙালির ইতিহাসের কালো অধ্যায়

২৫ মার্চ,যে রাতে হানাদারদের ভয়াল থাবা আঘাত হেনেছিল ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালির উপর। চলে অমানবিক নরকযজ্ঞ। চলে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশা। ঐতিহাসিক এ কালরাত্রির উপর দৃষ্টিপাত করেছেন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমন্ডলী। তাদের মতামত তুলে ধরেছেন হুমায়রা রহমান সেতু।

Advertisement

স্বাধীনতার আন্দোলন কমানোর প্রচেষ্টাঅধ্যাপক ড. মো: মোকলেছুর রহমান সরকার, বিভাগীয় প্রধান, ফার্মেসি বিভাগ

পাকিস্তানি শোষকচক্রের যাতাকল থেকে যখন বাঙালি বেরিয়ে আসতে চায়, তখনই রচনা হয় এই নীল নকশা। দেশভাগের পর থেকেই স্বাধীনতাকামী মুক্তি পাগল মানুষগুলো তাদের অধিকারের দাবি জানিয়ে আসছে। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করার পরেও গদি ছাড়তে তারা নারাজ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল টিক্কা খানের নির্দেশে পাকিস্তানের ২ সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও রাও ফরমান আলী ওই অভিযানের নির্দেশনামা তৈরি করে। সেনা কমান্ডারদের মৌখিকভাবে জানিয়ে দেন অভিযান চালানোর জন্য। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আঘা মুহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমঝোতা আলোচনা ইতিবাচক বা কোনো অগ্রগতি না হওয়ার প্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলার আন্দোলন দমানোর জন্য কুখ্যাত সেই ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক গণহত্যা চালানো হয়।

ইতিহাসের কালো অধ্যায়সাবরিনা নাসরিন, সহকারী প্রভাষক, বাংলা বিভাগ২৫ মার্চের গণহত্যা শুধু বাঙালির ইতিহাসে নয় বিশ্ব মানবতার ইতিহাসে এক ভয়ংকর কালো অধ্যায়। সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করার পরও ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকবাহিনী। বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা কেউ বাদ যায়নি সেই ভয়াল রাতের থাবা থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, রাজারবাগ, পুলিশলাইন, পিলখানা (বর্তমান বিজেপি সদর দপ্তর) সহ সারাদেশে চলে এই হত্যাযজ্ঞ। তৎকালীন সময় বিশ্বের প্রতিটি গণমাধ্যমে এই সংবাদ প্রচার করা হয়। এ ছিল এক জাতিকে শেষ করে দেওয়ার গভীর নীল নকশা।

Advertisement

আরও পড়ুন

গণহত্যা দিবস আজ

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিনির্মাণের স্বপ্নড. মোহাম্মদ আলী আজম খান, সভাপতি, রাজনীতি ও প্রশাসন বিভাগ

১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের একটি অংশ হিসেবে ধর্মের উপর ভিত্তি করে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত বঙ্গ প্রদেশ ভারত এবং পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বিভক্ত হয়। প্রধানত হিন্দু ধর্মাবলম্বী পশ্চিমবঙ্গ ভারত এবং মুসলিম ধর্মাবলম্বী পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়। বিভাজনের পর থেকেই শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের একচেটিয়া শাসন। যা মানতে নারাজ ছিল অধিকার সচেতন বাংলার জনগণ। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান প্রদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে। ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ষড়যন্ত্র স্বরূপ সূচনা হয়েছিল এই কালরাত্রির।

গোপন ষড়য়ন্ত্রের নকশানিরঞ্জন বিশ্বাস, সভাপতি, ইংরেজি বিভাগ

Advertisement

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের ফলাফলে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ১৬৭টি, জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টি ৮৮টি এবং অন্যান্য সব দল মিলে ৫৮টি আসন লাভ করে। ১৪ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন দেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী।’ কিন্তু ১৭ জানুয়ারি ভুট্টোর গ্রামের বাড়ি সিন্ধু প্রদেশের লারকানায় ইয়াহিয়া-ভুট্টো গোপন বৈঠকের পরপরই ফেব্রুয়ারি মাসে, বাঙালির লাগাতার আন্দোলন প্রসঙ্গে ইয়াহিয়া খান হুংকার দেন, ‘কিল থ্রি মিলিয়ন অব দেম অ্যান্ড দ্য রেস্ট উইল ইট আউট আওয়ার হ্যান্ডস’। কিন্তু তিনি ১৫ মার্চ ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার প্রহসন করতে থাকেন। ওদিকে প্রতিদিন বিমানযোগে ঢাকায় সৈন্য আনা হতে থাকে পাকিস্তান থেকে। অস্ত্র ভর্তি যুদ্ধ জাহাজ এসে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করে। ১৭ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠক করেন। ঐদিনই প্রেসিডেন্ট ভবনে রাতে তিনি গভর্নর টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠক করেন। রাত দশটায় টিক্কা খান ১৪ পদাতিক বাহিনীর জিওসি খাদিম হোসেন রাজাকে চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। ১৮ মার্চ সকালে জেনারেল রাজা ও সামরিক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলী ঢাকা সেনা নিবাসে জিওসির অফিসে বসে রচনা করেন নৃশংস গণহত্যার নীল নকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এর রূপরেখা।

গণহত্যার প্রেক্ষিতে গণ জাগরণদিলরুবা আক্তার পানসি, সিনিয়র প্রভাষক, ফলিত গণিত

আওয়ামী লীগ ১৯৭০ এর নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাক-সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা টালবাহানা শুরু করে। লোক দেখানো বৈঠকের মাধ্যমে সময় ক্ষেপণ করে নিরস্ত্র বাঙালি নিধনের গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭১ সালের ২ মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে দীর্ঘ ২৩ বছরের শাসন-শোষণ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট রূপরেখা প্রদান করেন এবং ১৫ মার্চ থেকে ৩৫ দফা নির্দেশনা পালনের আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশ সারা বাংলায় অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়। পূর্ব বাংলায় বেসামরিক শাসন ব্যবস্থা পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়লে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে বারবার সমঝোতার প্রস্তাব দিতে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতার মোহ ত্যাগ করে এদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অটল থাকেন।

আরও পড়ুন

বিদেশে সংরক্ষিত কল-রেডীর যন্ত্রপাতি জাতির জনকের ঐতিহাসিক ভাষণ ও আমাদের স্বাধীনতা

কেএসকে/জেআইএম