দেশজুড়ে

গলাকাটা টোলে পদ্মার লক্ষ্মীপুর-পাঁকা ঘাট এখন গলার কাঁটা

ধরা যাক, সকালে ঘুম থেকে উঠে বাজারে যাবেন। পদ্মা নদীর ধারে এসে নৌকায় উঠলেন। ৩০ টাকা দিয়ে পার হয়ে বাজারে গিয়ে এককেজি বেগুন কিনলেন ৪০ টাকায়। এখন বাড়িতে যাওয়ার জন্য ফের নৌকায় উঠেছেন আরও ৩০ টাকায়। আর আপনার হাতে থাকা এককেজি বেগুনের টোল দিলেন ২০ টাকা। হিসাব করলে বেগুনের দাম ৪০ টাকা হলেও বাড়িতে গিয়ে এক কেজি বেগুনের দাম পড়লো ১২০ টাকা।

Advertisement

শুনতে অবাক লাগলেও এমনটাই হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চরাঞ্চলে অবস্থিত পাঁকা ইউনিয়নে। এই ইউনিয়নের বেশকিছু গ্রামে যেতে হয় পদ্মা নদী পার হয়ে। এজন্য তাদের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম নৌকা। আর এতেই বেঁধেছে বিপত্তি। নৌকায় পারাপারের জন্য নিজের ভাড়ার পাশাপাশি হাতে থাকা পণ্যের জন্যও গুণতে হয় আলাদা টোল।

যেমন টাকায় একটি ডাব কিনে নৌকায় উঠলেই টোল লাগে ৩০ টাকা। আর যাত্রীর টোলতো আলাদা ৩০ টাকা আছেই। এভাবেই গলাকাটা টোল আদায় করছেন লক্ষ্মীপুর-পাঁকা ঘাটের ইজারাদাররা। অর্থাৎ ডাবের দাম ৭০ টাকা হলেও বাড়িতে নিয়ে যেতে খরচ পড়ছে ১৩০ টাকা।

জানা যায়, জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার পদ্মা নদীতে মোট পাঁচটি নদীপারের ঘাট রয়েছে। এতে ফেরিঘাট রয়েছে তিনটি, আর মানুষ পারাপারের জন্য খেয়া ঘাট রয়েছে আরও দুটি। ঘাটগুলো হলো- মনোহরপুর, লক্ষ্মীপুর, পাঁকা, নিউ পদ্মা ও উজিরপুর। এ ঘটগুলোর ইজারাদারদের কাছে জিম্মি সাধারণ মানুষ। নৌকার যাত্রীদের সঙ্গে থাকা একটি ডাব, কিংবা একটি গাছের চারারও জোরপূবর্ক টোল আদায় করা হচ্ছে।

Advertisement

 

এমন ঘটনায় বিরক্ত হয়ে সম্প্রতি শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে এর প্রতিকার চেয়ে ইজারাদারদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেছেন চরাঞ্চলের শত শত মানুষ।

আলী হাসান নামে এক ব্যক্তি বলেন, একজন ব্যক্তি বাড়িতে লাগানোর জন্য শিবগঞ্জ বাজার থেকে একটি পেয়ারা গাছের চারা কেনেন ৪০ টাকা দিয়ে। কিন্তু ওই চারাটির টোল চাওয়া হয় ৩০ টাকা। টাকা দিতে না পারায় বাধ্য হয়ে নদীতে ফেলে দিতে হয়েছে চারাটি। এভাবে আমাদের জিম্মি করে রেখেছে। কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারছি না।

রাধাকান্তপুর গ্রামের সোহেল আলী বলেন, আমার এক স্বজন মারা যান কয়েকমাস আগে। কিন্তু কবরস্থানে যেতে পদ্মা পার হতে হবে। ইজারাদারদের সঙ্গে আমার কথা হলো। শুধু তেল খরচ দিয়ে মরদেহটা পার করে দেবে। তারা পার করেও দিলো। কিন্তু যখন দাফন শেষে আমরা বাসাই ফিরছিলাম তখন আমার কাছ থেকে জোর করে ৩২০০ টাকা আদায় করেছে। এখন আপনি বলেন, আমরা কার কাছে বিচার দেবো?

চরাঞ্চলের বাসিন্দা আতাউর রহমান বলেন, প্রতিবছর রাক্ষুসে পদ্মার ভাঙনের কারণে চরাঞ্চলের মানুষকে ঘরবাড়ি ভাঙতে হয়। এসব ভাঙা বাড়ি নদীর এপার ওপার করতে ইজারাদারদের বাধ্যতামূলক দিতে হয় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। টাকা না দিলে কোনো ঘাট পার হওয়া যায় না। এমনকি চাহিদামতো টোলের টাকা পরিশোধ না করতে পারলে আটকে রাখা হয় ভাঙা বাড়ির মালামাল।

Advertisement

তিন বলেন, একদিকে বার বার বাড়ি ভাঙতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে সাধারণ মানুষ, অপরদিকে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ইজারাদারদের গলাকাটা টোল আদায়।

চরঞ্চলের নিশিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল আওয়াল বলেন, ইজারাদারদের সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে এখানে। তারা ইচ্ছামতো টাকা আদায় করছে। একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন নৌকা মানুষ পারাপারের জন্য নিয়ে আসলেও ২০০০-৩০০০ হাজার টাকা টোল দিতে হয়। সিন্ডিকেট না থাকলে ৩০০-৫০০ টাকায় পারাপার হওয়া সম্ভব।

মাথায় একটি বস্তা নিয়ে নৌকা পারাপার হচ্ছিলেন সোহাগ আলী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমার মাথায় যে বস্তা দেখতে পাচ্ছেন, এই বস্তার ভাড়া নেওয়া হয়েছে ১০০ টাকা। আর আমি নিজে পার হয়েছি তাতেও নিয়েছে ৪০ টাকা। আমাকে মোট ১৪০ টাকা দিয়ে এই পদ্মা নদী পার হতে হলো। ইজারাদারদের কাছে আমরা জিম্মি।

জানতে চাইলে ফেরিঘাটের ইজারাদার মো. রিপন আলী বলেন, যারা অতিরিক্ত পণ্য বহন করে শুধুমাত্র তাদের কাছ থেকেই টোল আদায় করা হচ্ছে। ঘাটে কোনো সিন্ডিকেট নেই। টোল আদায়ে কাউকে বাধ্যও করা হয় না। অনেক গরিব মানুষ আছে যারা টোলের টাকাও দিতে পারে না। তাদের ফ্রি পার করা হয়।

শিবগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জুবায়ের হোসেন জানান, আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। এরইমধ্যে শুকিয়ে যাওয়া ঘাটগুলোতে টোল আদায় বন্ধ করা হয়েছে। আর ৩ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগে ২৯টি আইটেমের জন্য টোল নির্ধারিত ছিল। আগামীতে ১১৩টি আইটেমের জন্য নতুন করে টোল নির্ধারণ করা হচ্ছে।

সোহান মাহমুদ/এফএ/এমএস