‘বন্ধু এই দেখ আমরা ইয়াবা খাচ্ছি, কত্ত মজা, তুই একটা টান দে’। এভাবে এক টান দু-টান করতে করতে নেশার জগতে প্রবেশ করেন একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সৈয়দ নাফিস ইকবাল (ছদ্মনাম)। ১৯ বছর বয়সী নাফিসের স্বপ্ন ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। কিন্তু একমাত্র সন্তান যখন ইয়াবা নামক মাদকের ভয়ঙ্কর নেশার জগতে ঢুকে যায় তখন বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তার আর অন্ত থাকে না।
Advertisement
২০১৯ সালে কৌতূহলবশত বন্ধুদের মাধ্যমে ইয়াবা সেবন শুরু করেন নাফিস। এরপর ধীরে ধীরে হয়ে পড়েন আসক্ত। এই তরুণের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের। নাফিস বলেন, পড়ালেখা করায় মাসিক একটা হাত খরচ ছিল, সেই টাকা দিয়ে ইয়াবা কিনতাম। প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার টাকা ইয়াবা কিনতে খরচ হতো। ইয়াবা নেওয়ার পর শরীরে ব্যথা আসতো, ঘুম কম হতো এবং অনেক কিছুর প্রতি আগ্রহ কমে যেত। এমনকি পরিবারের মানুষের সঙ্গে কথাবার্তায় মেজাজ সবসময় খিটখিটে থাকতো।
‘আড়াই বছর পর নিজের কাছে মনে হয় আমি বিপথে যাচ্ছি। এরপর সে পথ থেকে ফিরে আসার চেষ্টা করি’- বলেন নাফিস। ২০২২ সালে গভীরভাবে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েন এই তরুণ। এরপর একটা সময় বাধ্য হয়েই বাবা-মাকে জানান, তিনি ভুল পথে যাচ্ছেন। বিষয়টি বুঝতে পেরে নাফিসের বাবা-মা তাকে পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘ওয়েসিস’ নামের অত্যাধুনিক মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি করান।
যেসব শিক্ষার্থী ইয়াবা কিংবা অন্য কোনো মাদকে আসক্ত তাদের উদ্দেশে কী বার্তা তার? জানতে চাইলে নাফিস জাগো নিউজকে বলেন, জীবনে ভুল একবারই হয়। দ্বিতীয়বার একই ভুল করা যাবে না। সাময়িক আনন্দের জন্য যে মাদক আমরা নিই সেটা আমাদের তিলে তিলে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। এজন্য সবাইকে সব ধরনের মাদক থেকে দূরে থাকতে হবে। মাদকাসক্ত বা খারাপ বন্ধুদের সবসময় এড়িয়ে চলতে হবে।
Advertisement
আরও পড়ুন
কিশোর গ্যাং ও মাদকরোধে র্যাবের কার্যকর ভূমিকা চান প্রধানমন্ত্রী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত মাদকবিরোধী বক্তব্য দেওয়ার নির্দেশমাদকাসক্তদের অন্ধকার জগৎ থেকে ফিরিয়ে আনা কঠিন ব্যাপার। ব্যক্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় মাদকাসক্তের পরিবারকে। স্বজনরা খুঁজতে থাকেন নির্ভরযোগ্য মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র। দেশের মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে এখনো যথাযথ সেবা ও নিরাপত্তা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। বরং ঢালাওভাবে গড়ে ওঠা বিভিন্ন মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের বিরুদ্ধে রয়েছে মারধরের মতো গুরুতর অভিযোগ।
পড়ালেখা করায় মাসিক একটা হাত খরচ ছিল, সেই টাকা দিয়ে ইয়াবা কিনতাম। প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার টাকা ইয়াবা কিনতে খরচ হতো। ইয়াবা নেওয়ার পর শরীরে ব্যথা আসতো, ঘুম কম হতো এবং অনেক কিছুর প্রতি আগ্রহ কমে যেতো। এমনকি পরিবারের মানুষের সঙ্গে কথাবার্তায় মেজাজ সবসময় খিটখিটে থাকতো
সে কারণে অনেক পরিবারের অভিভাবকরা নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামাজিকভাবে সম্মানহানির ভয়ে সন্তানদের মাদক নিরাময় কেন্দ্রে নিতে চান না। এসব বিষয় মাথায় রেখে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের আলোর পথে ফেরাতে কাজ করছে পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে পরিচালিত মাদক নিরাময় কেন্দ্র ও মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র ‘ওয়েসিস’।
Advertisement
২০২১ সালের অক্টোবরে রাজধানীর অদূরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রকল্পে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ওয়েসিস। মনোমুগ্ধকর ও নান্দনিক পরিবেশে উন্নত ব্যবস্থাপনায় দেশের সবচেয়ে অত্যাধুনিক মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র এটি। এরই মধ্যে ওয়েসিসের চিকিৎসা পদ্ধতি, পরিবেশ এবং আন্তরিকতা বেশ প্রশংসাও কুড়িয়েছে।
বর্তমানে ওয়েসিসের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত গত প্রায় আড়াই বছরে আড়াইশর বেশি মাদকাসক্ত নারী-পুরুষ সেখানে চিকিৎসা নিয়ে ফিরেছেন স্বাভাবিক জীবনে। তাদেরই একজন সৈয়দ নাফিস ইকবাল।
সম্প্রতি সরেজমিনে প্রতিষ্ঠানটির সেবা কার্যক্রম পর্যালোচনায় দেখা যায়, মাদকাসক্ত রোগীদের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেছে ওয়েসিস। একজন মানুষকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে যা কিছু প্রয়োজন সব ব্যবস্থাই রয়েছে সেখানে। রোগীর স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে নিজস্ব হোস্টেলে তৈরি খাবার পরিবেশন থেকে শুরু করে তাদের শারীরিকভাবে ফিট রাখতে জিমের ব্যবস্থা, লাইব্রেরি, বিনোদন, নামাজ ও খেলাধুলার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। এছাড়া রয়েছে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট ও অন্য যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা। যেখানে রোগী ও তাদের স্বজনদের ইচ্ছে অনুযায়ী ওই প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নেওয়ার বিষয়টিও চাইলে গোপন রাখতে পারেন। বিশেষ করে নারীদের জন্য আছে পৃথক ব্যবস্থা। নারীদের উপযোগী সব ধরনের ব্যবস্থা রাখতে তাদের জন্য রয়েছে পৃথক ফ্লোর।
২০২১ সালের ১ অক্টোবর মাদকাসক্তি নিরাময় ও মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র ‘ওয়েসিস’ উদ্বোধন করা হয়। ওয়েসিসের পথচলা শুরু ওই বছরেরই ৭ অক্টোবর। এরপর মাত্র আড়াই বছরেরও কম সময়ে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে আড়াইশর বেশি রোগী চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন। যাদের সবাই একসময় ছিলেন মাদকাসক্ত। এখন তারা সবাই আলোর পথের যাত্রী।
ছিল সুখের সংসার। কিন্তু হঠাৎ বাবু বদলে যেতে থাকেন। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সেবন করা শুরু করেন ফেনসিডিল। বিশেষ করে রাতে ফেনসিডিল সেবন করে বাসায় ফিরতেন। এরপর সংসারে শুরু হয় অশান্তি। বিষয়টি শুরুর দিকে তার স্ত্রীও বুঝতে পারতেন না। ৭-৮ বছর পর স্ত্রী বুঝতে পারেন স্বামীর মাদকাসক্তির বিষয়টি। কিন্তু ততক্ষণে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে
সরেজমিনে ওসেসিস ঘুরে দেখা গেছে, সাততলা ভবনের নিচতলায় অভ্যর্থনা কক্ষ। অন্যদিকে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ সদস্যরা পাহারায় থাকেন। তার পাশেই বহির্বিভাগে রোগী দেখার কক্ষ। অন্য পাশে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিষ্কার-পরিছন্ন রান্নাঘর। সেখানেই প্রতিদিন রোগীদের খাবারের জন্য রান্নার কাজ চলে।
ভবনের প্রথমতলা থেকে তৃতীয়তলা পর্যন্ত মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের আবাসিক ব্যবস্থায় চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। পাশাপাশি ভবনটিতে রয়েছে সর্বাধুনিক প্যাথলজি ল্যাব। এসি ফ্লোর, জেনারেল বেডের ওয়ার্ড, ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থা, বিশেষ কেবিন ও ইনডোর গেমসের ব্যবস্থা। শুধু খেলাধুলাই নয়, রয়েছে নামাজের জন্য আলাদা কক্ষ ও পড়ালেখার জন্য লাইব্রেরির সুব্যবস্থাও।
এছাড়াও রয়েছে নার্সিং স্টেশন। এর ঠিক ওপরেই গড়ে তোলা হয়েছে সুসজ্জিত বাগান। প্রাকৃতিক পরিবেশে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রোগীদের জন্য ইয়োগা ও মেডিটেশন করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বাগানে।
আরও পড়ুন
ভবনের ওপরে স্কুল, নিচে মদের বার কোকেনের গন্তব্য ইউরোপ-আমেরিকা, ‘নিরাপদ’ রুট বাংলাদেশছাদবাগানের পাশেই রয়েছে ব্যায়ামাগার। অর্থাৎ, মাদকাসক্তদের পরিপূর্ণ সেবা দিতে সরকারের সবগুলো বিধিমালা মেনেই গড়ে তোলা হয়েছে ওয়েসিস। যেখানে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ছাড়াও বিশেষজ্ঞ মনোরোগ চিকিৎসক, সাইকোলজিস্ট, সাইকোথেরাপিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট, ইয়োগা এক্সপার্ট এবং অভিজ্ঞ অ্যাডিকশন কাউন্সেলরদের মাধ্যমে সেবা পাচ্ছেন সেবাপ্রত্যাশীরা।
ওয়েসিসে চিকিৎসা নেওয়া শিক্ষার্থী সৈয়দ নাফিস ইকবালের পরিবার জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, তারা যখন বুঝতে পারেন তাদের সন্তান ভয়াবহভাবে ইয়াবায় জড়িয়েছে তখন একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে তাকে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু কিছুদিন পর সেখান থেকে ফিরে সে আবারও মাদকে জড়ায়। এভাবে একাধিক নিরাময় কেন্দ্রে তাকে চিকিৎসা করানো হলেও কোনো সুফল পাননি তারা। সর্বশেষ তাকে ওয়েসিসে ভর্তি করানো হয়।
নাফিস নিজেও বলছিলেন, এবার তিনি অতীতের সব ভুল বুঝতে পারছেন। ওয়েসিসে ভর্তি হওয়ার পর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, হাদিসের বই পড়েন, জিম করেন, বিকেলে ছাদে হাঁটাহাটি করেন। এছাড়া সেখানকার খাবারের মানও অনেক উন্নত। যার ফলে তার কাছে মনে হয়েছে, তিনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেই বসবাস করছেন।
শাহীন হাওলাদার বাবু (ছদ্মনাম)। নামকরা একজন ব্যবসায়ী। তার প্রতিষ্ঠানে প্রায় দুই শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করেন। ছিল সুখের সংসার। কিন্তু হঠাৎ বাবু বদলে যেতে থাকেন। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সেবন করা শুরু করেন ফেনসিডিল। বিশেষ করে রাতে ফেনসিডিল সেবন করে বাসায় ফিরতেন। এরপর সংসারে শুরু হয় অশান্তি। বিষয়টি শুরুর দিকে তার স্ত্রীও বুঝতে পারতেন না। ৭-৮ বছর পর স্ত্রী বুঝতে পারেন স্বামীর মাদকাসক্তির বিষয়টি। কিন্তু ততক্ষণে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। শাহীনকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে গত বছর (২০২৩ সাল) তার স্ত্রী ওয়েসিসে ফোনকল করেন। এরপর খুব গোপনীয়তার সঙ্গে তাকে ওয়েসিসে ভর্তি করা হয়। সেখানে তাকে প্রায় চার মাস চিকিৎসা দেওয়া হয়। চার মাসের চিকিৎসাতেই বাবু এখন পুরোপুরি সুস্থ। আগের মতোই ভালোভাবে দেখভাল করছেন নিজের বড় ব্যবসা। সংসার করছেন দিব্যি। আগের মতোই হাসিখুশিতে কাটছে তার জীবন।
৪৬ জন পুরুষ ও ১৪ জন নারী মিলিয়ে একসঙ্গে মোট ৬০ জনকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া বহির্বিভাগে বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা সেবা দেওয়া হয়। টেলিমেডিসিনের মাধ্যমেও অনেকে সেবা নেন; যেখানে অভিভাবকরা বেশি ফোনকল করেন। সন্তান বা পরিবারের কোনো সদস্য মাদক সেবন করছেন বা লক্ষণ সন্দেহজনক মনে হলেই অভিভাবকরা সেখানে ফোনকল করেন
শাহীন হাওলাদার বাবু জাগো নিউজকে বলেন, সাত-আট বছর ধরে ফেনসিডিল সেবন করেছি। স্ত্রী-সন্তান কিংবা পরিবারের কেউই জানতো না। এলাকার বড় ভাইদের মাধ্যমে এই মাদকের অভ্যাস তৈরি হয়। প্রতিদিন একটি করে ফেনসিডিল লাগতো। প্রতিটির দাম প্রায় তিন হাজার টাকা। এতে মাসে খরচ হতো প্রায় লাখ টাকা। ব্যবসা করে টাকা উপার্জন করতাম বলে টাকার সমস্যা ছিল না। কিন্তু গত ৭-৮ বছরে ফেনসিডিল সেবনে আমার অনেক টাকা নষ্ট হয়েছে। যা দিয়ে হয়তো আমি ভালো কিছু করতে পারতাম। যখন ফেনসিডিল সেবন করতাম তখন আর চিকিৎসা নেওয়ার পর এখন আমার মাঝে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। আগে সব সময় মেজাজ খারাপ থাকতো। এখন ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু ভালোভাবে করছি। ওয়েসিসে আমি চার মাস ছিলাম। এখন আলহামদুলিল্লাহ্ সুস্থ আছি, ভালো আছি।
বাবুর স্ত্রী জাগো নিউজকে বলেন, ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত অনেক জায়গায় চেষ্টা করেও তাকে কোনো মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করাতে ভরসা পাইনি। কারণ ইউটিউবে যতগুলো দেখেছি সবগুলোতে টর্চার করা হয়। আমার পরিবারে সহায়তা করার মতো কেউ ছিল না। দুই বাচ্চাও ছোট। এ কারণে আমি নিজেই সাহস করে স্বামীকে সুস্থ করার চ্যালেঞ্জ নিই। এরপর খুব গোপনীতার সঙ্গে ওয়েসিস কর্তৃপক্ষ বাসায় এসে আমার স্বামীকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যায়। প্রথমদিন আমিও সঙ্গে যাই। চার মাস থাকার পর সে এখন পুরোপুরি সুস্থ।
ওয়েসিসে চিকিৎসায় খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওয়েসিসের খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং পরিবেশ সবকিছু মিলিয়ে হিসাব করলে খরচ খুব যে বেশি তা নয়। বিশেষত, সেখানে রোগীদের কোনো মারধর করা হয় না।
মাদকের সংশ্লিষ্টতা থাকায় অনেক নারী স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছেন। কিন্তু আপনি সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সংগ্রাম করে নিজেই স্বামীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। এটি কীভাবে সম্ভব হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে শাহীনের স্ত্রী বলেন, ডিভোর্স সঠিক সমাধান নয়। ধৈর্য ধরে রোগীকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলাই সমাধান। আমি স্বামীকে অনেক ভালোবাসি। আমার সংসার অনেক সুখের ছিল। কিন্তু সে অন্য মানুষের সঙ্গে পড়ে নেশার জগতে চলে যায়। সেই খারাপ জগত থেকে তাকেহ ফিরিয়ে আনাই আমার বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।
ওয়েসিস কর্তৃপক্ষ জানায়, দুই বছরের পথচলা তাদের। তবে অল্প সময়ে তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে আড়াইশোর বেশি নারী-পুরুষ চিকিৎসা নিয়ে পরিবারের কাছে ফিরে গেছেন। তারা কেউই এখন মাদক গ্রহণ করেন না। উল্টো কেউ মাদকে জড়ালে তাকে সচেতন করেন।
ওয়েসিসে ৪৬ জন পুরুষ ও ১৪ জন নারী মিলিয়ে একসঙ্গে মোট ৬০ জনকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া বহির্বিভাগে বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা সেবা দেওয়া হয়। টেলিমেডিসিনের মাধ্যমেও অনেকে সেবা নেন; যেখানে অভিভাবকরা বেশি ফোনকল করেন। সন্তান বা পরিবারের কোনো সদস্য মাদক সেবন করছেন বা লক্ষণ সন্দেহজনক মনে হলেই অভিভাবকরা সেখানে ফোনকল করেন। তখন ওয়েসিসের বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন পরামর্শ দেন, যা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। প্রতি মাসে দেড়শোর বেশি মানুষ টেলিসেবা নিয়ে থাকেন। ওয়েসিসের বিশেষজ্ঞদের সেবা নিতে ফোনকল করতে হয়- ‘০১৯৩০-৪০৪০৪০’ এ নম্বরে।
প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও পুলিশ পরিদর্শক সুশান্ত নারায়ণ জাগো নিউজকে বলেন, মাদকাসক্ত সব রোগীই এখানে চিকিৎসা নিতে পারেন। যারা চিকিৎসা নিতে আসেন তাদের সবসময় কাউন্সিলিং করা হয়। তাকে যেসব ওষুধ দেওয়া হচ্ছে সব ঠিক মতো কাজ করছে কি না এসব বিষয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হয়। চার মাস চিকিৎসা শেষে কেউ ফিরে গেলেই ওয়েসিসের কাজ শেষ হয়ে যায় না। একজন সিনিয়র কর্মকর্তা প্রতিনিয়ত রোগী ও তার স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন এবং তারা ওয়েসিসে এলে বিনামূল্যে ফলোআপ চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। ফলোআপের সময় সন্দেহজনক মনে হলে ডোপটেস্ট করা হয়। এ ভয়েও কেউ নতুন করে মাদকে জড়ান না।
আরও পড়ুন
১০০ কোটি টাকার কোকেন পাচারের ট্রানজিট ছিল বাংলাদেশ তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে তরুণদের দৃপ্ত শপথ ই-সিগারেট বিক্রি ও বিজ্ঞাপন বন্ধে সরকারকে লিগ্যাল নোটিশতিনি বলেন, গোপনীয়তা বলতে সব ধরনের গোপনীয়তা বজায় রেখে রোগী আনা ও সেবা দেওয়া হয়। পরিবারের নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তি ছাড়া রোগীর বিষয়ে অন্য কেউ কিছু জানতে পারে না। চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফেরার পর ওই রোগীর যে মানসিক চিকিৎসার কাউন্সিলিং প্রয়োজন হয় আর সেটি যতদিন দরকার তা ফ্রি দিয়ে থাকি। রোগীকে স্থায়ীভাবে সুস্থ করে তুলতে যা যা উদ্যোগ নেওয়া দরকার আমরা সবই নিয়ে থাকি।
পুলিশ পরিদর্শক সুশান্ত আরও বলেন, আমাদের এখানে বাইরের খাবারের অনুমোদন নেই। টাটকা খাবার এখানেই রান্না করা হয়; যা রোগী ও স্টাফ মিলে প্রতিবেলায় প্রায় ৭০ জন খেয়ে থাকেন।
ওয়েসিস প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সেখানে কাজ করছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোর্তজা হাসান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এখানে কোনো মাদকসেবী এলে প্রথমে দেখা হয় তিনি কী ধরনের মাদক গ্রহণ করেন, বয়স কত এবং তার অন্য কোনো শারীরিক বা মানসিক সমস্যা আছে কি না। এটা বিবেচনায় নিয়ে তার চিকিৎসা শুরু হয়। চিকিৎসার প্রথম ধাপ হচ্ছে ডিটক্সিফিকেশন। মাদক গ্রহণের ধরনের ওপর একজন রোগীর চিকিৎসা ও মেডিসিন নির্ভর করে। পাশাপাশি যদি অন্য কোনো সমস্যা- যেমন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা থাকে সেটার ওপর নির্ভর করেও ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়। এই ডিটক্সিফিকেশন কালটা কারও এক মাস আবার কারও দুই মাসও লেগে যায়। অনেকের আবার আরও কম সময়ও লাগে।
ডা. মোর্তজা বলেন, এরপরই শুরু হয় লাইফস্টাইল মোটিভেশন প্রোগ্রাম। এতে মোটিভেশন, সাইকোথেরাপি, সাইকো অ্যাডুকেশন প্রোগ্রামগুলো চলে। সেখানে রোগীর জীবনদর্শন, মাদক নিয়ে তার চিন্তা-ভাবনা, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন সবকিছু ওঠে আসে এবং মাদক থেকে পূর্ণাঙ্গ মুক্ত হওয়ার উপায় খুঁজে পান তিনি। এজন্য শুধু তাকে নয়, পরিবার ও স্বজনদেরও কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে রোগীর সুস্থ হওয়ার পথটা বের করা হয়।
মাদকসেবীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমানে বেশ সংখ্যক নারীরাও মাদক সেবনে জড়িয়ে যাচ্ছেন। অনেক রোগী আমরা পাচ্ছি, যাদের মধ্যে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রী রয়েছে। নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া যায়, যারা ঘুমের ওষুধ সেবন করেন।
ওয়েসিস সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার ও ওয়েসিস চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডানুযায়ী গড়ে তোলা হয়েছে মাদক নিরাময় কেন্দ্র ও মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র ‘ওয়েসিস’। এটি পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান। যেখানে চিকিৎসাসেবা থেকে শুরু করে সেবা-পরবর্তী ট্রিটমেন্ট ফ্রি দেওয়া হয়। এখানে সবচেয়ে সুন্দর ও মনোরম পরিবেশে একজন রোগীকে খুব অল্প দিনেই সুস্থ করে তোলা হয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন।
ওয়েসিস নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, মানিকগঞ্জে একটি বড় জায়গায় রিসোর্টের মতো নিরাময় কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। যেখানে খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত জায়গা থাকবে। পাশে কালিগঙ্গা নদীতে নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থাও করা হবে।
টিটি/এমকেআর/এমএস